• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২০, ০২:০৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২১, ২০২০, ০২:৫৮ এএম

শ্বাপদের সহিংসায় রক্তাক্ত ইতিহাস

মুখ ও মুখোশ

মুখ ও মুখোশ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের কাণ্ডারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক চক্রের যে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়িত হয় তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে সাবেক সেনা শাসক, রাজনৈতিক দল বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা- প্রয়াত মেজর জিয়ার। সে সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা- বর্তমান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা দেশে না থাকায় অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেই মিশন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় তাদের হত্যা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে ঘাতক সিন্ডিকেট। যার ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা। যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সভাস্থল - ফাইল ফটো

মুখোশের আড়ালে ঢাকা মুখগুলো যে ভয়াবহ সত্যটি জানান দেয় তা হলো, কালে কালে এমন প্রতিটি ষড়যন্ত্র হয়েছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু পরিবারের রাজনীতিকে থামানোর জন্য নয় বরং স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হরণের উদ্দেশ্যে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির এজেন্ট এই রাষ্ট্রবিরোধীদের সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব প্রদানকারী, মুজিববাদী রাজনৈতিক দর্শনের পাওয়ার হাউজ খ্যাত ঐতিহ্যবাহি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ উত্তরসূরী। তারা জানে যে, বাংলা ও বাঙালির বিনাশ নিশ্চিত করতে এ জাতির সঙ্গে 'বঙ্গবন্ধু সত্ত্বা'র বিচ্ছেদ অত্যাবশ্যক। আর সেজন্যেই প্রজন্মান্তরে তাদের এই অব্যাহত সহিংসার জেরে বার বার রক্তাক্ত হয়েছে দেশের বুক।

ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেখা যায়, পঁচাত্তরের মুখোশধারী মেজর জিয়াউর রহমানের হাতে যে রক্তাক্ত ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা হয়, তার উত্তরসূরী হিসেবে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পিতার অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করায় নিবেদিত ছিলেন তারই জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক জিয়া। শুধু তাই নয় প্রজন্মান্তরে বিএনপির অধিকর্তারা যে একই প্রভুর আনুগত্যে নতশির ছিল এবং একই লক্ষ্যে এই প্রাণঘাতী সহিংসতায় লিপ্ত থেকেছে তার প্রমাণও আজ কালচিত্রে উপস্থাপিত। জিয়া যেমন তৎকালীন পাকিস্তানী সেনা গোয়েন্দা সংস্থার অনুচর হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে পরাজিত শত্রুদের রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং নিষিদ্ধ মৌলবাদি শক্তির উত্থানে নিবেদিত ছিলেন, পুত্র তারেক জিয়াও সেই একই তত্ত্বের অনুসারী হিসেবে কাজ করে গেছেন। নিজেদের লক্ষ্যে অটল, সময়ের প্রেক্ষাপটে তারা শুধু মুখ ও মুখোশের লুকোচুরিতে বীভৎস স্বরূপ আড়াল রেখেছেন কথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায়। কিন্তু ইতিহাসের বুক চিরে সত্যের সন্ধান ঠিকই বের করে আনা হয়েছে। সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের মত তার পুত্র তারেক জিয়ারও পাকিস্তানী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুসন্ধান ও সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তার সত্যতাও যাচাই হয়েছে। আর নিজেদের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহীদের ক্ষমতায় বসিয়ে জিয়ার জামাত প্রীতি ও স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আপোষের ঐতিহ্যও বহাল রেখেছেন তারেক। 

হামলার মূলহোতা তারেক জিয়া (ডানে) ও তার একান্ত সহচর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর (বাঁয়ে) - ফাইল ফটো 

দেশের একজন বিজ্ঞ সাংবাদিকের অনুসন্ধানে- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সৈয়দ ফারুক রহমানের লেখা ৭ পৃষ্ঠার একটি চিঠির সন্ধান পাওয়া গেছে যা ব্রিটেনের জাতীয় মহাফেজখানায় (আর্কাইভ) সংরক্ষিত ছিল। এই চিঠির একটি বিশেষ অংশে উল্লেখিত ফারুক রহমানের ভাষ্য মতে, ‘আল্লাহর প্রেরিত বান্দা’ (কথিত জিহাদী) হিসেবেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন এবং সেজন্য তিনি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবেন। অর্থাৎ বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের লক্ষ্যেই জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে প্রমাণ হয়। একইভাবে ২০০৪ সালে বিএনপি মিত্র জামাতপন্থী হুজি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে পরিচালিত গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় তারেক-বাবর চক্র। লন্ডনে দেয়া জিয়া মিত্র সৈয়দ ফারুকের সাক্ষাতকার ও তার এই চিঠি যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা ও মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের তথ্য জানান দেয়, তেমনি আদালত প্রাঙ্গণে নিজের ফাঁসির রায় শোনার পর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, তারেক মিত্র বাবরের চিৎকারে জানা যায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টার মাইন্ড ও জামাত সখ্যতায় দেশে পাকিস্তানী জঙ্গি সংগঠনের গোড়াপত্তনে তারেক জিয়ার জড়িত থাকার বিষয়টি।

