• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০১৯, ০৬:৩৩ পিএম

জাতীয় সংসদ হোক আত্মমর্যাদার প্রতীক

জাতীয় সংসদ হোক আত্মমর্যাদার প্রতীক

 

টানা তৃতীয় মেয়াদে জাতীয় সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার (০৩-০১-২০১৯) সংসদ সদস্য হিসেবে শপথগ্রহণের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠকেই তিনি সংসদ নেতা নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত দক্ষ নেতৃত্ব, নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দৃশ্যমান সামাজিক অগ্রগতিই আওয়ামী লীগের এ ভূমিধস বিজয়ের মূল কারণ।

ভূমিধস বিজয়ে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ খুশি হলেও সংসদীয় গণতন্ত্রচর্চায় দেশকে হোঁচট খেতে হচ্ছে। হোঁচট খাওয়ার কারণ, সংসদে বিরোধী দলের আকার। ভূমিধস বিজয়ের কারণে দশম সংসদের মতো একাদশ সংসদেও সরকার-ঘেঁষা বিরোধী দল গঠন করতে হচ্ছে। কিন্তু গত সংসদে বিরোধী দলকে নীতিনির্ধারণী কোনো বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এ সংসদে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ অনেক কথাই বলেছেন। এমনকি তারা জনগণের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না বলেও অনুশোচনা করেছেন।

বিরোধী দলশূন্য সংসদ দুর্বল গণতন্ত্রের পরিচায়ক। ভূমিধস বিজয়ের ফলে বিজয়ী দল যতটা আত্মপ্রত্যয়ী হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে স্বেচ্ছাচারী ও বেপরোয়া মনোভাব। ভয় ও শঙ্কা তো সেখানেই। শেখ হাসিনা পারবেন, এত বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আসা তার সহকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে? যারা তাদের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তায় বিরোধীদের ভোটের মাঠে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সংসদে এসেছেন।

সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীভাবে সরকার চলবে, কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ দিতে হবে, সরকারের বৈদেশিক নীতি কী হবে- সবই ঠিক করে দেয় সংসদ। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা যত কমই হোক, সংসদ সব সময় সরকারকে নজরদারিতে রাখে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদে উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সাংসদরা ভোট দিতে পারেন না, কিন্তু সরকারের কাজের সমালোচনা করতে তাদের কোনো বাধা নেই। তবু তারা সরকারের ভালো-মন্দ কাজের সমালোচনায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। সরকার-ঘেঁষা বিরোধী সাংসদরাও তাদের দেখাদেখি একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। 

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে বলা হয় বিকল্প সরকার। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় বিরোধী দলের সাংসদদের নিয়ে ছায়া সরকার গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক তাদের কমিটি থাকে। কিন্তু দশম সংসদে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সংসদে যে দলটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন, একই সঙ্গে তারা ছিলেন সরকারেরও অংশীদার। এ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনকারী দলের তিনজন ছিলেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী; দলের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ফলে নীতিগত বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করা তাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব হয়নি। দু-একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মাঝেমধ্যে বিবেকের তাড়নায় কিছু বলার চেষ্টা করলেও তাদের কণ্ঠস্বর লুই কানের নকশা করা সুরম্য ভবনের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এসেছে।

এসব অসঙ্গতি বা গোঁজামিল সত্ত্বেও হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, একাদশ জাতীয় সংসদ হবে সুশাসনের অন্যতম মডেল। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগামী সরকার একটি সুখী-সমৃদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এবং একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ উপহার দেবে। বিশ্বে বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় ভূমিকা পালন করবে। এ ব্যাপারে এ সংসদকে থাকতে হবে খুবই সতর্ক, সুদৃঢ়, সুস্পষ্ট, বাস্তববাদী ও আন্তরিক। বিশাল তরুণ সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে সবকিছুর আগে। তারুণ্যের শক্তিকে বিকশিত করার জন্য এসব তরুণ-তরুণী, যুবক ও যুব মহিলাকে বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তি শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে।

সরকারি খাতে দুর্নীতি হ্রাস ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্বৃত্ত তহবিল সঞ্চয়ে সংসদকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্থিতাবস্থা দূর করতে হলে একদিকে যেমন আকর্ষণীয় পলিসি সংস্কার করে প্রণোদনা দিতে হবে, অন্যদিকে তেমনি কর-হার না বাড়িয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। উপযুক্ত নীতিকৌশলে মুদ্রা পাচার বন্ধ করা এবং রপ্তানিতে জোয়ার আনতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তথা ব্যাংকিং বীমা ও মূলধন মার্কেটে সংস্কার এনে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সততার পথ চালু করতে হবে।

জনগণ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যাদের পাঠায়, সংসদে তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত- এটাও সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা থাকে, ভালো কিছুর। কারণ তারা তো কেবল আইনপ্রণেতা নন, নিজ নিজ এলাকার অভিভাবকও। বিগত দিনে দেখা গেছে, সাংসদদের আনেকেই সংসদে যা করেন, তাতে জাতীয় সংসদের ভাবমূর্তি তো ক্ষুণ্ণ হয়ই, ক্ষুণ্ণ হয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতিও। আইনপ্রণেতা হিসেবে দেশ ও জাতি সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করে, যা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মুখে কুরুচিপূর্ণ, অশালীন, আক্রমণাত্মক শব্দ শুনতে চায় না। নির্বাচনী অঙ্গীকার সত্ত্বেও  সাংসদদের জন্য আচরণবিধি আজও প্রণীত হয়নি। তাই ঝুলে থাকা সংসদ সদস্য আচরণবিধিটি অচিরেই সংসদে গৃহীত হবে, এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা। 

জাতীয় সংসদ নিয়ে আরেকটি দিকও ভেবে দেখা দরকার। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি দল সংসদে থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই কোরাম সংকট হয়। এর কারণ, রাষ্ট্রীয় কাজে এবং জনগণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে জনপ্রতিনিধিদের অনাগ্রহ। সংসদের পদ তারা ব্যবহার করেন নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে। আইন প্রণয়নের চেয়ে ব্যবসাবাণিজ্যের দিকেই তাদের নজর থাকে বেশি। টিআইবির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেতা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরও ৮০ শতাংশেরও বেশি সময় সংসদে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু সংসদ নেতা সংসদে উপস্থিত থাকতেও দেখা যায়, অনেক মন্ত্রী ও সাংসদ সংসদে উপস্থিত থাকেন না।  এতে প্রতি কার্যদিবসে অপচয় হয় গড়ে ৩০ মিনিট। সংসদ পরিচালনায় প্রতি মিনিটে গড়ে খরচ হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কার্যদিবসের কোরাম সংকটে গড় অর্থমূল্য ৪৯ লাখ ১০ হাজার ৫৮০ টাকা।

জাতীয় সংসদ হোক বিতর্ক ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে দেশের এবং মানুষের যাবতীয় সমস্যা সম্ভাবনার আলোচনা উঠে আসুক। এখান থেকেই পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সত্যিকারের গণতন্ত্রের সুফল সরাসরি মানুষের মাঝে চলে যাক। আলোচনা, প্রতি আলোচনা, বিতর্কে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক সংসদ- এটাই সবার প্রত্যাশা। সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা, মনের কথা তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো স্থানীয় এমপিদের মাধ্যমে উঠে আসুক সংসদে। এক কথায়, জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক জাতীয় সংসদ, হয়ে উঠুক বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক।