• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২০, ০৩:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৪, ২০২০, ০৩:৪০ পিএম

রাস্তার ধারে ব্রিজের উপর বসবাস

অনাহার-অর্ধাহারে বিপর্যস্ত বন্যার্তরা

অনাহার-অর্ধাহারে বিপর্যস্ত বন্যার্তরা
বন্যায় তলিয়ে গেছে জামালপুর জেলার জনবসতি-জাগরণ

একে একে তিন দফা বন্যায় পানিবন্দি ১১ লাখেরও বেশি পরিবার এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। মানুষের হাতে কাজ নেই। নগদ টাকাও নেই। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার সংকট। বহু মানুষ এখনও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, রাস্তার পাশে, আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছে ব্রিজের ওপরে। সব মিলিয়ে  ক্রমশই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বন্যাদুর্গতরা। পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, বন্যার পানি পুরোপুরি নামতে আরও সময় লাগবে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ দিন। এরপর মানুষজন নিজের ঘরে ফিরেই বসবাস শুরু করতে পারবে না। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত করতে হবে। বাড়িঘরগুলোকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। কাজেই খুব সহজে এই দুর্ভোগ মানুষের পিছু ছাড়ছে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সোমবার (৩ আগস্ট) পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলা বন্যাকবলিত। বন্যায় পানিবন্দি ১১ লাখ পরিবারের ৫৪ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ। বন্যা আক্রান্ত উপজেলার সংখ্যা ১৫৮টি।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে জামালপুর জেলা। জামালপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সাতটি উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। একই সঙ্গে ৮টি পৌরসভাও বন্যাকবলিত হয়েছে। সমগ্র জেলার ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০১ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ইতোমধ্যেই জেলার ১২ হাজার ৪২৮ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সেখানকার বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এখনও পানির নিচে। রাস্তা মাঠ-ঘাট এখনও জলমগ্ন। টানা দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় জেলার মানুষজন চরম কষ্টে আছেন।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ঈদের দিনেই মাদারীপুরের শহর রক্ষা বাঁধে ধস নেমেছে। বাঁধের ২০ মিটার আড়িয়াল খা নদে বিলীন হয়ে গেছে। শনিবার বিকালে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধসহ ওয়াকওয়ের একটি অংশ বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে লঞ্চঘাট, পুলিশ ফাঁড়ি, পুরান শহর প্রাথমিক বিদ্যালয়।

সিলেটের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যাকবলিত মানুষের ঘরে খাবার নাই। সরকারি সহায়তা কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। যা পেয়েছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। মানুষের হাতে কাজ নেই। উপার্জন সক্ষম মানুষটি দীর্ঘদিন বেকার থাকায় আর্থিক সংকটে শত শত পরিবার। হাতে জমানো টাকাও শেষ হয়েছে বহু আগে। সবকিছু মিলিয়ে স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজন নিয়ে দিশেহারা বন্যার্তরা।

জামালপুরের  বাসিন্দা এস এম মুন্না জানিয়েছেন, বন্যায় বাড়িঘর ছেড়ে ১২ দিন যাবৎ রাস্তার পাশে পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করছি। ঘরে খাবার নাই। কোনও কাজও খুঁজে পাচ্ছি না। সরকারি সহায়তা বাবদ এ পর্যন্ত ১০ কেজি চাল পেয়েছিলাম। তা শেষ হয়েছে সেই কবে? আর শুধু চাল দিয়ে কি পেট বাঁচে?

মাদারীপুর শহরের বাসিন্দা আলম বেপারি বলেন, শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। তাই আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছি পরিবার পরিজন নিয়ে। কতদিন থাকা লাগে কে জানে। হাতে জমানো টাকা পয়সাও নাই। কাজও নাই। কতদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় পাবো কে জানে?

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলা বন্যা কবলিত। বন্যা কবলিত জেলাগুলো হচ্ছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নাটোর, গাজীপুর, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, গোপালগঞ্জ ও পাবনা। 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা সিটি করপোরেশন সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা ও বন্যার কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই অসহায় হয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি এলাকায় যান না। মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন প্রতিনিয়ত। বন্যা ও নদীভাঙন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মনে ঈদের আনন্দ ছিল না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষই ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারেনি।

বন্যা কবলিত এলাকাবাসী জানিয়েছে, এবারের বন্যায় কৃষকের আউশ ধান, আমনের বীজতলা এবং সবজি ক্ষেত বানের পানিতে ভেসে গেছে। অনেকের বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়েও তারা বিপদে রয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত দেশের ৩৩ জেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার ২৭১ জন। এ যাবৎ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫২৫টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত মানুষের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৩৯৭ জন। গবাদিপশুর সংখ্যা ৭৮ হাজার ৮২৫টি। বন্যার পানিতে ডুবে, নৌকা ডুবে এবং বন্যার পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন ৪১ জন মানুষ।

সরকারের পক্ষ থেকে বানভাসি এসব মানুষের জন্য ১৪ হাজার ৪১০ টন জিআর চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। নগদ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৩০০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ করা হয়েছে। গোখাদ্য কেনা বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা।

এমএইউ