• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯, ১০:০২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯, ১২:১৫ পিএম

ক্রীড়াঙ্গনে ক্যাসিনো ক্যান্সার!

ক্রীড়াঙ্গনে ক্যাসিনো ক্যান্সার!
ক্যাসিনো সামগ্রী

এক সময় প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া শিশুরাও আবাহনী-মোহামেডান বা বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের নামে বিভক্ত ছিল। তবে সেই বিভক্তি বিরোধের নয়, ছিল সুস্থ প্রতিযোগিতার। বড়রা তো বটেই ছোট্ট শিশুটিও জানতো তার সমবয়সী আরেকটি শিশু কোন ক্রীড়া সংগঠনের সমর্থক। যার যার পছন্দের সংগঠনের নামে নিজেরা বিভক্ত হয়ে খেলায় প্রতিযোগীতা করতো বিদ্যালয়ের মাঠে বা গ্রামীণ পথে-প্রান্তরে। নিজেদের আলাপচারিতা বা কথা কাটাকাটিতেও থাকতো নিজ পছন্দের দলের শ্রেষ্ঠত্ব দাবির পক্ষে যুক্তি।

কেবল শিশুরাই নয়, কৈশোর পেরিয়ে কর্মজীবনে পৌঁছানো যুবকরাও শামিল হতো সেসব খেলায় বা যুক্তিতর্কে। হাল আমলের মতো জঙ্গীবাদ বা নেশার জগতে মেশার ফুরসত ছিল না তাদের। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরেই তাদের ব্যস্ততা ছিল। যে ক্রীড়াঙ্গন তাদের নেশার জগত থেকে আগলে রাখতো, কখন ও কিভাবে যে সেই ক্রীড়ার মূলটিই আক্রান্ত হয়েছে নেশায় কেউ টেরই পায়নি। একদিকে মাদকের নেশা, আর অন্যদিকে জুয়ার নেশায় আজ ক্রীড়া ক্লাবগুলো ক্যান্সারাক্রান্ত।

