• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২০, ০৪:০৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০, ০৩:০১ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-৩১

মেজর মঞ্জুর ও জিয়া হত্যার পূর্বাপর— তিন

মেজর মঞ্জুর ও জিয়া হত্যার পূর্বাপর— তিন

জিয়া হত্যা এবং চট্টগ্রাম বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস এখনও রচিত হয়নি। ইতিহাসের নামে এখন যা চলছে তা সরকার পরিবেশিত তথ্যের ওপর নির্ভর করে লেখা। সরকারি শ্বেতপত্রে এই বিদ্রোহ এবং জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর হত্যার যে কাহিনি উল্লেখ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে এগুলো কিছুটা সত্য, কিছুটা বানানো গল্প। সরকারি শ্বেতপত্র এং বেসরকারি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, জিয়া হত্যার পর চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সত্য ইতিহাস চাপা দেবার জন্য ওই সময় ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত সরকারি একটি গোষ্ঠী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করে। জেনারেল মঞ্জুরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তার জবানবন্দি থেকে এই বিদ্রোহ এবং জিয়া হত্যাকাণ্ড বিষয়ে এমন সব তথ্য বের হতো যা ওই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতো।চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বিচার বিভাগীর তদন্ত এবং জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার বিচার হলে দেখা যেতো, এই দুই হত্যাকাণ্ড আসলে একই দুষ্টচক্রের চক্রান্তের ফল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জিয়াকে হত্যা করার পর ক্যাণ্টনমেণ্টে ফেরার পথে মেজর মোজাফফর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলছিলেন, “আমি জানতাম না আমরা প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলতে চাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম আমরা শুধু তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।”

‘‘মঞ্জুরের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উড়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে যা হবার হয়ে গেছে, তাই বলে এখন তো আর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকা চলবে না।  শিগগিরই আমাদের পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। মঞ্জুর হঠাৎ আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গাড়ি নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লেন। ক্যাণ্টনমেণ্টের অন্যসব অফিসারকে খবরটা দিতে হবে, বলতে হবে সেনাবাহিনীর অফিসাররা এ কাজ করে ফেলেছে, এ ব্যাপারে আমরা আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না’’

........‘’........

এদিকে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর চিন্তায় ছিলেন। সারারাত তার চোখে ঘুম আসেনি। তার ‘অনুগতরা’ সার্কিট হাউসে গেছে। জেনারেল জিয়াকে ‘তুলে’ আনতে। কি ঘটেছে সেখানে, কে জানে? রাতভর তার মনে  নানা ধরনের ভাবনা চলছে।

রাত তখন ৪টা ৪৫ মিনিট। বাইরে গাড়ির শব্দ। মঞ্জুর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। হ্যাঁ, তাদেরই গাড়ি। ওরা তাহলে সার্কিট হাউস থেকে ফিরলো।

কিন্তু জিয়া? জিয়া কোথায়? তাকে তো সার্কিট হাউস থেকে তুলে আনার কথা। একটা চিন্তার ঢেউ খেলে যাচ্ছে মঞ্জুরের মাথার ভেতরে।

এমন সময় লে. কর্নেল মতিউর তাকে স্যালুট করে কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, “অপারেশন সাকসেসফুল, প্রেসিডেন্ট জিয়া ইজ কিলড।”

কিলড!

হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেলেন মঞ্জুর।

জিয়া নিহত?

তাকে তো হত্যা করতে বলেননি তিনি। বলেছিলেন তুলে আনতে। শেষ পর্যন্ত তাকে ওরা মেরে ফেলল!  মঞ্জুরের মুখমণ্ডল  বিবর্ণ  হয়ে গেলো।

মতিউর বুঝল সব। বললো উপায় ছিল না স্যার। নইলে আমাদের জীবনই বিপণ্ণ হতো।

মঞ্জুরের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উড়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে যা হবার হয়ে গেছে, তাই বলে এখন তো আর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকা চলবে না।  শিগগিরই আমাদের পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। মঞ্জুর হঠাৎ আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গাড়ি নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লেন। ক্যাণ্টনমেণ্টের অন্যসব অফিসারকে খবরটা দিতে হবে, বলতে হবে সেনাবাহিনীর অফিসাররা এ কাজ করে ফেলেছে, এ ব্যাপারে আমরা আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না। কেননা ওরা তো আমাদেরই ছেলে। মঞ্জুরের গাড়ি এসে পৌঁছল তার নিজেরই অফিসে, ২৪ নম্বর ডিভিশনের কেন্দ্রীয় দফতরে। সেনাবাহিনীর অফিসাররা সেখানে এসে হাজির সকাল ৬ টার ভেতরেই।

এলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এস এম এম হান্নান শাহ, ৬৯ নং ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মহসীনউদ্দিন আহমদ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম, ৬৫ নং ইনফ্যানটি ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার কর্নেল আবদুর রশিদ,  আর্টিলারি সেন্টারের কমান্ডার কর্নেল এস এম এ হাসান, ৩২ নং  ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়নের সিও লে. কর্নেল আতাউর রহমান, ১৮ নং ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের সিও লে. কর্নেল শফিকুর রহমান, জিএসও-১ লে. কর্নেল শাফাৎ আহমদ এবং ১২ নম্বর ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির সিও লে. কর্নেল এস এ জোয়ার্দার।

এসব অফিসের ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাহবুব, দিলওয়ার, মতিউর ও মোজাফফর হোসেন।

মঞ্জুর জানান, ‘‘আমাদের একদল তরুণ অফিসার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। আমি নিজেও তাদের পেছনে ছিলাম। দেশের প্রশাসন দুর্নীতিতে ভরে গেছে। তা ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর ভেতরে প্রবেশ করছে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সতর্ক করা হয়েছিল। তিনি তা শোনেননি। কাজেই তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল।’’

মঞ্জুর বলেন, “দেশ শাসনের জন্য একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়েছে। এই পরিষদ দেশকে দুর্নীতির কলুষমুক্ত করবে। এ কাজে আপনারা আমায় সাহায্য করবেন। বিপ্লবী পরিষদের প্রতি অনুগত থাকবেন।”  

উপস্থিত সবাই মঞ্জুরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

৩০ মে, সকাল বেলা। আরও কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক ও পুলিশ অফিসার জিওসির অফিসে আসেন। তারাও বিপ্লবী পরিষদের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং মঞ্জুরকে সমর্থন করবেন বলে শপথ নেন। তারা হলেন— চট্টগ্রামের কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমেদ, ডেপুটি কমিশনার জিয়া উদ্দিন এম চৌধুরী, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এ বি এম বদিউজ্জামান, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ‘বেস’ কমান্ডার গ্রুপ ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর এর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আজাদ।

এরপর মঞ্জুর রেডিও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি জিয়া হত্যার পটভূমি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “অভাবনীয় দুর্নীতির ফলে দেশে প্রতিটি জিনিসের দাম জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের মানুষ খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাবে দারুণভাবে ধুঁকছে।...জিয়া সরকার বিদেশি সংস্কৃতি আমদানিতে ব্যাপারে মদত দিয়েছেন। জুয়া খেলা, মদ্যপান ও লজ্জাজনক নাইট ক্লাবের ব্যবস্থা করেছেন। ফলে যুব সমাজ স্বাভাবিক সুস্থ সমাজ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এজন্য দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পুরনো মন্ত্রিসভার অর্ধেক সদস্য রাজাকার। তারা উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আসন কলুষিত করেছে।”

বেলা ১১ টার দিকে চট্টগ্রাম রেডিও নিম্নলিখিত ঘোষণাটি প্রচার করে। ওই ঘোষণায় বলা হয়—

এক. দেশে বিপ্লব হয়েছে। দুই. সেনাবাহিনীর  সদস্যদের নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়েছে। তিন. এই পরিষদই দেশ শাসনের কাজ হাতে নিয়েছে। চার. সামরিক আইন মোতাবেক তারা শাসনকার্য পরিচালনা করবে। পাঁচ. সংবিধান স্থগিত রাখা হয়েছে। ছয়. জাতীয় সংসদ বাতিল। সাত. সমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। আট. জিয়ার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত। নয়. গ্রাম সরকার ভেঙে দেয়া হলো। দশ. মদ্যপান ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধ।

এরপর মেজর জেনারেল মঞ্জুর সামরিক বাহিনীর বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মীর শওকত আলী ও মেজর জেনারেল মইনুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

তিনি বলেন, টেলিফোন লাইন ঠিক হলে তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। কিন্তু এই দুই জেনারেলের কেউই চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই মঞ্জুরের কথায় তারা কোনও সাড়া দেননি। মঞ্জুর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও ঢাকার ৪৬নং ইনফ্যানট্রি বিগ্রেড, কুমিল্লার ৩৩ নং ইনফ্যানট্রি ডিভিশন, যশোরের ৫৫ নং ইনফ্যানট্রি ডিভিশন ও বাংলাদেশ রাইফেলসের সহযোগিতা চান। বলেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’ এসব ক্ষেত্রেও মঞ্জুর কোনও সাড়া পাননি, তাকে নিরাশ হতে হয়। জেনারেল মঞ্জুরের বিশ্বাস ছিল, তার নাম শুনে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের পক্ষে শামিল হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও অঙ্ক কষতে ভুল করেছিলেন মঞ্জুর।

একাত্তর থেকে একাশি সাল। ব্যবধানটা ১০ বছরের। এরই মধ্যে পাক-মার্কিন চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। ক্ষমতায় বসিয়েছে তাদের তাবেদার সরকার। কালনাগিনীর বিষাক্ত ফণা তুলে ফের রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। সরকার ও প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে তখন তারাই ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে জেনারেল জিয়া অভ্যুত্থান দমনের নামে নির্বিচারে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনীতে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে পাকিস্তান ফেরত সেনা অফিসাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের মনে যে আবেগ ছিল, স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব দেবার আবেগ, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার সময় সেই আবেগ প্রায় অন্তর্হিত। দশ বছরে তারা ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব করতে শিখেছে। সোনার বাংলা গঠনের বদলে তাদের অনেকেই তখন নিজেদের আখের গোছানোর স্বপ্ন দেখছে। তাই মঞ্জুরের ডাকে কারও সাড়া মেলেনি। ফলে মঞ্জুর দেশের অন্য অংশের সমর্থনের আশা ছাড়লেন এবং চট্টগ্রামের দাঁড়িয়েই আসন্ন গৃহযুদ্ধ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিলেন।

চট্টগ্রামে জিয়া হত্যার খবর যখন ঢাকায় এসে পৌঁছল তখন ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। প্রেসিডেন্টের এডিসি ক্যাপ্টেন মাজহারুল হক টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমান চৌধুরীকে জানান, প্রেসিডেন্ট জিয়া নেই। রাতে তিনি একদল তরুণ অফিসারের হাতে নিহত হয়েছেন।

চমকে উঠলেন সাদেকুর রহমান। বললেন, তুমি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান সদস্য লে. কর্নেল মাহফুজের সঙ্গে কথা বলো। মাহফুজ বঙ্গভবনের অন্য একটি ঘরে ছিল। তাকে ডেকে আনতেই টেলিফোন লাইন কেটে গেল। প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব সঙ্গে সঙ্গে খবরটা দিল চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল নূরুদ্দিনকে। নূরুদ্দিন এই সংবাদ জানান সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে। সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় দফতর সতর্ক হলো। শুরু হয়ে গেলো  জেনারেল এরশাদের তৎপরতা।

সকাল ৬ টা ২০ মিনিট। জেনারেল এরশাদ চার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে ডাকলেন তার অফিসে। ডাকলেন অন্যান্য সিনিয়র অফিসারকেও। তিনি দেশের অন্য ক্যাণ্টনমেণ্টগুলোর খবর নিলেন। সেগুলোর অবস্থা কেমন? কোথাও কোনও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে কিনা?

‘‘শনিবার ৩০ মে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন,  “দুষ্কৃতকারীদের ছোট্ট একটি দল প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। ওরা এখন বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা বলছে। কিন্তু ওদের পক্ষে ক’জন আছে?  চট্টগ্রামেরও তো বেশিরভাগ সৈন্যই সরকারের পক্ষে।” চট্টগ্রামের সেনা সদস্যদের উদ্দেশে এরশাদ বললেন, “সরকারের প্রতি অনুগত আমার সৈনিক ভাইয়েরা,  আপনারা চট্টগ্রামের পথ ধরে শোভাপুর সেতুর এপারে চলে আসুন’’

........‘’........

না! কোথাও কোনও উত্তেজনা নেই, সব শান্ত, সব নিরুত্তাপ। তবুও চট্টগ্রামের সঙ্গে যেসব সেনা অফিসার যোগাযোগ করতে পারে বলে এরশাদ সন্দেহ করলেন তাদের ওপর তিনি কড়া নজর রাখলেন। এই অবস্থায় অনেকেই ধারণা ছিল জেনারেল এরশাদ ও ঢাকা ক্যাণ্টনমেন্টের সেনা অফিসাররা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে নেবেন। কিন্তু এরশাদ সে পথে হাঁটলেন না। এক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতাকে এককভাবে ‍কুক্ষিগত করতে একটু ধৈর্য ধরলেন এবং কৌশলের আশ্রয় নিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, দেশে সাংবিধানিক শাসন অক্ষুণ্ণ থাকবে। তিনি বুঝেছিলেন ক্ষমতা যদি এভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় তাহলে দেশে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। তাই তিনি সাংবিধানিক শাসনের পক্ষে মত দেন। ফলে বিভিন্ন ক্যাণ্টনমেণ্ট সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। এমনকি চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টের যেসব অফিসার ও সাধারণ সৈনিক প্রথমদিকে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন তারাও ধীরে ধীরে তাকে বর্জন করা শুরু করে।

এখন প্রশ্ন জিয়ার পরে কে হবে প্রেসিডেন্ট? এ প্রশ্নের জবাব পেতে বিলম্ব হলো না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পড়েই আছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট বা উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী তারই প্রেসিডেন্টের শূন্য আসন পূরণ করার কথা। তবে তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার পক্ষে কি সম্ভব প্রেসিডেন্টের গুরু-দায়িত্ব বহন করা?

