• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৯:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৯:৪২ পিএম

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় বেশি ৬ কারণে

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় বেশি ৬ কারণে
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’-এর কম্পিউটার গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’-এর নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ নতুন দেশ। তাই ভারতের তুলনায় রূপপুরে ব্যয় কিছুটা বেশি।

রুমিন ফারহানার প্রশ্ন ছিল— রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ডলার। একই ধরনের প্রকল্প ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলাম। সেখানে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের খরচ ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ রূপপুরে মূলধন ব্যয় বেশি হচ্ছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যয়ের কারণ কী?

জবাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, দেশজ জ্বালানি সম্পদের সীমাবদ্ধতা, আমদানিকৃত জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ২ নভেম্বর  ২০১১ তারিখ স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় প্রতিটি ১২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনাধীন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য রাশান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট-এর সঙ্গে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি জেনারেল কন্ট্রাক্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উপর নির্ভরশীল: 

1. Project Site and Site Location
2. Type of Reactor Technology
3. Project managerment approach and Contractual Obligation of the contract
4. Fund and Financing Scheme of the Project
5. National Infrastructure to support NPP
6. Licensing and Legal Aspects

প্রতিটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নকালে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো ক্ষেত্রবিশেষ ভিন্নতর হওয়ার কারণে একটি 
প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় অপরটির সঙ্গে সরাসরি তুলনা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, কোনো একটি দেশে এ ধরনের প্রকল্প প্রথমবারের 
মতো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের তুলনায় তা অনেকাংশ দুরূহ সাধ্য।

মন্ত্রী বলেন, ভারতের তামিলনাড়ুর কুদুনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইট, সাইটের ভৌগলিক, ভূতাত্ত্বিক, জিওটেকনিক, সিসমিক এবং পরিবেশগত বিষয়াদি বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর সাইটের থেকে ভিন্নতর। রূপপুর 
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবহাওয়া এবং পরিবেশগত বিষয়াদি কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে অধিকতর উন্নত পদ্ধতিতে স্টাডি করা হয়েছে। এ ছাড়াও, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এলাকার ‘সয়েল কন্ডিশন’ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় ভাঙনরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানের মাধ্যমে Shore Protection এর কাজ করা হয়েছে এবং বন্যা প্রতিরোধের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানসহ প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় উচ্চতায় মাটি ভরাট করতে হয়েছে। ভারতের তামিলনাড়ুর কুদুনকুলামের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানের প্রয়োজন পড়েনি।

ইয়াফেস ওসমান বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রযুক্তি এক হলেও এ দুটি কেন্দ্রের ডিজাইনগত পার্থক্য রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন AES-2006 এবং কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন AES-92। একটি ডিজাইন থেকে অন্য একটি ডিজাইনে উন্নীত করার ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল প্যারামিটার, ইকোনমিক প্যারামিটার এবং সেফটি প্যারামিটারসমূহ অধিকতর উন্নত করতে হয়। এ সকল কাজ অনেক শ্রম ও ব্যয়সাপেক্ষ। কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রযুক্তি থার্ড জেনারেশনের। অন্যদিকে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তি থার্ড প্লাস জেনারেশনের।

মন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন ১২০০ মেগাওয়াট এবং কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা ১০০০ মেগাওয়াট। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আর্থিক, কারিগরি ও পারমাণবিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক অগ্রসর।
 
ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন দেশ। অন্যদিকে, ভারত গত ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। ফলে তাদের জাতীয় অবকাঠামো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কারণে তাদের অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় অনেকাংশে কম। যেখানে নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ভারতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি। ভারতে বর্তমানে ২২টির মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র  চালু রয়েছে। ৬টি নির্মাণাধীন এবং আরও ২০টিরও বেশি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারত সরকার অনুমোদন দিয়েছে। 

মন্ত্রী আরও বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে রাশান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে একটি সাধারণ কন্ট্রাক্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন, ইকুপমেন্ট সাপ্লাই, কমিশনিং পর্যায় ফাইনাল টেকওভার পর্যন্ত যাবতীয় কারিগরি সহায়তা, ১৪০০ জনেরও অধিক জনবলের প্রশিক্ষণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য ২০২৩ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবারহের দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট-এর। সর্বোপরি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যাবতীয় নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবে। অন্যদিকে, কুদনকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের এনপিসিআইএল প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভারতের কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য শুধু মাত্র লাইসেন্সধারী অপারেটর (আনুমানিক ১০০ জন) এবং কতিপয় কোর জনবলের প্রশিক্ষণ রাশান ফেডারেশন হতে করা হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স এবং অথরাইজেশন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হতে গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দলিলাদি প্রণয়ন ও কার্যাদি সম্পাদনের দায়বন্ধতা রয়েছে রাশান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। 

মন্ত্রী বলেন, কুদনকুলাম পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নির্মাণ কার্যাদি পরিচালনা জনবল প্রশিক্ষণ লাইসেন্সিং ব্যবস্থপনা কার্যাদিতে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্মাণ ব্যয় অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওয়তায় একটি ফুল স্কেল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ফায়ার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভারি মালামাল উঠানো-নামানোর জন্য লোডিং-আনলোডিং সুবিধার জন্য পদ্মা নদীতে জেটি নির্মাণের কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সব বিবেচনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় যৌক্তিক এবং সমসাময়িক কালে রাশান ফেডারেশন কর্তৃক মিসর, হাঙ্গেরি, উজবেকিস্তান প্রভৃতি দেশে অনুরূপ প্রযুক্তিতে বাস্তবায়নাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের নির্মাণ ব্যয় থেকে তুলনামূলকভাবে কম।

এইচএস/ এফসি

আরও পড়ুন