গত কয়েকদিনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাসিনো অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এক কথায় বলা যায়, ক্যাসিনো ক্যান্সারাক্রান্ত ক্রীড়াঙ্গন! সমাজ বিজ্ঞানী ও ক্রীড়াঙ্গণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অধপতন একদিনে হয়নি। আগে রাজধানীসহ সারা দেশে ক্রীড়া ক্লাবগুলো চালাতেন ক্রীড়া সংগঠকরা। সেসব ক্রীড়া সংগঠনকে কেন্দ্র করেই পাড়া-মহল্লা বা প্রত্যন্ত গ্রাম থাকতো ক্রীড়ামুখর। ক্রীড়া সংগঠনগুলোর এমন ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতে সেখানে ঘেঁষতে থাকে পুঁজিবাদীরা। তারা সংগঠনগুলোর আর্থিক টানাপোড়েনকে কাজে লাগায়। ক্রীড়া সংগঠকরা যেখানে ক্রীড়ার প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার থেকে ব্যক্তিগত বা
দলীয় ছোট-বড় ত্যাগের মাধ্যমে সংগঠনকে এগিয়ে নিতেন, পুঁজিবাদীরা সেখানে জুয়ার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে বরং তারা নিজেদের আর্থিকভাবে লাভবান করে তোলে। সংগঠনটি আগে ক্রীড়ার বিভিন্ন অঙ্গনে এগিয়ে যাওয়াকেই নিজেদের এগিয়ে যাওয়া ভাবতো। তারা এখন আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সংগঠনে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ঢোকায়। আর জুয়ার ব্যাপ্তি বাড়াতে বাড়াতে কবে যেন পতিত হয়েছে ক্যাসিনোতে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায়কে বেশ জটিল ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, পুঁজিপতিরা সংগঠনে ঢুকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করলেও তাতে ক্লাবের বা প্রকৃত খেলোয়াড়দের উন্নতি হয়নি। উন্নতি যা হবার তা হয়েছে কেবল সেই পুঁজিপতিদের। ক্লাবগুলো আর্থিকভাবে উন্নত না হলেও দিনে দিনে সুনাম খুইয়েছে। এক সময় ক্রীড়াসংগঠনের কর্ণধার হয়ে যে পুঁজিপতি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান সম্মানিত হতে এগিয়ে এসেছিল, আজ কোনো পুঁজিপতি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান কেন আসবে? কারণ এখনতো সেই সুখ্যাতি নেই, আছে কুখ্যাতি। আর এমন কুখ্যাত প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হতে কোনো প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকও আগ্রহ দেখাবেন কি না, সেই সন্দেহ আছে বলেও মত দেন তারা। তাছাড়া
ক্রীড়া ক্লাবগুলো যে চিত্র গত কয়েকদিনে উঠে এসেছে, তাতে সাধারণ সচেতন অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের এসব সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে দ্বিধান্বিত হবেন বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যার ফলে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরির পথও রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রীড়া ক্লাবগুলো একটা সময় ছিল শুধুই খেলাকেন্দ্রিক। আবাহনী, মোহামেডান, দিলকুশা, আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা, কলাবাগান, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারির মতো দলগুলো ঢাকার মাঠ কাঁপিয়েছে ফুটবল কিংবা হকি দিয়ে। সেই ঢেউ গিয়ে লাগতো পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে। এখন এই ক্লাবগুলোর বড় অংশেরই জুয়ার টাকায় জৌলুশ বেড়েছে, কিন্তু খেলোয়াড়দের সেই ক্লাবে ঠাঁই নেই। এ কারণে খেলাধুলার মান উন্নয়ন এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর ক্লাবগুলোর জুয়া/ক্যাসিনো পরিচালনাকারীরা কোটি কোটি টাকা বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করছে। অনৈতিক এ কাজ যাতে অবাধে চলে সেজন্য নির্ধারিত হারে চাঁদা পেতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ক্যাসিনো সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানতে চাইলে, জানিয়ে দেয়া হয় কোনো ধরণের ক্যাসিনো নেই। অথচ র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরে ক্যাসিনা ও অসামাজিক কার্যকলাপের রমরমা বাণিজ্য। অসামাজিক কার্যকলাপ সুরক্ষায় নিয়মিত পাহারাও দিতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য। তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। মোহামেডান ক্লাব ও ক্রিকেট বোর্ডের গ্রেফতারকৃত পরিচালক লোকমান হোসেন জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশে টাকা পাচার, ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ সিলগালা করে দেয়। তবে বিষয়টি এমন নয় যে ওই দিন কিংবা দিন কয়েক আগে প্রথম ক্যাসিনো চালু হয়েছে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায়। বিগত সরকারগুলোর আমলে এইসব ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চলে আসছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, খেলাসংশ্লিষ্ট লোকজন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একাধিক সূত্র বলেছে, ক্যাসিনোগুলো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেক লীগের ৩ জন শীর্ষ নেতা চালাতেন। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন এবং ক্লাবগুলোর কাজকর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না-এমনটাই মনে করে আসছিলেন সবাই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্লাবগুলোয় জুয়ার প্রচলন বরাবরই ছিল। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে হাউজি খেলা হতো। ওই টাকায় ক্লাবের দৈনন্দিন খরচা চলত। জুয়াটা রমরমা হয়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকে। ক্লাবগুলো তখন মাত্র মতিঝিল এলাকায় এসেছে। খেলাধুলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনুদানের টাকায় ক্লাবগুলো আর চলতে পারছিল না। তখনই একটি দুষ্ট চক্র ক্লাবে ঢুকে পড়ে। তারা ক্লাবের ঘর ভাড়া নিয়ে ওয়ানটেন (ছোট তীর ছুঁড়ে মারার খেলা) ও রামি (তাসের খেলা) নামের খেলা চালু করে। প্রতি রাতে ক্লাবগুলোকে এরা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিত। যারা জুয়ার আসর বসাত, তারা রাজনৈতিক নেতা, মহল্লার মাস্তান ও পুলিশকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিত। ক্লাবপাড়ায় এই দুটি খেলার টাকা নিয়ে হাঙ্গামার ঘটনা বাড়তে থাকে। আরামবাগ ওদিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে দুটি খুনেরও ঘটনা ঘটে। এরপর ওয়ান-টেন খেলা বন্ধ করা হয়। মূলত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্লাবগুলো জুয়ার জন্য ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে। প্রথম কয়েক বছর ওয়ান-টেন ও রামি চলতে থাকে। সাত-আট বছর আগে ক্লাবগুলো কলাবাগান ক্লাবের আদলেআন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়।

কলাবাগান ক্লাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথমে ক্লাবগুলোয় বাকারা (তাসের খেলা) নামের একটা খেলা হতো, পরে যুক্ত হয় রুলেট (চাকার মতো বোর্ড) এবং আরও কয়েকটি খেলা। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক নাজমুল করিম ওরফে টিঙ্কু। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। নাজমুল করিম মারা যাওয়ার পর বিএনপির এক সময়ের ক্যাডার শফিকুল আলম ফিরোজ ও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতা সেন্টু টাকা-পয়সা হস্তগত করায় মহল্লার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুরো ক্যাসিনোসহ অসামাজিক কার্যকলাপ দুই নেতার হাতে চলে যায়। তার দৈনিক ক্লাবের আয় এক কোটি টাকা।

ফুটবল খেলোয়াড় ও ক্লাব সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব,মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে। আগে হাউজির জন্য যেখানে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘর ভাড়া পেত ক্লাবগুলো। সেখানে প্রতি রাতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। তাই খেলার বদলে জুয়া মুখ্য হয়ে উঠেছে। ক্রমে তা  ক্যাসিনো হয়ে ক্যান্সারে রূপ নেয়।


এমএ/একেএস

আরও পড়ুন