জেনারেল এরশাদ বললেন, নিশ্চয়ই সম্ভব। তাই তিনি নিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের কাছে গেলেন, তাকে বোঝালেন। বললেন, এই দুর্দিনে দেশের স্বার্থে আপনাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। সাত্তার বললেন,  আমি অত্যন্ত অসুস্থ। এ অবস্থায় এত বড় দায়িত্ব আমি কি করে নেব?

এরশাদের  কৌশলী জবাব, “ভয় নেই। আমরা তো আপনার পাশে আছি। আপনি যা বলবেন, সে মতোই কাজ হবে। আর সে কাজ তো আমরাই করবো।”  কথাগুলো বলে জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাত্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফলে রাজি হওয়া ছাড়া বিচারপতি সাত্তারের সামনে আর কোনও পথ খোলা রইলো না।

জেনারেল এরশাদ তাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে এসে উপস্থিত হলেন। প্রধান বিচারপতি তাকে পাঠ করালেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের শপথ বাক্য। এরপরে নতুন প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে বললেন, “এই মুহূর্তে দেশে চাই শান্তি। জনগণের মধ্যে চাই নিয়মানুবর্তিতা। চাই জ্বলন্ত দেশপ্রেম।”

তিনি বললেন, “মন্ত্রিসভা, প্রতিটি সরকারি দফতর স্বাভাবিকভাবেই কাজ চলছে।”

তিনি জানালেন, “প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের সম্মানে আগামী ৪০ দিন জাতীয় শোক হিসেবে পালিত হবে।”  

তিনি বললেন, “তার সরকার সব আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি মান্য করে চলবে।”

কিছুক্ষণ পরেই মন্ত্রিসভার বৈঠক বসল। বৈঠকে দেশে সামরিক আইন জারির কথা উঠেছিল। কিন্তু  মন্ত্রিসভা সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত হলো সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হবে। আর অন্যদিকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার তিন বাহিনীর প্রধানদের কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।  

এদিকে দুপুরের দিকে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের ফোন এলো সেনাবাহিনী সদর দফতরে। তিনি প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে কথা বললেন। মীর শওকত ফোন ধরলেন।  মঞ্জুর তাকে বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা বললেন। জানালেন এই পরিষদের হাতেই এখন দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ভার। বিপ্লবী পরিষদ সম্পর্কে তিনি মীর শওকতকে আরও অনেক কথা জানালেন। বললেন, যদি যুদ্ধ না চাও তাহলে চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিও না।

শনিবার ৩০ মে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন,  “দুষ্কৃতকারীদের ছোট্ট একটি দল প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। ওরা এখন বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা বলছে। কিন্তু ওদের পক্ষে ক’জন আছে?  চট্টগ্রামেরও তো বেশিরভাগ সৈন্যই সরকারের পক্ষে।” চট্টগ্রামের সেনা সদস্যদের উদ্দেশে এরশাদ বললেন, “সরকারের প্রতি অনুগত আমার সৈনিক ভাইয়েরা,  আপনারা চট্টগ্রামের পথ ধরে শোভাপুর সেতুর এপারে চলে আসুন।  আপনাদের ভয় নেই। আগামীকাল অর্থাৎ ৩১ মে রবিবার দুপুরের মধ্যে যারা এপারে আসবেন, কথা দিচ্ছি সরকার তাদের ক্ষমা করবেন। আর মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তার অনুগতদের উদ্দেশে এরশাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন— “হয়তো বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করুন, নয়তো চরম ব্যবস্থার মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হন।”

৩১ মে, রবিবার। জেনারেল এরশাদ বিদ্রোহীদের প্রতি আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করলেন। তিনি মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তার অনুগতদের কাছে চরমপত্র দিলেন। বললেন, “বিকাল সাড়ে ৪টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আপনাদের ওপর বোমা বর্ষণ করবে।” কিন্তু ওই সময় পেরিয়ে যাবার আগেই চট্টগ্রামে শুরু হলো ঝড়, সঙ্গে প্রচণ্ড বৃষ্টি। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরও বিমানবাহিনী তাই বিদ্রোহীদের ওপর আঘাত হানতে পারলো না।

