• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯, ১২:২০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯, ১২:২৭ পিএম

বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন, উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অভিভাবকরা

বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন, উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অভিভাবকরা

 

  • সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বাড়ছে নারী ও শিশু হত্যা
  • রেহাই পাচ্ছে না ছেলে শিশুরাও
  • আগস্টে সারাদেশে ১৬৯টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা

 

দেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে শিশু ও নারী নির্যাতন। চলতি বছর নারী নির্যাতনের যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল, সেটি হল ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা। মার্চের ২৭ তারিখে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিল নিহত নুসরাতের পরিবার। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে সারাদেশে ১৬৯টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩ জনকে গণধর্ষণ, ৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ২৭ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া শ্লীলতাহানি করা হয়েছে ৭ জনকে এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন।

সূত্রমতে, আগস্টে ৪ জন অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে একজন দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ মাসে ৯ নারী ও শিশুকে অপহরণ এবং ৪১ নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।

যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮ নারী, যার মধ্যে ৫ জনকেই হত্যা করা হয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬ নারী ও শিশু। উত্ত্যক্ত করার ঘটনা আলোচিত ছিল ১১টি। আত্মহত্যা করেছে ৩০ জন। এর মধ্যে ৫ জনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার তথ্য পাওয়া গেছে এবং ১৭ জনের মৃত্যুর ঘটনাই রহস্যজনক।

এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৩৪ জন। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে শিশুরা প্রতিবেশী, উত্ত্যক্তকারী, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে উত্ত্যক্তকারী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১০ জন আর প্রতিবেশী দ্বারা ১০২ জন। গণধর্ষণের শিকার ৩৭ জন, শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭ জন। এছাড়া গত বছর ৫৩ জন শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই আহত হয়েছে।

এসব ঘটনার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর অন্যতম ফেনীর সোনাগাজীর শিক্ষকের হাতে লাঞ্ছিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনা। এর প্রতিবাদে বিচার দাবি করে থানায় মামলা করেন নুসরাতের অভিভাবক। এরপর নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে নুসরাত ও তার পরিবারকে মামলা  তুলে নিতে বলা হয়। এ ঘটনার জের ধরে ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার ভেতরের পরীক্ষার হল থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা। এতে তার শরীরের শতকরা ৮০ ভাগ পুড়ে যায়। পরে ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যু হয়।

নিহত নুসরাত জাহান রাফি

এর আগে, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে নুসরাত সোনাগাজী থানায় গেলে থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেন। ওই ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে পরে অনেক নাটকীয়তার পর ওসি মোয়জ্জেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে এবং ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মধ্যবাগ্যা গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব এক নারী নিজের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হন।

জানা যায়, ভোটের সময় নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়। এরপর রাতে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা সমর্থকসহ বাড়িতে গিয়ে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে তাকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। এরপর চলতি বছরের ১ মার্চ নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার চর মাকসুমুল গ্রামে একই রকম অপর একটি ঘটনা ঘটে। সেখানেও ভোটের জেরে এক গৃহবধূকে দলবেঁধেধর্ষণ করা হয়।

পরদিন সেই গৃহবধূ বিষপানে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনাতেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।

এদিকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও। গত ২ আগস্ট যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসার পথে ৩ সন্তানের মা এক নারীকে (৩০) আটক করে খুলনা জিআরপি থানা পুলিশ। পরিবারের সদস্যরা জানায়, মোবাইল চুরির অভিযোগ দিয়ে ওই নারীকে আটক করা হয়। পরে রাতে থানার হাজতে ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্য তাকে মারধর ও ধর্ষণ করে। পর দিন তাকে ৫ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

গত ২৬ আগস্ট যশোরের শার্শা উপজেলার গোড়পাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খায়রুলসহ সোর্সের বিরুদ্ধে আসামির স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে।

গত ৬ জুলাই রাজধানীর ওয়ারীর একটি বাসা থেকে সামিয়া আক্তার সায়মাকে নামে ৭ বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয় যাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ওইদিন মাগরিবের নামাজের সময় শিশুটি নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নির্মাণাধীন ভবনের অষ্টমতলার একটি কক্ষ থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।

নিহত শিশু সামিয়া আক্তার সায়মা

শুধু নারী ও মেয়ে শিশুরাই নয়, ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছেলে শিশুরাও। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানি বাজারে ৭ বছরের শিশু এমরান হোসেনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গত ২২ আগস্ট রাতে এমরানকে ধরে নিয়ে পরিত্যক্ত একচালা টিনের ঘরে নিয়ে চারজন মিলে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে শিশুটির গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর তার মরদেহ মাছের ঝুড়িতে পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় ভরে ওই ঘরে লুকিয়ে রাখে। ২৫ আগস্ট রাতে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

চলতি বছর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নারী নির্যাতনের এই ধারা আশঙ্কাজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বাড়ছে নারী ও শিশু হত্যা। তাদের মতে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নারী এবং শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। 

নারী-শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছেন তা যেমন সত্য, তেমনি নির্যাতন পিছু ছাড়ছে না, তাও সত্য। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতি, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, ধনতান্ত্রিক সমাজের অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্যাতন বাড়ছে।

আমরাই পারি জোটের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল মনে করেন, নারী নির্যাতনের মূল কারণ সমাজ ও পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থা। অনেক মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নেও নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার সঙ্গে আপস করছেন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ) আইনসহ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে। তবে আইন ও অন্যান্য উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যা যা করা দরকার, তা সেভাবে হচ্ছে না।

এইচএম/একেএস