• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০, ০৯:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০, ১০:১১ পিএম

কচুরিপানায় হাসতে মানা 

আছেন বিজ্ঞ যত, ভাবুন মন্ত্রীর মত

আছেন বিজ্ঞ যত, ভাবুন মন্ত্রীর মত

মুখে প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে মন্ত্রী বললেন,কচুরিপানা কি খাওয়া যায় না? গরু খেতে পারলে আমরা কেন পারবো না? দেখুন না গবেষণা করে। কক্ষের ভেতরে উপস্থিত সকলে তা শুনলেন, শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এমনভাবে হাসলেন যেন রসিকতা ছলে বড্ড অবান্তর কোনো মন্তব্য করে তিনি নিজের জ্ঞান স্বল্পতা জাহির করেছেন। এরপর বাইরে ছড়াতে লাগলো তিরষ্কার আর তাচ্ছিল্যের হাসি।

মানুষকে গো-খাদ্য কচুরিপানা খেতে বলেছেন মন্ত্রী মহোদয়; এমন দাবির প্রেক্ষিতে কয়েকটি সংবামাধ্যমে সংবাদও প্রচারিত হলো- শিরোনামে মন্ত্রীর স্থান ঢাকা পড়লো কচুরিপানায়। শুরু হলো সমালোচনা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত ট্রল আর বক্তব্যের ভিডিও শেয়ার করে বিভিন্ন মন্তব্যে চলতে লাগলো মন্ত্রীর মুণ্ডূপাত। আর সরকার ও সরকার প্রধানকে বিজ্ঞ সমাজের নানা কথা।দিনমজুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, সুধি সমাজ থেকে বিজ্ঞ সমালোচক- প্রায় প্রত্যেকেই মন্ত্রী মহোদয়ের দায়িত্বজ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, বিদ্যা-বুদ্ধির জোড় এমনকি মন্ত্রীত্ব ধারণের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। শুধু একটি প্রশ্ন কেউ করলেন না! কেউ মন্ত্রীকে বা নিজেকে একটিবার জিজ্ঞেস করলেন না, 'এত কিছু থাকতে কেন তিনি সুনুর্দিষ্টভাবে কচুরিপানার কথাই বললেন?'

সোমবার দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি-২ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যে 'কচুরিপানা' নিয়ে মন্তব্য করায় সমালোচকদের বিষবাক্যে বিব্রত হতে হলো পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানকে, সেই একই কচুরিপানার কথা বলতে গিয়ে ২০১৬ সালে কট্টর সমালোচনার মুখে রীতিমত মান বাঁচাতে পদ ছেড়ে পালনোর উপক্রম হয়েছিল সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর। আর উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্ন ছিল অভিন্ন- 'কচুরিপানা কি মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়?' দ্য ব্যাংকক পোস্ট

কচুরিপানার কথা বলতে গিয়ে ২০১৬ সালে কট্টর সমালোচনার মুখে রীতিমত মান বাঁচাতে পদ ছেড়ে পালনোর উপক্রম হয়েছিল সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর। আর উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্ন ছিল অভিন্ন- 'কচুরিপানা কি মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়?'

বিশেষ কৌতুহল থেকে মন্ত্রীর বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপে চোখ রেখে প্রথমেই জানতে পারলাম তিনি কাউকে কচুরিপানা খাওয়ার পরামর্শ দেননি। কিন্তু তাই বলে তিনি গো-খাদ্য ভক্ষণের কথা বলবেন? কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের পিছু হাটতে হাটতে এক সময় যা দেখলাম তাতে মাথা তুলে নিজের মুখ দর্শনের শক্তিটুকুও যেন আমার আর অবশিষ্ট রইলো না! একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী বিজ্ঞ মন্ত্রীর আধুনিক মানসিকতা ও চিন্তাভাবনা আগামীর পথে যখন শত ক্রোশ এগিয়ে গেছে। আমরা তখনও অন্ধকারের বস্ত্রহরণে ব্যস্ত।