জেনারেল এরশাদ আবার আত্মসমর্পণের সময়সীমা বাড়িয়ে দিলেন। শেষসীমা নির্দিষ্ট হলো ১ জুন সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। তিনি চট্টগ্রামে তার অনুগত সৈনিক ও অফিসারদের বললেন, “আপনারা বিদ্রোহী সৈন্য অফিসারদের নিরস্ত্র করুন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করে নিন। সেখান থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান রিলে করা শুরু করুন।”

এদিকে ঢাকা থেকে সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ফেনী গিয়ে পৌঁছলো। প্রায় হাজার খানেক বিদ্রোহী সেনাসদস্য মঞ্জুরের শিবির থেকে সরকারি সৈন্যদের পক্ষে গিয়ে যোগ দিলো। মঞ্জুরের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় আঘাত। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বহু সৈন্য ধীরে ধীরে সরকারি দলে যোগ দিলো। যে চারটি ব্রিগেড মঞ্জুরকে সমর্থন করে আসছিল তাদের মধ্যে ১৫ নম্বর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল একটি। বান্দরবানে সামান্য সংঘর্ষের পর ওই ব্রিগেডের সৈন্যরা কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যান্য উঁচুতলার অফিসারদের গ্রেফতার করলো। ঠিক সেই সময় হেলিকপ্টার নিয়ে ব্রিগেডিয়ার হামিদ চট্টগ্রামে গিয়ে নামলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুর বুঝলেন, পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? পার্বত্য চট্টগ্রামে? যেখানে পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, সাময়িকভাবে সেখানে আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব। কিন্তু সেখানে যে তার পক্ষে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কেননা সেখানকার পার্বত্য উপজাতিরা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে। মঞ্জুর নিজেও তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছেন। এখন তারা যদি তাকে হাতে পায় তাহলে যে মঞ্জুরের মৃত্যু অনিবার্য। বিদ্রোহী উপজাতিরা নিশ্চয়ই এই সুযোগ নষ্ট করবে না।

‘‘জেনারেল এরশাদ আবার আত্মসমর্পণের সময়সীমা বাড়িয়ে দিলেন। শেষসীমা নির্দিষ্ট হলো ১ জুন সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। তিনি চট্টগ্রামে তার অনুগত সৈনিক ও অফিসারদের বললেন, “আপনারা বিদ্রোহী সৈন্য অফিসারদের নিরস্ত্র করুন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করে নিন। সেখান থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান রিলে করা শুরু করুন।”

........‘’........

চট্টগ্রামের দক্ষিণের সমুদ্র। সেই সমুদ্র পথে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু সে পথে যেতে হলে জাহাজ চাই। জাহাজ তো দূরের কথা মঞ্জুরের হাতে যে একখানি লঞ্চও নেই। বিমানের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। তাই অনেক ভেবেচিন্তে মঞ্জুর ঠিক করলেন তিনি ভারতেই যাবেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জালে তিনি আটকে গেছেন। বাংলাদেশ ধরা পড়লে কোনও রকম বিচারের আগেই তাকে হত্যা করা হবে। তাই তার ভারত যাওয়া উচিত। ভারতে গেলেও যে তিনি ধরা পড়বেন না তেমন কোনও কথা নেই। ভারতের পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর লোকরা নিশ্চয়ই তাকে গ্রেফতার করবে। বিনা অনুমতিতে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় আদালত তার বিচার করবে। ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে নিশ্চয়ই বাংলাদেশী ফেরত পাঠাবেন। তাতেও তার লাভ। কেননা এভাবে বাংলাদেশে ফিরলে তিনি বিচার পাবেন। সময় পাবেন। কেননা তখন সেনাবাহিনীতে তার শত্রুরা তাকে ধরে মেরে ফেলার সুযোগ পাবে না।

১ জুন, সোমবার, রাত তখন আড়াইটা। মঞ্জুর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বের হলেন। রওনা হবার আগে মেজর খালিদকে তিনি বললেন, তোমার ভাবীকেও তো সঙ্গে নিয়ে যাব? মেজর খালিদ আপত্তি করল। বলল, না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমরা যাচ্ছি। এ সময়ে নারী ও ছেলে-মেয়েরা সঙ্গে থাকলে অসুবিধা হওয়ার কথা।