১৯৭৬ সালে লন্ডনে অবস্থানকালে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সঞ্চালনায় আয়োজিত এক সাক্ষাতকারে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যার প্রসঙ্গ সবিস্তারে তুলে ধরেন খুনিচক্রের অন্যতম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লে.কর্নেল ফারুক রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ বিকেলে কর্নেল ফারুক রহমান মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন বলে স্বীকারোক্তি দেন এবং তাঁর সাহায্য প্রত্যাশার কথা জানান। কর্নেল ফারুকের ভাষ্য মতে, সে সময় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, তিনি সিনিয়র অফিসার, তিনি এধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না, তবে জুনিয়র অফিসাররা যদি চায়, তাহলে তারা এটা করতে পারে (মুজিব সরকারকে উৎখাতের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান) সেক্ষেত্রে তার কোনো আপত্তি নেই। কর্নেল ফারুক জানান, জিয়ার বক্তব্যে অনুমোদনের ইঙ্গিত পেয়েই তারা অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আর সেক্ষেত্রে তারা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব মাথায় রেখেই মুজিব হত্যার পরিকল্পনা করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে সহিংস রাজনীতির গোড়াপত্তন ও বিতর্কিত মৌলবাদি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পৃক্ততার দায় এড়াতে পারে না বিএনপি-জামাত জোট - ফাইল ফটো  

অন্যদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় দোষীসাব্যস্ত হওয়ায় বাবরকে মৃত্যুদণ্ড এবং তারেক জিয়াকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন আদালত। বাবর তখন চিৎকার করে বলছিলেন..."আল্লাহ! এইটা কেমন বিচার? এই দোষে আমার একবার ফাঁসি হইলে তারেকের ৩ বার ফাঁসি হওয়া উচিত!..."

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততার মতই দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রধান- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ এ যাবত যতগুলো ব্যর্থ প্রচেষ্টা পরিচালিত হয় তার প্রত্যেকটির সঙ্গে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তারেক জিয়ার সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে সর্বমহল অবগত। যার প্রেক্ষিতে আইনের হাত থেকে বাঁচতেই বর্তমানে লন্ডনে পলাতক রয়েছে তারেক।

ঘাতকদের বিচারিক দণ্ডপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে কবে?  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ যেভাবে হত্যা করে জিয়া-মোশতাক চক্র তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে পরিকল্পিত এক ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার বর্বর প্রচেষ্টা চালায় ঘাতকচক্র। যার মূলহোতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান ও তৎকালীন জামাতপন্থী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক জিয়া। আর এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে কাজ করে তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বুকে রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকারী- পাকিস্তান সমর্থিত হুজি জঙ্গিগোষ্ঠী।

এখনও সক্রিয় এই ঘাতকচক্রের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে শুধু বদল এসেছে প্রক্রিয়ায়। বারংবার প্রত্যক্ষ আঘাতের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় কোনঠাসা শ্বাপদের দল পরিবর্তন এনেছে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়নের পন্থায়। আবারো তারা সেই মুখ ও মুখোশের প্রহসনের খেলায় মেতেছে। কথিত মুজিববাদী সেনানির রূপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটিয়েছে অনুপ্রবেশ, ভেতরে ভেতরে নানা অপকর্মে বিতর্কিত করছে সরকার ব্যবস্থাকে, ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে পতনের দিকে যেখানে তাদের পোষ্যতা দিচ্ছে মোশতাকি মীর জাফরেরা। পাশপাশি পঁচাত্তরের মুজিব সরকারের মত বিতর্কিত করতে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সরকার প্রসঙ্গে অনাস্থা আর গুজবের কুমন্ত্র। ঠিক এভাবেই একজন নিবেদিত বীর সেনানি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে এসেছিলেন কসাই টিক্কার অনুচর- কর্নেল বেগের নিয়ন্ত্রাণাধীন পাকিস্তানী গুপ্তচর মেজর জিয়া। আর পরবর্তীতে নিজের মুখোশের অন্তরাল ছেড়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেশখেকো নৃশংস ঘাতকের অবয়বে।

প্রজন্মান্তরে শুধু বদলেছে মুখোশ, অন্তরালে সেই একই ঘাতকের মুখ- ছবি : সংগৃহিত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুখোশধারী এই ঘাতকচক্র গা ঢাকা দিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশবিরোধী অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে তারা। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে দ্রুততম সময়ে। সে লক্ষ্যে সরকারের সর্বোচ্চ তৎপরতা আবশ্যক। অন্যথয় সকল অর্জনই বিফলে যাবে। এখনই সময়; স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষায়, আগামীর বাংলাদেশের বুকে নৈরাজ্যের বিভীষিকা রুখতে, জাতিগত ঐক্যের বলিষ্ঠ বন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে জাতির যোগ্য নেতৃত্বকে দৃঢ়তা প্রদানে। একযোগে মুখোশধারী এই জাতশত্রুদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ দুর্গ। বাঙালি জাতিসত্ত্বার পক্ষ থেকে তাদের জানিয়ে দিতে হবে প্রজন্মের জাগরণী বার্তা, 'লাখো বীরের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে...কেউ তার অস্তিত্ব নাশ করতে পারবে না।'