• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ১০:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ১০:০৮ পিএম

জিএম কাদেরের পক্ষে অধিকাংশ এমপি, কোণঠাসা রওশন

জিএম কাদেরের পক্ষে অধিকাংশ এমপি, কোণঠাসা রওশন
জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ - ফাইল ছবি
বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে জাপায় বিদ্রোহের সুর

সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে ঝামেলা ছাড়ছেই না তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। গত ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর মাত্র একদিন পর জাপা চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে শুরু হয় এ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। ১৬ জুলাই হঠাৎ করেই একটি সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা ঘোষণা করেন- আজ থেকে পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের)। তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নন। মূলতঃ রাঙার এ ঘোষণার পর থেকেই দলটির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু। 

এরপর ২২ জুলাই রাতে এরশাদের স্ত্রী জাপার কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও দলটির কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ আরও কয়েক নেতা জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান মানতে অস্বীকার করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন। 

জাপা সূত্র জানায়, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব মেটাতে বা আপস করতে গত ২০ জুলাই গুলশানে রওশনের বাসায় যান তার দেবর জিএম কাদের। তিনি জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালনে রওশনের সহযোগিতার পাশাপাশি আশীর্বাদও কামনা করেন। জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভাবী তাকে আশীর্বাদ করে দিয়েছেন! কিন্তু রওশন এরশাদ সূত্রে জানা যায়, রওশন তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, কেউ আমার বাসায় এলে তাকে কি আমি ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দেব। আর সবচেয়ে বড় কথা জিএম কাদের আমারও পরিবারের একজন সদস্য। তাই তিনি আমার বাসায় আসতেই পারেন। সেখানে রাজনীতির কোনো বিষয় জড়িত থাকতে পারে না।

এদিকে, সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের মৃত্যুর মাত্র একমাস ২০ দিনের মাথায় জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে আবারও নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিদ্রোহ এখন তুঙ্গে। এই সঙ্গে দেখা দিয়েছে দল ভাঙার আশঙ্কা। বিশেষ করে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকালে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা বানানোর জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকার বরারব চিঠি দেয়ার পর নড়েচড়ে বসেছেন বর্তমানে জাপায় কোণঠাসা রওশনপন্থীরা। অবস্থার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার গুলশানের নিজ বাসায় বেলা ১১টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন রওশন। অপরদিকে স্পিকার বরাবর জিএম কাদেরের দেয়া চিঠি গঠনতন্ত্র সম্মত নয় বলে বুধবার বিকালে স্পিকার বরাবর পাল্টা চিঠি দিয়েছেন রওশন এরশাদ। স্পিকার বরাবর রওশনের চিঠি পৌছে দেন রওশনপন্থী বলে পরিচিত ফখরুল ইমাম।

এর আগে, জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মানতে অস্বীকার করে রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা জাপার গঠনতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ (২) এর ‘খ’ ধারায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে জিএম কাদেরকে অবহিত করা হয়। এতে আরও বলা হয়, জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের যেভাবে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন তা পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ (২) এর ‘ক’ ধারার বরখেলাপ।

মঙ্গলবার জিএম কাদেরের পক্ষে জাতীয় পার্টির ১৫ জন এমপি স্বাক্ষরিত চিঠিটি স্পিকারের দপ্তরে পৌছেন দেন কাজী ফিরোজ রশীদ। এসময় জাপার সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নাজমা আকতার, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল ও আদেলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। চিঠিতে তারা ছাড়াও স্বাক্ষর করেছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অধ্যাপিকা মাসুদা রশিদ চৌধুরী, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী, গোলাম কিবরিয়া টিপু, নুরুল ইসলাম তালুকদার, সালমা ইসলাম ও পনির উদ্দিন আহমেদ। 

স্পিকারের কাছে জিএম কাদেরের চিঠির খবর রওশন এরশাদের কাছে পৌঁছার পর তিনি দলীয় এমপিদের সন্ধ্যায় নিজ বাসায় আসতে বললে মঙ্গলবার মাত্র ৪ জন হাজির হন। বুধবার দুপুরেও নিজ অনুসারীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন রওশন। সেখানে ৪ জন এমপি উপস্থিত ছিলেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। 

বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, পার্টি সংসদীয় কোনো সভা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। ম্যাডাম (রওশন) আগামী ৮ সেপ্টেম্বর সংসদে আমাদের সংসদীয় দলের সভা ডেকেছেন। সেখানেই আমরা বিরোধী দলের নেতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। 

এদিকে, রওশনপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় উজ্জবিত জিএম কাদেরপন্থীরা। বিশেষ করে মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দফা অনেককে ফোন করেও কাছে পাননি রওশন এরশাদ। এ মুহূর্তে তার সঙ্গী হয়েছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবুল হক চুন্নু ও ফখরুল ইমাম। 

জাপা সূত্রে জানা যায়, নতুন করে জাপায় নেতৃত্ব নিয়ে পারিবারিক বিভেদে অস্থিরতায় ভুগছে পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচএম এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই পার্টিতে দেবর-ভাবীর দ্বন্দ্ব অনেকটাই স্পষ্ট। এরমধ্যে একাধিকবার রওশন ও জিএম কাদের রওশনের গুলশানের বাসভবনে একান্তে কথা বলেন। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই নতুন ইস্যুতে আবার তাদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হতে থাকে। জিএম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলে এর বিরোধিতা করেন রওশন। আসন্ন সংসদ অধিবেশনেই বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার কথা। এর আগেই পার্টির অধিকাংশ এমপি জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিলে চরম নাখোশ হন রওশন এরশাদসহ তার পন্থী এমপিরা। এরশাদের মৃত্যুর পর নাটকীয়ভাবে জাপায় রওশনপন্থীদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। তারপরও যেকোনো কিছুর বিনিময়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা মানতে নারাজ রওশন। বিরোধী দলের নেতা পদ নিয়ে আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দেবর-ভাবী। 

এ বিষয়ে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, পার্টির সকল নেতাকর্মীরাই চান পার্টির পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতা হোক জিএম কাদের। তার সঙ্গে পার্টির তৃণমূলের যে সম্পর্ক রয়েছে তাতে তিনি বিরোধী দলের নেতা হলে দল উপকৃত হবে।

পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য এটিইউ তাজ রহমান বলেন, পার্টিতে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা বিভেদ কাম্য নয়। যত দ্রুত সম্ভব তা মিটিয়ে ফেলা উচিত। এতে পার্টি, পার্টির নেতাকর্মী ও দেশ উপকৃত হবে।

রওশনপন্থী জাপার বেশ কয়েকজন নেতা দৈনিক জাগরণকে বলেন, এইচএম এরশাদ এদেশের ৯ বছরের শাসক ছিলেন। তিনি এদেশের জনগণ ও উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। এরপরও বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও পরবর্তী সরকার তাকে কারাগারে নেয়। জাপার যখন শোচনীয় অবস্থা তখন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ রাজপথে পল্লীবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেছেন। পুলিশ তাকে গুলিও করেছে। তখন জিএম কাদেররা তো রাজনীতিতেই আসেননি। এমনকী ভাইয়ের মুক্তির জন্য কোনোদিন রাজপথেও নামেননি। এখন হঠাৎ করেই পার্টির চেয়ারম্যানসহ বিরোধীদলীয় নেতার পদ দাবি করলেই নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারে না।
 
জাপার উদ্ভূত বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন প্রশ্নে জোর করে কিছু করা হয়নি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্পিকারের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। 

দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক না করায় বিতর্ক উঠেছে এমন প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, চেয়ারম্যান এরশাদ যখন বেঁচে ছিলেন তিনিও কিন্তু এভাবে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন, আমাকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করেছিলেন। পরে আমাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে উপনেতা করা হয়, তখনও কিন্তু পার্লামেন্টারি পার্টির কোনো মিটিং করা হয়নি। 

জিএম কাদের আরও বলেন, আমরা ফোনে সংসদ সদস্যদের মতামত জানতে চেয়েছি। তারা সম্মতি দিয়েছে। লিখিত দিতে বলা হলে ১৫ জন সম্মতিপত্র দিয়েছে। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সম্মতি দিলে আর কিছু লাগে না। তাই অন্যদেরকে বলা হয়নি। এখন আরও অনেকে দিতে চাচ্ছে। প্রয়োজন নেই বলেই নেয়া হচ্ছে না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, অন্য কেউ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা ডাকতে পারে না। ডাকতে হলে আমিই ডাকব।

টিএস/ এফসি

আরও পড়ুন