কিন্তু স্ত্রীর জন্য মঞ্জুরের ছিল গভীর ভালোবাসা। তাই এই বিপদের দিনে তিনি তাকে পেছনে রেখে যেতে রাজি হলেন না। সুতরাং বেগম মঞ্জুর তার সঙ্গী হলেন। সঙ্গী হলো তার দুই পুত্র ও দুই কন্যা। বেগম মঞ্জুর বললেন, ‘‘বেগম দিলওয়ার হোসেন কি আমাদের সঙ্গে যাবেন? ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওকে ছেড়ে যেতে মন চায় না।’’ স্ত্রীর কথায় মঞ্জুর রাজি হলেন। কাজেই তাদের সঙ্গে বেগম দিলওয়ার হোসেনও চললেন। সঙ্গে তার তিন কন্যা। কর্নেল দিলওয়ার হোসেন এই দলে যোগ দেননি। চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেন্ট থেকে আরও দুটি দল বেরিয়েছিল। তিনটি দল গিয়ে মিললো হাটহাজারীতে। দলে তখন ১১ জন অফিসার ২ জন নারী ও ৭ জন বালক-বালিকা। এবার তাদের যাত্রা ফটিকছড়ির দিকে। গভীর রাত। ফাঁকা পথ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সেই পথেই এগিয়ে চলছে তিনটি  জিপ ও একটি সামরিক ভ্যান। প্রথম জিপে রয়েছে লে. কর্নেল মতিউর, লে. কর্নেল মাহবুব, মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মনির। দ্বিতীয় জিপে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে মেজর গিয়াস ও মেজর রেজা। ২ জন নারী ও ৭ জন বালক-বালিকা নিয়ে তৃতীয় জিপটি চালিয়ে নিচ্ছে মেজর খালিদ। ভ্যানে রয়েছে লে. কর্নেল ফজলে হোসেন ও ক্যাপ্টেন জামিল হক। এছাড়াও আছে আহত দু’জন অফিসার। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া হত্যার সময় তারা আহত হন। কিন্তু আহত এ দু’জন অফিসারের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কাজেই সহযাত্রীরা তাদের ফটিকছড়িতে রেখে যায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এনএসআই এর জনৈক অফিসার আবদুস সাত্তার তাদের গ্রেফতার করে।

জিপগুলো আবার ছোটে। ফটিকছড়ি থেকে সীমান্তের দিকে। এবার আরও দ্রুত গতিতে। এইভাবে দ্রুত ছুটতে গিয়ে লে. কর্নেল মতিউর ও লে. কর্নেল মাহবুবের জিপটি জেনারেল মঞ্জুর ও তার সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারা ভিন্নপথে মোড় নেয়। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য ওইপথে চলতে গিয়ে তারা মেজর মান্নানের ১২ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ানের সামনে গিয়ে পড়ে।

মেজর মান্নান চেঁচিয়ে বলে, “দাঁড়াও। কার গাড়ি?” মতিউর ও মাহবুব তাকে ফাঁকি দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। মেজর মান্নান গাড়ি থেকে নেমে আসে। সে ঢাকা বেতারের প্রচার শুনেছে। শুনেছে যে মঞ্জুর তার দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছে। এ দু’জন কি সেই দলের লোক? মেজর মান্নানের সন্দেহ হলো— সন্দেহ হওয়ায় ওদের দিকে এগিয়ে গেলো। বলল, “ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট”। মতিউর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু মেজর মান্নান পথ ছাড়তে নারাজ। হঠাৎ মতিউর একটা স্টেনগান তুলে মেজর মান্নানকে গুলি করল। কিন্তু কি আশ্চর্য! সেই গুলি মান্নানের গায়ে লাগলো না। লাগলো তার সঙ্গী নায়েক সুবেদার শামসুল আলমের গায়ে। শামসুল আলম সেখানেই মারা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারদেরও গুলি। সেগুলিতে মতিউর ও মাহাবুব ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। জিপ চালিয়ে নিচ্ছিল ক্যাপ্টেন মুনির। ইঞ্জিনিয়াররা তাকে গ্রেফতার করল। আর সেই ফাঁকে মেজর মোজাফফর ও তার সঙ্গীরা সেখান থেকে পালিয়ে গেল। (অনেকদিন পর্যন্ত মোজাফরের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় তিনি বিদেশে পালিয়ে যান এবং সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান)।

