• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০১৯, ০৯:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১৮, ২০১৯, ০৯:৪৮ পিএম

এক প্রিন্স মুসার কাছে সবাই কি পরাস্ত!

এক প্রিন্স মুসার কাছে সবাই কি পরাস্ত!
মুসা বিন শমসের

বি শে ষ  প্র তি বে দ ন

.................

মুসা বিন শমসের। দেশের বিত্তবানদের অন্যতম একজন। বিদেশে ‘বাংলাদেশের ধনকুবের’ হিসেবে পরিচিতি। চলেন বিলাসবহুল মার্সেডিস বেঞ্জ-রেঞ্জ রোভার মডেলের গাড়িতে। জুতা পরেন হীরকখচিত। স্যুটও স্বর্ণসুতাখচিত। গোসল করেন নির্জলা গোলাপজলে। দামি ঘড়ি আর আংটির সমারোহ তার হাতে। যেখানে যান তার সাথে থাকে নারীসহ ২৬ গানম্যানের বিশেষ প্রটোকল। সুইচ ব্যাংকসহ বিদেশের অসংখ্য ব্যাংকে রয়েছে তার অঢেল টাকা। দেশেও রয়েছে তার হাজারো কোটি টাকার সম্পদ। জাকজমকপূর্ণ জীবন-যাপন এবং চলাফেরার জন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যম তাকে দিয়েছে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ উপাধি। এর পর থেকেই তিনি প্রিন্স মুসা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে দেশের মানুষের কাছে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী। কারও কারও কাছে রহস্যময় মানুষও বটে।  

ফরিদপুর শহরের সাধারণ একটি পরিবার থেকে রহস্যময়ভাবে ধনকুবের হয়ে ওঠা প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। ৫১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, বৈধ-অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, মানব পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন, কর ও শুল্ক ফাঁকি, সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখার অস্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতা-বিরোধী অপরাধের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে ওয়ান ইলেভেনের পর ২০১১ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে ওঠা অনেক অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। কখনও শুরুতে, কখনও মাঝপথে আবার কখনও শেষে এসে অদৃশ্য ইশারায় এ সব তদন্ত আটকে যায়। প্রতিবেদন শুধুই হাওয়ায় ঘুরপাক খায়। 

মাত্র তিন দশকে বদলে যাওয়া ‘রহস্যময় প্রিন্স মুসা’ কিভাবে এতো অর্থ-সম্পদের মালিক হলেন, তা সবারই অজানা। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কাছেও নেই সঠিক তথ্য। বিভিন্ন সময়ে তার এসব অর্থ-সম্পদের সঠিক তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে, কখনও তলব করা হয়েছে, দুদক-শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু উদঘাটিত হয়নি রহস্য। অর্থ-সম্পদতো নয়ই, অস্ত্র ব্যবসারও তথ্য দিতে অপারগতা জানিয়েছেন বাবা বার তিনি। নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এক প্রিন্স মুসার কাছে সবাই কি পরাস্ত? 

অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দীর্ঘ সময়ক্ষেপন এবং অনেক নাটকীয়তার পর ১৭ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় আনা বিক্রয়-নিষিদ্ধ গাড়ি নিবন্ধন করে ব্যবহারের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়েছে।

দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী দুদকের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। 

দুদকের এ মামলায় প্রিন্স মুসা ছাড়াও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির, বিআরটিএ ভোলা জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনছারী (বর্তমানে ঝালকাঠিতে কর্মরত), গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অটো ডিফাইন ও ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক ওয়াহিদুর রহমান এবং মুসা বিন শমসেরের শ্যালক ফারুকুজ্জামানকে আসামি করা হয়েছে।

২০১০ সালের ১২ মার্চ বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার মডেলের গাড়িটি কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় বাংলাদেশে আনেন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ প্রিন্স মুসার ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে গাড়িটি উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দারা।

প্রিন্স মুসার ‘অস্বাভাবিক’ সন্দেহ করে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেছিলো দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে ‘রহস্যমানব’ হিসেবে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব ২০১১ সালে তলব করেছিলো। দুদকের চাহিদা অনুযায়ী এ তলব করা হয়। পরে তাকে দুদকে দুই দফা তলব করা হলেও রহস্যজনক কারণে এর কোনও অগ্রগতি হয়নি। দাখিল হয়নি কোন প্রতিবেদনও।

দু’বছর (২০১৭ সালে) আগে শুল্ক ফাঁকি ও সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখার অস্বচ্ছ হিসাব দাখিলের অভিযোগে কাকরাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কার্যালয়ে প্রিন্স মুসাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ বছরের ৩১ জুলাই গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তার বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জাকির হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলাটির তদন্ত শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে এখনও প্রতিবেদন দাখিল হয়নি।

প্রিন্স মুসাকে প্রায় পাঁচ বছর আগে (১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪) দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থার উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। ওইদিন দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন সুইস ব্যাংকে তার ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা) আটকে আছে। এ বিপুল পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা নয় বলেও দাবি করেন তিনি।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রিন্স মুসা তার অস্ত্র ব্যবসার কোনও তথ্যই দুদকে দেননি। ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই তথ্য দিতে চাননি তিনি। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র ব্যবসার বিষয়ে সব প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে গেছেন তিনি।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ফরিদপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও তার বিচারের দাবি জানান। তৎকালীন সময়ে জামায়াত নেতা আবদুর কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তে ফরিদপুরে যাওয়া প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছেও মুসার বিষয়ে বলা হয়েছিল। প্রিন্স মুসার যুদ্ধাপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানালেও তাদের কথা আমলেই নেয়া হয়নি। উল্টো ‘চেপে’ যেতেও বলা হয়। প্রিন্স মুসার যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দিতে ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা তৈরি আছেন বলে জানালেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলছে এখনও ‘পর্যাপ্ত প্রমাণ’ তারা পাননি।

এতোসব অভিযোগের বিষয়ে প্রিন্স মুসা পুত্র ববি হাজ্জাজ শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমার বাবার (প্রিন্স মুসা) বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগের কথা বলছেন বা বলা হচ্ছে, তা মোটেই সত্য নয়। আমার বাবা যুদ্ধাপরাধীতো নয়ই বরং মুক্তিযদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। অর্থ পাচার করেননি। বিদেশে আয় করার অর্থ আছে বিদেশে। গাড়ি ক্রয়ে একটু সমস্য হয়েছিলো এটুকুই।

আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী প্রিন্স মুসা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই।

এমএএম/এসএমএম

আরও পড়ুন