• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:১৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:১৫ এএম

গুজব ঠেকাতে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা চান বিশিষ্টজনেরা

গুজব ঠেকাতে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা চান বিশিষ্টজনেরা

বিমানে করে পেঁয়াজ আনায় দাম কমেছে বা লবণের গুজব বেশি ছড়াতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্টদের আত্মতুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, যে সিন্ডিকেট গত কয়েকদিনে গুজব ছড়িয়ে পেঁয়াজ ও লবণের বাজার অস্থিতিশীল করেছিল বলে সরকার থেকেই বলা হচ্ছিল, সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা উচিত। অতিদ্রুত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যথায় অতিমুনাফার লোভে গুজব ছড়িয়ে তারা আবারও এই সুযোগ নিতে চাইবে। বিশেষ করে রমজানকে সামনে রেখে বারবার এই অপতৎপরতা চালাতে পারে তারা।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, যখন মজুদদারি করে বাজার অস্থিতিশীল করা হয়, তখন সরকার থেকে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। আবার সমস্যার আপাতত সমাধান হয়ে গেলে সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই তারা আবার গুজব রটিয়ে ফায়দা লুটে। ফলে ‘আপাতত’ সমাধান হলেও ‘স্থায়ী’ সমাধান হচ্ছে না।

শুধু বাজার ব্যবস্থা নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ নানা ধরনের সমস্যাই সৃষ্টি হচ্ছে গুজব থেকে। যা থেকে ব্যবসায়ীরা যেমন সুবিধা নিচ্ছে, তেমনি সুবিধা নিচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও। তাই গুজবের পেছনে না ছুটতে অব্যাহত জনসচেতনতা তৈরি ও গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার ওপরও গুরুত্ব দেন তারা।

অতীত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, ‘পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে ‘রাজনৈতিক গুজব’ রটানোর পরিপ্রেক্ষিতে আসলো ‘ছেলেধরা’ গুজব। যার ফলে সারাদেশে একটা সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় রাজধানীর বাড্ডায় এক মাকে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। ধর্মীয় গুজবের প্রসঙ্গে তারা বলেন, সম্প্রতি ভোলায় নবীকে অবমাননা করা হয়েছে বলে একজন হিন্দু লোকের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয়। কয়েক বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। যার ফলে ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল।

তারা বলছেন, গুজবের এসব ঘটনার কোনটির পরই গুজব রটনাকরীদের বিরূদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাছাড়া আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা সত্যাসত্য বিবেচনা না করে খুব সহজেই গুজবে কান দেয় এবং তাৎক্ষণিক প্রভাবিত হয়। বিশিষ্টজনরা বলছেন, দিনে দিনে লবণের দামবৃদ্ধির গুজব নিয়ন্ত্রণ করা গেছে এটি যেমন সত্য তেমনি এটিও সত্য যে, এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই ৩৫ টাকার লবণের দাম চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়ে প্রায় দেড়শ টাকা হয়ে গিয়েছিল। তাই কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই মানুষ যে গুজবে প্রভাবিত হয় সে বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।

মানুষ সহজেই গুজবে গা ভাসানোর এসব বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সরোজ কুমার দাশ দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘আমাদের দেশে সুবিধাবাদী মানুষ, অতিমুনাফা লোভী ও নোংরা রাজনীতির মানুষরা সিন্ডিকেট করে গুজব ছড়ায়। কারণ এখানকার মানুষ খুব সহজে গুজবে কান দেয় এবং প্রভাবিত হয়, বিচলিত হয়। তাই ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জন বা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তারা খুব সহজে গুজব ছড়ায়। সে জন্যে জনসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। তাছাড়া আইনের প্রয়োগেরও বিকল্প নেই।’