দূর থেকে জেনারেল মঞ্জুর সেই গুলির আওয়াজ শুনলেন। সেই আওয়াজ শুনেই তিনি গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে দিলেন। এবার গাড়ি চলল আবার উল্টো পথে, ফটিকছড়ির দিকে। ফটিকছড়ি থেকে গাড়ি তখন অল্প কয়েক মাইল দূরে। জেনারেল মঞ্জুর তার দলকে দু’টি ভাগে ভাগ করলেন। একটি দলকে অন্যপথে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি নিজে হেঁটে চললেন খামার উপজাতি এলাকার গ্রামের ভেতর দিয়ে। তার সঙ্গে রইলেন বেগম মঞ্জুর, বেগম দিলওয়ার হোসেন, তাদের পুত্র-কন্যা,  মেজর গিয়াস ও মেজর রেজা। তারা হাঁটছেন আর হাঁটছেন।

সকাল পেরিয়ে দুপুর এলো। চারিদিকে  তীব্র রোদ। তাদের গা পুড়ছে। মুখ পুড়ছে। ঘামে পোশাক ভিজে উঠেছে। তারা মাঝে মধ্যে থামেন। বিশ্রাম নেন। তৃষ্ণা মেটান ঠান্ডা জলে। রাস্তার নিশানা দেখানোর জন্য সঙ্গে আছে গাইড। মাঝে মধ্যে সে গাইডও বদল হয়। তারপর আবার চলা। চলা আর চলা। সবটাই পায়ে হাঁটা পথ। বেলা তখন আড়াইটা। তারা এসে পৌঁছলেন ‘এশিয়া চা বাগানে’। সবাই বড় ক্লান্ত পিপাসার্ত। এমন সময় মঞ্জুর পেলেন এক দুঃসংবাদ। এশিয়া চা বাগানের এক কর্মী তাকে জানালো শহরে গিয়ে একটা দৃশ্য দেখে এসেছে। সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির ভেতর দু’জন অফিসারকে রাখা হয়েছে। পেছন দিক থেকে তাদের হাত বাধা। চোখ বাধা গামছা দিয়ে। তাদের দিকে তাকিয়ে বাকি সৈন্যরা উল্লাসে মত্ত। মঞ্জুর সহজেই বুঝলেন ওই হতভাগ্য দুই অফিসার হলেন লে. কর্নেল ফজলে হোসেন ও ক্যাপ্টেন জামিল হক। মঞ্জুর ভাবলেন এবার লুকিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কোথায়? রাস্তা থেকে একটু দূরেই চা বাগানের কুলি বস্তি। মঞ্জুর সবাইকে নিয়ে সেই বস্তির একটি বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বাড়ির মালিকের নাম মানুমিয়া। মঞ্জুর মানুমিয়ার বাড়িতে কিছু সময় বিশ্রাম নিলেন। সবাইকে নিয়ে সামান্য খাওয়া-দাওয়া করলেন। কিন্তু একটু পরেই সেখানে পুলিশ এলো। বাড়িটি সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। জেনারেল মঞ্জুরের কাছে অস্ত্র ছিল। তবে তিনি অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেননি। কাজেই তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। আত্মসমর্পণ করেন দু’জন নারী, সাতটি বালক-বালিকা, মঞ্জুর নিজে ও মেজর রেজা। কিন্তু পুলিশ চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেজর গিয়াসের কোনও সন্ধান পেলেন না। ওই গোলমালের মধ্যেই সুযোগ বুঝে তিনি হাওয়া হয়ে গেছেন।

জেনারেল মঞ্জুর গ্রেফতার হয়েছেন। এই খবর যেন বাতাসে ছড়িয়ে গেলো। পথে পথে লোকারণ্য। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সেই জনতার ভেতর দিয়েই বন্দীদের নিয়ে চলল চট্টগ্রামের দিকে। পথে পথে গোলমাল। ক্রমবর্ধমান জনতার চাপ। যে কোনও মুহূর্তে তারা বন্দীদের ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই পুলিশ বাহিনী হাটহাজারী থানায় নিয়ে তুললো তাদের।

খবর গেল ঢাকায়। প্রেসিডেন্ট সাত্তার চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারকে জানালেন, “বন্দীদের চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুল আজিজের মনোনীত অফিসারদের হাতে তুলে দাও।”

