• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২০, ০৬:৪২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১, ২০২০, ০৮:৩৯ এএম

কোভিড-১৯ আতঙ্ক

অপর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ

অপর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ

উন্নত বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ঠিক তখন বাংলাদেশের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনা সংক্রমণের দৈনন্দিন নূন্যতম পরিসংখ্যান স্বস্তির পরিবর্তে দ্বিধা আর উদ্বেগে ভরে তুলেছে দেশের কোটি নাগরিকের মন।

জনস্বার্থে করোনা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কর্তব্য পালনে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ 

কারণ প্রতিদিন আইইডিসিআর-এর বিবৃতিতে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশে দৈনিক করোনার নতুন আক্রান্ত রোগির যে সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে, কতজন মানুষের করোনা পরীক্ষার বিপরীতে তা পাওয়া যাচ্ছে সে নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলোনায় বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন নতুন করোনা আক্রান্ত রোগি শনাক্তকরণের সংখ্যা নিতান্তই কম। কিন্তু এই সুসংবাদটি দেশের মানুষের মাঝে স্বস্তি আনতে পারছে না। কারণ, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিষয়টি অতি অপ্রত্যাশিত। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, প্রতিদিন কয়জন ব্যক্তি করোনা পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাচ্ছেন। আর গড়ে কতজনের শরীরে করোনা টেস্ট করানোর পর দৈনিক নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সামনে আসছে?

বিগত কয়েকদিনের প্রাত্যহিক তথ্যেরভিত্তিতে যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করা যায় তাহলে দেখা যাক কোন বাস্তবতা আমাদের সামনে ওঠে আসে। আর তার প্রেক্ষিতে এই নূন্যতম নতুন করোনা আক্রান্তের দৈনিক পরিসংখ্যানে আসলেই আমাদের আনন্দিত হওয়ার কোনো সুযোগ রয়েছে নাকি আতঙ্কিত হওয়াই বাঞ্চনীয়।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর দিন থেকেই এ ব্যাপারে রুটিন সংবাদ বিবৃতির মাধ্যমে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা দেশের গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরছেন- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনা সংক্রমণের প্রাত্যহিক চিত্র।

বিশ্বব্যাপী  করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব- প্রতীকী ছবি

এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) করোনাভাইরাস নিয়ে অনলাইনে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এদিন দেশে মাত্র ২ জন নতুন করোনা আক্রান্ত রোগি শনাক্ত হয়েছেন। আর এই নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে মোট ৫১ জনের শরীরে। যার মধ্যে আগেই মারা গেছেন ৫ জন। আর নতুন ৬ জনসহ সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট ২৫ জন। কিন্তু এখানে থমকে গিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ থাকছে না, যখন জানা যাচ্ছে যে, গত ২৪ ঘণ্টায় সন্দেহভাজন হিসেবে নেয়া ১৪০টি নমুনার মধ্য থেকে সর্বশেষ এই ২ জনের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। যেখানে নিজেদের শারীরিক লক্ষণসহ নানা দিক বিবেচনায় করোনা শনাক্তকরণ টেস্ট ও যাবতীয় সহযোগিতা প্রাপ্তির হটলাইনে ফোন এসেছিল ৩ হাজার ৬৩৭ টি!

এদিকে সোমবার (৩০ মার্চ) করোনাভাইরাস নিয়ে অনলাইনে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে একজন নতুন করোনা আক্রান্ত রোগি শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানা যায়। যেখানে ১৫৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় বলে আইইডিসিআর নিশ্চিত করে। আর এদিনও হটলাইনে ছিল কলের উপচে পড়া ভিড়!

এর দু'দিন আগে ২৮ মার্চের কথা যদি বিবেচনায় আনা যায়, এদিন আইইডিসিআর-এর হটলাইনে সাহায্য প্রত্যাশিদের ৩৪৫০ কল আসে যার প্রত্যেকটি কলই করোনা সংক্রান্ত বলে জানান জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। তবে এদিন প্রায় এই সাড়ে ৩ হাজার কলের বিপরীতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৪২ জনের!

দৈনিক হটলাইন কলের অর্ধেকও যদি সন্দেহজনক কেস বিবেচনা করা যায় তাহলে বিগত এই কয়েকদিনের পরিসংখ্যান যাচাই করলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে, গড়ে কতটি কলের বিপরীতে কতজনের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর তা থেকে কয়জন করোনা আক্রান্ত নতুন রোগি শনাক্ত হচ্ছেন।

এত স্বল্পমাত্রায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে, যার হার শতকরা ১০ শতাংশও নয়, দেশে দৈনিক হাতেগোনা দু'একজন করোনা আক্রান্ত রোগি শনাক্ত হওয়ার সুসংবাদটি যৌক্তিক কারণেই তাই সাধারণ মানুষের কাছে উল্টো আতঙ্ক আর উৎকন্ঠার বিষয় হয়ে ওঠেছে।

শুধু তাই নয়। আইইডিসিআর-এর তথ্য মতে গত ২৫ মার্চ দেশে ৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগির মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য জানানো হয়। অথচ পরবর্তী ৬ দিনে অর্থাৎ ৩১ মার্চ অবদি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এমন প্রায় ১৫ জন বা তার অধিক লোকের মৃত্যুর তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যাদের প্রায় প্রত্যেকের মাঝেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ (জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশির মত করোনা সংক্রমণের লক্ষণ) ছিল বলে জানা গেছে। এই নিহতরা যে সকল ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন, সেই সকল সংশ্লিষ্ট সূত্রই এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। পরবর্তীতে সে সকল মৃত্যুর মূল কারণ উদঘাটন করা হয়নি বলে প্রশ্ন রয়ে গেছে সেখানেও।

