• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২০, ০৩:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২২, ২০২০, ০৩:৩২ পিএম

‘জিরো টলারেন্স‍‍’ ভ্যাকসিনে নাকাল ‍‍‘সিন্ডিকেট ভাইরাস‍‍’

‘জিরো টলারেন্স‍‍’ ভ্যাকসিনে নাকাল ‍‍‘সিন্ডিকেট ভাইরাস‍‍’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- ফাইল ছবি

করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের জটিলতা, পরিস্থিতি মোকাবিলায় চরম অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম, চিকিৎসা সামগ্রি ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি এবং নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে ব্যাপক অনিয়ম সৃষ্টির ব্যাপারে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগের বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনায় উঠে আসে মিঠু সিন্ডিকেটের কথা। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে রিজেন্ট ও সাহাবউদ্দীন হাসপাতাল এবং জেকেজি'র ভয়াবহ প্রতারণা ও জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ্যে আসে। জানা যায়, এ খাতে দীর্ঘপ্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য খাতে দুর্বৃত্তায়নের এমন একের পর এক নজির স্থাপিত হয়েছে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক বিস্তারকারী অসাধু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। যার ভয়াবহ রূপের প্রকাশ ঘটলো করোনাভাইরাস মহামারিকালীন এই সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'জিরো টলারেন্স' নীতির হানায়।

স্বাস্থ্য খাতে চলমান পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে সমালোচনার মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এমনকি এদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০০০ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ২ মাসের থাকা-খাওয়া খরচ বাবদ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রসঙ্গে রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখার কথাও বলেন তিনি। যার মাধ্যমে শুরু হয় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসহ করোনাকালীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা গ্রহণ।

খাতটিতে চলমান এই সিন্ডিকেটের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত সাবেক ও বর্তমানদের বক্তব্যে উঠে আসলেও এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়নি। যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেট। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে পর্যায়ক্রমে দুর্নীতির এই ক্ষেত্র বাঞ্চাল করতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে প্রশাসন। যার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামনে এলো রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ও জেকেজি'র সাবরিনা-আরিফ সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্টতার তথ্য। জানা যায়, খাতের এসকল দুর্নীতির সিন্ডিকেট পরিচালনাকারীরা উপর মহলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্বাস্থ্য বিভাগের পদস্থ আমলাদের যোগসাজশেই দুর্নীতির এই বিশাল চক্র পরিচালনা করে থাকে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও 'অপ্রতিরোধ্য' হয়ে ওঠা স্বাস্থ্য খাতের এই সিন্ডিকেট ভাইরাসের শক্তি হ্রাস শুরু হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের 'জিরো টলারেন্স' ভ্যাকসিনে। সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ চক্র উপড়ে ফেলার মধ্যদিয়ে যা ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে আলোচিত এই খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মূলউৎপাটনের দিকে।

চলমান দুর্নীতি বিরোধী তৎপরতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়সহ স্বাস্থ্য খাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান পরিস্থিতির মাঝে দেখা যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় করোনাভাইরাস শনাক্তে নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষ গুলশানের সাহাবউদ্দীন মেডিকেল কাণ্ড। এসব মামলায় সোমবার (২০ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত অন্তত ৬২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই দ্রুত আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।

গত ৪ জুন সাভার থেকে দুই ব্যক্তিকে করোনা সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতারের পর প্রথম এই চক্রের কথা জানা যায়। সাভারের ডেনিটেক্স নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের করোনার কয়েকটি নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তারা ওই শ্রমিকদের জেরা করে, তবে তারা কেউ মুখ খুলছিল না। এরপর বিষয়টি কর্তৃপক্ষ সাভার পুলিশকে জানায়। সাভার পুলিশ শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আবু সাঈদ ও রাজু নামে দুই জনকে সাভারের গেন্ডা এলাকা থেকে আটক করে। তারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সাঈদ এক সময় সাভার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চুক্তিভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করতো। তার একটি ফার্মেসিও রয়েছে। তাদের কাছ থেকেও জাল সার্টিফিকেট এবং সার্টিফিকেট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ। এরপরেই ভয়াবহ এই চক্রের শেকড়ের সন্ধানে নামে প্রশাসন।