সাম্প্রতিক বিশ্ব জলবায়ু পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগেভাগেই জানান দিয়েছিলো যে অদূর ভবিষ্যতে চরম খাদ্য সংকটে পড়বে বিশ্ববাসী। সেই থেকে খাদ্য উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প নানা উৎসের অনুসন্ধান শুরু হয়। যার এক পর্যায়ে এমন বহু বিকল্প প্রাকৃতিক খাদ্য উৎসের খোঁজ পায় মানুষ যাদের কথা আগে কখনো ধারনাও করা যায়নি। নতুন এ সকল আদর্শ খাদ্য উৎসের একটি হিসেবে একেবারে ওপরের সারিতেই সেখানে চোখে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাশয়ে আজীবন ব্যাপক অবহেলা আর অনাদরে ভেসে বেড়ানো এই কচুরিপানার নাম! যার খাদ্যমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত আদর্শমান দ্বারা যাচাইকৃত। শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, গবেষণায় এই কচুরিপানার যে সকল সম্ভাবনার দিক প্রকাশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বিস্মিত বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেন 'দ্য মির‍্যাকল প্ল্যান্ট'।

সত্যিই তো! আধুনিক মানুষ কি মাত্র কয়েক বছর আগেও ভেবেছিলো যে সে কোনোদিন চড়ামূল্যে ভেষজ প্রোটিন সমৃদ্ধ 'ব্যাঙের ছাতা' (মাশরুম) অভিজাত খাদ্য হিসেবে কিনে খাবে?

এই গবেষণা কাজের দায়িত্বে থাকা জার্মানির বিজ্ঞানীরা জানান, কচুরিপানা ও তেঁতুলপানার মত জলজ আগাছা বা 'ডাকউইড' চাষ ও খাদ্য হিসেবে তা প্রচলনের লক্ষ্যে জোরালো কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ। আকারে ছোট, ছায়া পেলেই  জলাশয়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে৷পুকুর মালিক মাত্রই ঘৃণা করেন এদের আগাছা বলে৷আর সেই দ্রুত বংশবৃদ্ধিকারী কচুরিপানা গোত্রের ক্ষুদিপানা বা তেঁতুলপানাই আজ মানুষের জন্য উচ্চমাত্রার ভেষজ প্রোটিন সমৃদ্ধ আদর্শ খাদ্য! ইংরেজি ভাষায় তার পোশাকি নাম ডাকউইড। - টিবিএসনিউজ.নেট

জার্মানির বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্লাউস আপেনরোট খাদ্য হিসেবে এই উদ্ভিদের গুণাগুণ নিয়ে রীতিমত মুগ্ধ! তাঁর কাছে এই উদ্ভিদ যাকে বলে ‘মিব়্যাকল প্লান্ট’ – অর্থাৎ অসাধারণ গুণসম্পন্ন এক গাছ৷ তিনি জানালেন, ‘‘ডাকউইড গোত্রের সব উদ্ভিদই অবহেলিত৷অথচ মানুষের পুষ্টির ক্ষেত্রে এগুলো অভাবনীয় অবদান রাখতে চলেছে। যা হয়তো মানুষ কখনও কল্পনাও করেনি।' 

সত্যিই তো! আধুনিক মানুষ কি মাত্র কয়েক বছর আগেও ভেবেছিলো যে সে কোনোদিন চড়ামূল্যে ভেষজ প্রোটিন সমৃদ্ধ 'ব্যাঙের ছাতা' (মাশরুম) অভিজাত খাদ্য হিসেবে কিনে খাবে?

ক্লাউস আপেনরোট-এর কাছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ডাকউইড উদ্ভিদের সংগ্রহ রয়েছে৷ তাঁর গবেষণাগারে প্রায় ৫০০ পরিচিত প্রজাতির উদ্ভিদ বেড়ে উঠছে৷ সাধারণত সেগুলোর মধ্যে এক ধরনের ফাঁপা পাতা থাকে৷ ফলে সেই উদ্ভিদ পানির উপর ভাসতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘদিন কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করেন এবং কৃষকের জমিতে প্রয়োগ করে ব্যাপক ফলপ্রসূ হয়েছেন।

মাত্র এক দিনের মধ্যেই এর আকার দ্বিগুণ হতে পারে৷  ক্লাউস আপেনরোট এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছেন৷ তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘সব ডাকউইড প্রজাতির মধ্যে প্রোটিনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি, শুকনো অবস্থায় যা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ৷ কিন্তু তার মান আরও বিস্ময়ের কারণ৷ কারণ অ্যামিনো অ্যাসিডের মধ্যে উপাদানগুলির অনুপাত খুবই ভালো৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমনটা পরামর্শ দিয়ে থাকে৷”

ডাকউইড-এর মাধ্যমে ভারতের খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ক্লাউস আপেনরোট সে দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করছেন৷গবেষকরা প্রোটিন-সমৃদ্ধ নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে পরিকল্পিত প্রজননের মাধ্যমে ফ্যাটি অ্যাসিডের অনুপাতও বাড়াতে চান৷