গড় হিসেব বলছে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ ৬৮ দিনে বাংলাদেশে করোনা শনাক্তকরণের লক্ষে টেস্ট হয়েছে মাত্র এক হাজার ১৮৫ জনের নমুনা। শুরু তুলোনায় দিন দিন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই কম।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আইইডিসিআর কোভিড-১৯ রোগের মহামারি শুরুর পর থেকে গণমাধ্যমে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। কিন্তু সত্যটা হলো ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে ১০টি প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সক্ষমতা ছিল। তাহলে প্রথম থেকে তারা কেন করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে যে মানের ল্যাবরেটরি (পরীক্ষাগার) প্রয়োজন সে মানের ল্যাব বাংলাদেশে শুধু তাদেরই আছে বলে জানিয়েছে?

গত ২৬ মার্চ প্রথম প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেছেন, ঢাকার আইপিএই ও শিশু হাসপাতালে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যদি অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা না থাকে তাহলে এখন এসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা হবে কীভাবে?

তিনি বলেন, ‘শুধু আইইডিসিআরের ওপর নির্ভর না করে এই ল্যাবগুলোকে আরও দুই মাস আগে থেকে প্রস্তুত করা হলে এই দুরবস্থা হতো না। সাসপেক্টেড কেসগুলোকে পরীক্ষার আওতায় আনা হতো, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকতো। তাই কেবল তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী লক্ষণ থাক না থাক, কনট্যাক্ট ট্রেসিং করে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় যারা শনাক্ত হয়েছেন, তাদের সংস্পর্শে আসা চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর টেস্ট করতে হবে। একইসঙ্গে সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে তাদের মৃতদেহ থেকে নমুনা নিয়ে টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি। সারাদেশের এটিপিক্যাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের টেস্ট করতে হবে, নয়তো প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। বটম লাইন ইজ, টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট।’

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা- ছবি সংগৃহিত

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘যখন করোনা ক্রাইসিস শুরু হলো তখনই পরিকল্পনা করার দরকার ছিল। প্রস্তুতির বড় একটি ঘাটতি শুরু থেকেই ছিল, তার প্রভাব এখনও শুরু না হলেও আগামী কয়েকদিনে সেটা প্রকাশ পাবে। দেশের বাইরে থেকে আসা সব মানুষের পরীক্ষা যদি করা যেত তাহলে বোঝা যেত রোগটা।

এছাড়া বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সাদা চোখে’ এই নূন্যতম করোনা সংক্রমণের তথ্যকে ‘সুখবর’ বলে ধরে নিলেও বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। এমন মিরাকল কিছু ঘটেনি বাংলাদেশে। প্রথমদিকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা হতো কেবল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা (আইইডিসিআর) প্রতিষ্ঠানে। চলতি সপ্তাহে যোগ হয়েছে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যেখানে হাজার হাজার পরীক্ষা দরকার সেখানে যে পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে সে বিষয়টি ‘হাস্যকর’ বলেও মন্তব্য অনেকেরই।

তারা বলছেন, যে কোনো বিপর্যয় মোকাবিলায় তথ্যের ঘাটতি ভয়ঙ্কর জিনিস। এটা এমন অনেক কিছু বিশ্বাস করাবে যা ভিত্তিহীন আশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। এক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। অথচ পরবর্তীতে যদি এই সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটে সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে ভয়াবহ। বিশেষ করে যাদের ওপর এই সংকট নিরসনে মানুষের আস্থা, সেই আস্থা অনাস্থায় পরিনত হলে প্রেক্ষাপট কি হতে পারে তা বর্ণনা করার মত যথেষ্ট ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তারা মনে করেন, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকার করোনা মোকাবিলায় একের পর এক যথেষ্ট শক্তিশালী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং তার সাফল্য অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেগুলোর তৎপরতায় যদি অপর্যাপ্ততা থাকে আর তা অনাকাঙখিত কোনো বিশৃঙখলা সৃষ্টি করে- সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন করোনা প্রতিরোধে সরকারের এ যাবত অর্জিত সকল সাফল্য বিনষ্ট হবে তেমনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতি। তাই সবদিক বিবেচনায়, কাল মাত্র বিলম্ব না করে নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষে থেকে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার বাস্তবায়ন। তা হলো- টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট।

করোনার মত একটি মহামারী বিশ্বব্যাপী প্রলয় সৃষ্ট করছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রের পক্ষে এই মহাবিপর্যয় প্রতিরোধে সমন্বিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। তাই সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে বাস্তব সাফল্যে রুপান্তরিত করতে একযোগে কাজ করতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রকে। আর সেক্ষেত্রে সবার আগে যা নিশ্চিত করতে হবে তা হলো, কোনো পক্ষের কাজে যেন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি না হয়।

দেশের কোটি মানুষের স্বার্থে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রকে। বিগত এক যুগেরও কম সময়ে আমাদের যে অর্জন তা টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে প্রতিটি ঘরকে এবার করোনা প্রতিরোধক দুর্গে পরিণত করতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, আস্থা রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকা জাতির বর্তমান কাণ্ডারির ওপর।

এসকে