• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২০, ০১:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১, ২০২০, ০১:৫৪ পিএম

কেমন হবে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ

কেমন হবে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর গতি এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বাড়তে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আগেই সতর্ক করেছে। সামনের দুই সপ্তাহে দেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা।

দেশে এখনো পর্যন্ত এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রণে’ থাকলেও ভাইরাসটি (আক্রান্ত ৪৯, মারা গেছেন ৫ জন, সোমবার (৩০ মার্চ) পর্যন্ত) এপ্রিলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করছেন দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও।

এ সময়ের মধ্যে করোনা কোন পরিণতির দিকে গড়াতে পারে, এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো মূল্যায়ন এখনো সরকারি কোনো সংস্থা করেনি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা দুর্যোগের কালে দেশের জনগণের এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহ কেমন কাটবে-এ প্রশ্ন ও উদ্বেগ বিশেষজ্ঞদের।

অনেকে মনে করেন, দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার যে দুই সপ্তাহ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা আগামী ৯ এপ্রিল শেষ হবে। এ সময় পর্যন্ত দেশে ভাইরাসটির ‘পিকটাইম’ বিবেচনা করে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় সরকার।

দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণ কোন পর্যায়ে ছড়াবে, তা ৯ এপ্রিলের মধ্যে প্রকাশ্যে আসতে পারে বলে তাদের ধারণা। সেই অনুযায়ী সরকার রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার আওতা বাড়ালে, আপাতত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারি ছুটি নির্ধারণ করলে, সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টাইনের বিষয়ে প্রশাসন কঠোর এবং জনগণ সচেতন থাকলে ওই সময়ের মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়ে তারা আশাবাদী।

গবেষণাভিত্তিক কোনো প্রতিবেদন না থাকায় তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯ এপ্রিলের পর ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে’ মনে করে ঢিলেমি শুরু করলে করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।

এপ্রিলে কোনো কারণে কোভিড-১৯ মহামারী আকারে দেশে ছড়িয়ে পড়লে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনো কৌশল খুঁজে বের করার কথা ভেবেছে বলেও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ভাইরাসটির গতিপ্রকৃতি আবহাওয়ার সঙ্গে আসলেই বদলায় কি না, দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে এর গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে-এসব বিষয়ে সরকারের নিজস্ব কোনো গবেষণাও নেই।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, চীন ও স্পেনের মতো দেশ, যেখানে করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়েছে, সেসব দেশে প্রথমে দুই থেকে তিনজনের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে দু-একজন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রতিবেশী ও স্বজন থেকে শুরু করে বিস্তার ঘটে। তখন একে কমিউনিটিতে সংক্রমণ বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ভাইরাসটির লক্ষণ ও উপসর্গ প্রকাশ পেতে ১৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। কারো কারো ক্ষেত্রে আরো আগেভাগে তা প্রকাশ পায়। সরকারের ‘রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ (আইইডিসিআর) গত বুধবার প্রথমবারের মতো জানায়, ঢাকায় সীমিত আকারে করোনার কম্যুনিটি সংক্রমণ হচ্ছে বলে তারা সন্দেহ করছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আগে থেকেই বলছেন, দেশে ভাইরাসটির কম্যুনিটিতে সংক্রমণ হচ্ছে। যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলেও করোনা কমিউনিটিতে সংক্রমিত হচ্ছে বলে মনে করেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশে করোনার পিকটাইম মনে করা হচ্ছে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ভাইরাসটির সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন পর্যায় পর্যন্ত যাবে, তা ওই সময়ের মধ্যে প্রকাশ্য হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যে রোগটির প্রতিরোধ ও সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের সতর্কতার অভাব হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘গত তিন দিনে দেশে মাত্র একজন করোনার রোগী শনাক্ত হওয়া বা সোমবারের আগের দুদিন কোনো রোগী না পাওয়ায় স্বস্তির কিছু নেই। কারো শরীরে রোগটির সংক্রমণ হলো কি না, এ বিষয়ে দেশে পরীক্ষার পরিধি সীমিত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করে যদি বলা হতো, আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায়নি, তাহলে স্বস্তি পাওয়া যেত।’

মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই মাহবুব এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুদিন পর একজন করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার মধ্যে স্বস্তি খুঁজতে গেলে তা হবে অজ্ঞতার শামিল। করোনা পরীক্ষার নিয়ে দেশে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা চলছে। সবাই পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটি প্রতিরোধের মূলমন্ত্র পরীক্ষা। করোনা প্রতিরোধে রোগী না পেলেও স্বস্তিতে না থেকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এপ্রিল মাসের প্রায় ১০ তারিখ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে অধিদপ্তর। এরপর প্রতিরোধমূলক কোন ধরনের  কার্যক্রম নেবে, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির এখনো পর্যন্ত তেমন পরিকল্পনা নেই।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ‘বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অধিদপ্তর মনে করে, গরম আবহাওয়া ও আদ্রতার কারণে দেশে করোনা রোগের প্রচণ্ডতা দেখা দেবে না।’ এ ধারণার ওপর অধিদপ্তর নির্ভর করে কি না বা সামনের দিনগুলোতে কার্যক্রম নিতে নির্ভর করবে না কি না, এমন প্রশ্নও আছে।

দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ও আর্ন্তজাতিক গবেষণা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, উষ্ণ তাপমাত্রায় করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকার তথ্যটির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ভাইরাসটি ছড়ালেও এর প্রকোপ শীতপ্রধান দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রতিদিন যেখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা খুব বেশি বাড়ছে, সেখানে উষ্ণ ঋতুর দেশগুলোতে দুটিই তুলনায় বেশ কম।

অবশ্য ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির’ (এমআইটি) গবেষক কাশিম বুখারিসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করে এবং আবহাওয়ার দুটি মানদণ্ড তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে বলেছেন, ‘উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের রাশ টেনে ধরতে পারে। এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম রয়েছে, সে দেশগুলোয় এ ভাইরাস হয়তো কিছুটা কম ছড়াতে পারে।’

সোমবার (৩০ মার্চ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের গবেষণার ফল প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। তাদের গবেষণা সত্য হলে এপ্রিলে দেশে তাপমাত্রা বাড়বার সঙ্গে করোনাও কাবু হতে পারে বলে ধারণা করেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।

তবে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর গত শনিবার জানান, ‘করোনা ভাইরাস মারা যায় বা টিকতে পারে না ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এমনকি ৬৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও এর শতভাগ মৃত্যু নিশ্চিত হয় না বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। গরম আবহাওয়ায় ভাইরাসটির সংক্রমণ দেশে থেমে যাবে বলে যেসব আলোচনা ও তর্ক চলছে, সেগুলো ঠিক নয়।’

এ ছাড়া গত ২৩ মার্চ সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করলে মানুষের ঢাকা ছাড়ায় ‘রেকর্ড’ সৃষ্টি হয়। ‘ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার’ (এনটিএমসি) সূত্র বলছে, ছুটি ঘোষণার পর ১ কোটি ১০ লাখ মুঠোফোন ব্যবহারকারী ঢাকা ছেড়েছেন। ফোন ব্যবহারকারীর সঙ্গে তাদের শিশুসন্তান বা যাদের ফোন নেই, তাদের সংখ্যা যুক্ত করলে এ সংখ্যা অনেক বেশি হবে। এতো মানুষ ছুটি কাটাতে গ্রামে যাওয়ায় গ্রামগুলোও এখন করোনা ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল মুঠোফোনে বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি ছুটির মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়তে পারে। প্রথমে আরো সাত দিন এই ছুটি বাড়তে পারে। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। আজ মঙ্গলবার ছুটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’

এসকে