থাইল্যান্ড ও লাওসে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে খাদ্য হিসেবে ডাকউইড কাজে লাগানো শুরু করে দিয়েছে৷ জার্মানিতে না হলেও ভারতে সারা বছর ধরেই খোলা আকাশের নীচে ডাকউইড চাষ করা সম্ভব৷

ক্লাউস বলেন, ‘‘এখানে (জার্মানি) একাধিক সমস্যা রয়েছে৷প্রথমত এখানে একটাই মৌসুম রয়েছে৷ অর্থাৎ মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আগস্টের শেষ, কখনো সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ডাকউইড চাষ করা সম্ভব হতে পারে৷ শীতকালে খোলা আকাশের নীচে তা চাষ করা সম্ভব নয়৷” জার্মানির কালকার শহরের দুই বিশেষজ্ঞ, এক পদার্থবিজ্ঞানী ও এক উদ্ভিদ প্রজননকারী গ্রিনহাউসে এই ডাকউইড উৎপাদন করতে এক অসাধারণ প্রকল্পে অংশ নিচ্ছেন৷

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘদিন কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করেন এবং কৃষকের জমিতে প্রয়োগ করে ব্যাপক ফলপ্রসূ হয়েছেন। তার গবেষণার কিছু বর্ণনা এখানে উল্লেখ করা হলো- কচুরিপানা হলো ভাসমান এমন একটি প্রাকৃতিক জলজ উদ্ভিদ যার উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল (আমাজন), এর ৭টি প্রজাতি রয়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় এটি খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে, এমনকি ৬ দিনেরও কম সময়ে সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। দ্রুত বংশবিস্তারের জন্য কচুরিপানার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।

এক্ষেত্রে কচুরিপানা ব্যবহারের বহুমুখী সম্ভাবনার কতিপয় বিশেষ দিকও উল্লেখিত হ্য। এর মাঝে রয়েছে — 

মার্কারি ও  লেডের মতো বিষাক্ত পদার্থ এরা শিকড়ের মাধ্যমে পানি থেকে শুষে নেয়।

কচুরিপানা অতিমাত্রার দূষণ ও বিষাক্ততা সহ্য করতে পারে।  তাই পানির বিষাক্ততা ও দূষণ কমাতে কচুরিপানার চাষ অত্যন্ত উপকারী।

কচুরিপানাকে শুকিয়ে মাল্চ হিসেবে ব্যবহার করে লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

কচুরিপানা মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভেষজ চিকিৎসার  ক্ষেত্রেও এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গবাদিপশুর খাদ্য ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য এটি চমৎকার একটি উৎস। ক্ষেত্রবিশেষে কচুরিপানা থেকে গোবরের চেয়েও বেশি বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়।

কচুরিপানা প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে বেশ ভালোভাবেই নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ করতে পারে। ফলে কচুরিপানা পচিয়ে জৈব সার তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করলে এসব উপাদান মাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ভারতের তামিলনাড়ুর গবেষক সেলভারাজ এক পরীক্ষায় প্রমাণ পেয়েছেন

সম্প্রতি ভার্মিকম্পোস্ট (কেচোঁ সার) তৈরিতে কচুরিপানা একটি উত্তম উপকরণ হিসেবে নানা  দেশে প্রমাণিত হয়েছে।

উন্নত মানের বস্ত্র উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে কচুরিপানার শেকড় থেকে সংগৃহিত আঁশ তন্তু হিসেবে উৎকৃষ্ট বলে প্রমাণিত হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রীর একটি মন্তব্য যথাযথভাবে যাচাই না করেই সে বিষয় নিয়ে যে পরিমাণ কচুরীপনা দিনভর চললো, তাতে ব্যাপক উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে চলমান কটুক্তি আর কটাক্ষের উদযাপন কি এরপরেও চলবে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা উপভোগের উদযাপন চলবে সেটাই নিয়ম।

তবে দেশের বিজ্ঞ সুধী ও সচেতন সমাজের সদস্যদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের প্রতিও বিনীত নিবেদন রইলো, যে যাই করুণ- দেশের স্বার্থে আজ থেকে - 'আছেন বিজ্ঞ যত, ভাবুন মন্ত্রীর মত। মন্ত্রী মহোদয়, আপনাকে ধন্যবাদ।

এসকে