পরবর্তীতে উত্তরা ও মিরপুরে দুটি শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অবস্থিত রিজেন্ট হাসপাতালের মাধ্যমে এই জাল সার্টিফিকেট সরবরাহের তথ্য পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একটি প্রতারণা মাময়া দায়ের করেন সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এফএম শাহেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আশুলিয়ার এক বাসিন্দা জাল সনদের বিষয়টি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানায়। তবে সেটি আমার এলাকা না হওয়ায় সেখানে অভিযানে যেতে পারিনি। পরে এই চক্রটিকে গ্রেফতার করি। গ্রেফতার দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা জেলহাজতে আছে।’
এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকেই শুরু এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের প্রথম আঘাত। র‌্যাব সবচেয়ে বড় জালিয়াত চক্র রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে গ্রেফতার করে জালিয়াতি চক্রের দুর্গ ভেঙে দিয়েছে। বাহিনীর মিডিয়া ও আইন শাখার পরিচালক লে. ক. আশিক বিল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যখনই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবো, তখনই জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সাহেদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে আমরা হট লাইন চালু করেছি।’

এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, ‘আমরা জালিয়াতি ও প্রতারণার নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের নাম আসবে, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আটক, গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

রিজেন্ট হাসপাতালের করোনাভাইরাস টেস্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঢাকা, সাতক্ষীরা ও কাপাসিয়ায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। র‌্যাব বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছে। এর মধ্যে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে র‌্যাবের হাতে আটক রিজেন্ট চেয়রম্যান সাহেদের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার একটি, জাল টাকার একটি এবং সাতক্ষীরা দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে সাহেদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গাজীপুরের কাপাসিয়া থানায় মামলা হয়েছে। কাপাসিয়া বাজারের জুয়েলারি ব্যবসায়ী চন্দন রক্ষিত শুক্রবার (১৭ জুলাই) রাতে মামলাটি করেন। রিজেন্টের ঘটনায় র‌্যাব মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এদের মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজ রয়েছে। বর্তমানে তারা গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে।

রিজেন্টের কান টানতেই বেরিয়ে আসে ডা. সাবরিনা-আরিফ সিন্ডিকেট জেকেজি নামক একটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের মাথা। এই হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতারণার, দুটি ভাঙচুরের ও আরেকটি জিনিসপত্র আত্মসাতের। চতুর্থ মামলাটি একজন ব্যবসায়ী করেছেন। ওই ব্যবসায়ীর ল্যাপটপসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আত্মসাৎ করে জেকেজি। ভাঙচুরের দুই মামলায় ৩৩ জন গ্রেফতার হয়েছে। প্রতারণার মামলায় জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল চৌধুরী, তার স্ত্রী সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং প্রতিষ্ঠানটির নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবির হিমুকে আসামি করা হয়েছে। তদন্ত কাজের তৎপরতার এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও অভিযান চালায়।

রিজেন্টের দুর্দিন না কাটতেই করোনা পরীক্ষায় প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর গুলশানের সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাহাবউদ্দিনের বড় ছেলে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সোমবার (২০ জুলাই) রাত ১১টা ৫১ মিনিটে বনানীর একটি হোটেল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আবুল হাসনাত ও হাসপাতালটির ইনভেন্টরি কর্মকর্তা শাহরিজ কবির সাদিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করে র‌্যাব।

অবৈধভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ করার অপরাধে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে মেডিকেয়ার ক্লিনিক এবং অবগ্যান ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  শেখ মো. নাসীর উদ্দীন জানিয়েছেন, ‘নমুনা সংগ্রহ করার অনুমোদন না থাকায় গত ৭ জুলাই রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিকের মালিক আব্দুল ওহাব রানাকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। হাসপাতালটির ম্যানেজারসহ আরও দুজনকে তখন গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনায় তিন জন গ্রেফতার আছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’

এদিকে বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ববর্তী দুই মেয়াদসহ বর্তমানেও স্বাস্থ্য খাতে চলছে সেই মিঠু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। চলমান প্রক্রিয়ার হাত ধরে ক্রমেই সেই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে। সম্প্রতি  মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু উরফে 'ছেলে ধরা মিঠু' সিন্ডিকেট টানা বছরের পর বছর ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতে শক্ত জাল বিস্তার করে আছে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, প্রত্যেক সরকারের আমলেই মিঠু ক্ষমতাসীন কোনো মন্ত্রীর ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এরপর সুকৌশলে তাদের জড়িয়ে ফেলে দুষ্টচক্রের মাঝে এর ফলে তার দুর্নীতির ধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে আর এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গেলেই তুরুপের তাস হয়ে ওঠে সেই মন্ত্রীর ছেলে। এজন্যেই তাকে ছেলেধরা মিঠু ডাকা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর বিশ্বস্ত এজেন্ট। এসব এজেন্টই মিঠুর হয়ে যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে।

মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে মিঠু সিন্ডিকেট আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত। কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে নির্ধারিত যন্ত্রপাতির বদলে পুরনো এবং নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিন জন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। এরা তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের একজন অবসরে চলে গেছেন। মিঠু সিন্ডিকেটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন একজন সহকারী সচিব। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একই শাখায় পদ দখল করে রেখেছেন তিনি। তাকে অন্য কোথাও বদলি করা যায় না। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে সব দেখভাল করেন এই সহকারী সচিব। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের নিচের পর্যায়ের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরে মিঠু সিন্ডিকেটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল দম্পত্তি ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ারও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। মাফিয়া মিঠুর দুর্নীতির সহযোগী আবজালের সূত্র ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ইউনিটের ৪৭ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারেও তদন্ত চালায় দুদক। এদের মধ্যে প্রথম দফায় পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) ডা. আবদুর রশীদ, পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেনকে দুদকে তলব করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ডাকা হয় আরও পাঁচজনকে। তারা হলেন, ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক রাকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। তারা সবাই শীর্ষ মাফিয়া মিঠুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই পরিচিত। খুলনা শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারীও মিঠু সিন্ডিকেটের কল্যাণে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দেশ-বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। একই সঙ্গে তারা নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেওয়ায় ২০১৬ সালে সিন্ডিকেটের মূলহোতা মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন সাবমিশন’ মামলা করেছিল দুদক। স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর যাবতীয় কর্মকান্ড ও তার নামে-বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠানো হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মিঠুকে তার সহায়-সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর রহস্যজনক কারণে তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে যায়। কিন্তু থামেনি মিঠু সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৌরাত্ম্য। বরং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তার সিন্ডিকেটের নতুন সদস্য হয়েছেন। এখনো মিঠুর অঙ্গুলি হেলনেই চলছে স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় টেন্ডার, সরবরাহ ও কেনাকাটার কাজ। ২০১৬ সালে বিশ^ তোলপাড় করা পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি সংশ্লিষ্টতায় বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারকারী হিসেবে যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম এসেছিল, এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু তাদের একজন। এ কারণে মিঠুর ব্যাপারে দুদকের তথ্যানুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়টি শুরুতে বেশ গুরুত্ব পায়। মিঠুকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান উল্লেখ করে সে বিষয়েও তথ্য চায় দুদক।  ২০১৬ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে দুদক যে চিঠি পাঠিয়েছিল তাতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে স্বাস্থ্য সেক্টরে বিভিন্ন উন্নয়ন, সেবা খাতে যে সমস্ত কাজ বাস্তবায়ন করেছে, চলমান আছে এবং ওষুধ-মালামাল-যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোর প্রশাসনিক অনুমোদন, বরাদ্দপত্র, প্রাক্কলন-টেন্ডার, কোটেশন, দাখিলকৃত টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কার্যবিবরণী, কার্যাদেশ, কার্যসমাপ্তি প্রতিবেদনসহ প্রাসঙ্গিক সব রেকর্ডপত্র ২০১৬ সালের ৩০ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশিষ্ট মহলের দাবি, একটি সফল ও রাষ্ট্রস্বার্থে নিবেদিত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিরুদ্ধে রীতিমত সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাত। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা বলছেন, সরকার প্রধান যখন দুর্নীতির মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে 'জিরো টলারেন্স' নীতির ঘোষণা দিয়েছেন তখন সরকারেরই একটি মন্ত্রণালয় ও এর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দুর্নীতি ইস্যুতে সেই নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে রীতিমত ধৃষ্টতার পরিচয় দিচ্ছে। পাশাপাশি তারা এসকল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দল-মত নির্বিশেষে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সরকার প্রধানের 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে অটল অবস্থান গ্রহণকে সাধুবাদ জানিয়ে এক্ষেত্রে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানে সকল মহলের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।

এদিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। বলাবাহুল্য যে, টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পালনে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল সরকার প্রধান- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকারের আমালে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনন্য উচ্চতা অর্জনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী প্রাপ্তিযোগ। যা বিগত কোনোও সরকারের আমলে অর্জিত হয়নি। স্বল্পতম সময়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নতি লাভ এবং সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিন এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ডও রয়েছে সাফল্যের এই পরিসংখ্যানের মাঝে। সেই সঙ্গে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে যেভাবে তৎপরতা শুরু হয়েছে তা দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় আদর্শ নেতৃত্বের নজির উপস্থাপনের পাশাপাশি সরকার ও দলের ভাবমূর্তি আরো বাড়িয়ে তুলছে। মানুষ এখন পরিষ্কারভাবেই পরিস্থিতি বুঝতে পারছে আর অসাধু চক্রের কাছেও এই বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যে, দুর্নীতির মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, কাউকেই এক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হবে না।