সরকারি প্রকাশিত শ্বেতপত্র ও বেসরকারি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে  চট্টগ্রাম বিদ্রোহের যে উপসংহার সংগৃহীত হয়েছে তা এই রকম- তিনটি বদ্ধ জিপে রাত ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন এমদাদ বন্দীদের ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসে। একটি জিপ ছিলেন বেগম মঞ্জুর, বেগম দিলওয়ার হোসেন ও তাদের ৭ ছেলে মেয়ে। তাদের সবাইকে মঞ্জুরের সরকারি বাসভবন ‘ফ্ল্যাগ স্টাফ’ হাউসে পাঠিয়ে দেয়া হলো। দ্বিতীয় জিপে ছিল মেজর রেজা। তাকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো। তৃতীয় জিপটিতে ছিল ক্যাপ্টেন এমদাদ নিজে। এ জিপটি ছিল আগের দু’টি জিপের চেয়ে কিছুটা পেছনে। এ জিপেই  ছিলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। তার দু’টি হাত ও দু’টি চোখ বাধা। সরকারি শ্বেতপত্র বলা হয়েছে, এ জিপটি ‘‘ক্যান্টিন স্টোরস ডিপার্টমেন্ট শপ’’ সামনে করে ত্রিমোড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালে ২০ থেকে ৩০ জন সৈন্য সেটি আটকায়‌‌। অফিসার কিছু বলার আগেই তারা গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ফেলে। ভেতরে তারা জেনারেল মঞ্জুরকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে তারা জেনারেল মঞ্জুরকে গাড়ি থেকে টেনে নামায়। ক্যাপ্টেন এমদাদ বাধা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু উত্তেজিত সৈনিকরা তাকে ঠেলে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। বলে, “আপনি এখান থেকে চলে যান, না গেলে আপনাকে খুন করা হবে।”

কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন এমদাদ আরও ২ জন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ওই জায়গায় এলে দেখতে পান যে, “জেনারেল মঞ্জুরের মরদেহ রাস্তায় পড়ে আছে। তার মাথার পেছন দিকটায় একটি গর্ত। সে গর্ত একটি বুলেটের। তার গায়ে আর কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।”

মেজর জেনারেল মঞ্জুরের এই হত্যা সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন—

এক. সরকারি শ্বেতপত্রে দেখা যায় ক্যাপ্টেন এমদাদ মঞ্জুর ও তার সঙ্গীদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসছিল। সতর্কতা হিসাবে তার সঙ্গে কি কোনও সৈন্য পাঠানো হয়নি? যদি তা পাঠানো হয়ে থাকে তাহলে উত্তেজিত ২০ থেকে ৩০ জন সৈন্য যখন বন্দীদের গাড়ি আটক করল তখন তাদের ভূমিকা কি ছিল? ওই ২০-৩০জন উত্তেজিত সৈনিকের সামনে তারা কি পাথরের মতো অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল! কেন বন্দি জেনারেলকে যখন গাড়ি থেকে জোর করে নামিয়ে নেয়া হয় তখনও তাদের হাতের বন্দুক গর্জে ওঠেনি!

দুই. সরকারি শ্বেতপত্রে দেখা যায় জেনারেল মঞ্জুর যে জিপে হাত বাধা ও চোখ বাধা অবস্থায় ছিলেন সেই জিপটি ছিল পেছনে, বাকি দুটি জিপ থেকে অনেকটা দূরে। বিষয়টি সত্যিই রহস্যজনক। যে গাড়িতে ছিলেন মূল আসামি সেই গাড়িটি তো বাকি দুটো গাড়ির মাঝখানে থাকা উচিত। তা করা হয়নি। বরং সরকারি শ্বেতপত্রে দেখা যায় যখন ওই গাড়ি থেকে মঞ্জুরকে নামিয়ে নেয়া হয় তখন সেই গাড়িটি ছিল বাকি দু’টি গাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। মঞ্জুর সম্পর্কে কোনও একটা বিশেষ ব্যবস্থা (হত্যা) নেবার জন্যই কি ওই গাড়িটি বাকি দু’টি গাড়ি থেকে দূরে রাখা হয়েছিল?

তিন. সরকারি শ্বেতপত্রের মতে ২০-৩০ জন “উত্তেজিত সৈনিক” সেখানে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করে, সেখানে কি অন্য কোনও সৈনিক ছিল না? যদি থেকে থাকে তাহলে তারা কি ক্যাপ্টেন এমদাদের ডাকেও “উত্তেজিত” সৈনিকদের বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি?

চার. ওইসব উত্তেজিত সৈনিকদের নাম কি? তাদের বিরুদ্ধে কি ঊর্ধ্বতন অফিসারের আদেশ অমান্য ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল? যদি আনা হয়ে থাকে তাহলে কখন এবং কোথায় তাদের বিচার হয়েছে, তাদের শাস্তিই বা কি হয়েছে?

পাঁচ. জেনারেল মঞ্জুরের মরদেহ চট্টগ্রাম ক্যাণ্টমেণ্টের কবরস্থানে কবর দেয়া হল কেন? তার পত্মীও কি মঞ্জুরের মরদেহ নিতে অস্বীকার করেছিলেন? কিংবা তার ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন? 

চলবে...

আবেদ খান ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

আরও পড়ুন