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইন কতটা কঠোর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইনের প্রয়োগ। আইনের প্রয়োগই যদি না থাকে, তাহলে কঠোর আইন করেও লাভ নেই। আর আইনের প্রয়োগ থাকলে অপরাধীরা দৃষ্টান্তটি মনে রাখবে। তাতে অপরাধ নিয়ন্ত্রিত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজে যাদের শিক্ষিত-সচেতন ভাবা হয়, তারাও গুজবে বা এ ধরণের ফাঁদে পা দেন। উদারহরণ দিয়ে তারা বলেন, সম্প্রতি রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সব বাসা-বাড়ি থেকে সুয়ারেজ লাইনে প্রচুর পরিমাণে হারপিক বা কীটনাশক ঢেলে দেয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্রচারণা চালানো হয়েছিল। সমাজের প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষকেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে লক্ষ্য করা গেছে। যদিও পরবর্তীতে তা হারপিক বা এ ধরণের পণ্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক কাটতি বাড়ানোর জন্য করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল। তবে এসব বিষয় পরে আর তদন্ত করা হয়নি বা সাধারণ মানুষকে এর সত্যাসত্য আর জানানো হয়নি। ফলে মানুষ অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিতেও পারেনি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কিছু লিখলে তা মুহূর্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হোয়াটস অ্যাপে কিছু লিখলে বা দিলে তা পাঁচজনের বেশি লোকের কাছে যাবে না। আমাদের দেশে কিন্তু সেসব কিছু নেই। এটা সহজেই করা যায়। সামাজিক যোগাযোগের এসব মাধ্যমের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বসেই তা নির্ধারণ করে দিতে পারেন।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশ গুজব রটানোর জন্য একটি উর্বর জায়গা। তাই এখানকার প্রতিকার ব্যবস্থাটাও তেমন হওয়া উচিত।

জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, শুধু গণমাধ্যমে নয়, সামাজিকভাবেও, যেমন স্কুল কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুজব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও জুমার খুতবায় এসব বিষয় বলতে হবে, তাহলে সর্বোতোভাবে গুজব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি সচেতনতা বৃদ্ধিতে সব কাজ একই ছাতার নিচ থেকে করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

এসব গুজব শুধু দেশ থেকে নয়, বিদেশ থেকেও ছড়ানো হয়। আবার আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্যও করা হয় বলে মনে করছেন অনেকেই। তারা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সাম্প্রতিক নির্যাতনের সময় অন্যদেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের নির্যাতনের ছবি আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়, রাজনৈতিক অপতৎপরতা থেকে।

এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিদেশে বসে গুজব বা অপতৎপরতা চালালে এর বিরূদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে আইনের প্রয়োগ আছে কি না। আইনের প্রয়োগ করতে হবে এবং তা করতে হবে অতিদ্রুত ও তাৎক্ষণিক। যাতে সমাজে একটা স্পষ্ট বার্তা যায় যে, গুজব ছড়ালে বা এসব করলে এই শাস্তি হয়।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ লবণ নিয়ে গুজব ছড়ালেও সরকার তাৎক্ষণিক প্রেসনোট দিয়ে মানুষকে স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছে যে, লবণের সংকটের বিষয়টি গুজব। একইভাবে আইন প্রয়োগ করে ও শাস্তি নিশ্চিত করেও স্বচ্ছ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, লবণের ঘাটতি আছে বলে গুজব ছড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টনের বেশি ভোজ্য লবণ মজুত আছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লবণচাষিদের কাছে ৪ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন এবং বিভিন্ন লবণ মিলের গুদামে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে। লবণ বিপণনকারী কোম্পানিগুলোও বলেছে, লবণের কোনো ঘাটতি নেই।

তথ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো এক প্রেস নোটে বলা হয়- একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশে গুজব ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি দেশে লবণ নিয়েও গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে যে দেশে লবণের পর্যাপ্ত মজুত আছে। ডিসেম্বর মাসেই দেশে নতুন লবণ উৎপাদিত হয়ে বাজারে আসবে। বর্তমান মজুতের সঙ্গে যোগ হবে নতুন উৎপাদিত লবণ। ফলে দেশে লবণের কোনো সংকট নেই বা এমন কোনো আশঙ্কাও নেই।

স্বস্তির কথা লবণের গুজব রাতেই স্তিমিত হতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়ানোর জন্য কয়েকজন ক্রেতাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু কারা গুজব ছড়ালেন, মন্ত্রীরা তা বলতে পারেননি। সরকারি প্রেস নোটেও তার ইঙ্গিত নেই। মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট খুঁজছেন। আমলারা সিন্ডিকেট খুঁজছেন। পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, মন্ত্রীরা বলছেন, সিন্ডিকেট করছে। লবণের দাম বাড়ছে, আমলারা বলছেন, সিন্ডিকেট করছে। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছেন, সরকার বলছে, সিন্ডিকেট করছে। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের চেহারা কেমন, চরিত্র কী, তা বলছেন না কেউ।

এমএ/একেএস

আরও পড়ুন