• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১, ০৫:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ১২:১৬ এএম

ব্যবসা ও বিজ্ঞাপনে ভাষার ব্যবহার

বাংলার তুলনায় ইংরেজিই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি

বাংলার তুলনায় ইংরেজিই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি

১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে জীবন দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির বীর সন্তানেরা। ৬৯ বছর পর সেই ভাষা কতখানি সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আজ নতুন করে ভাবাচ্ছে সবাইকে। বাস্তবচিত্র হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সর্বত্র বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। বরং সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে আছে ইংরেজি ভাষা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক বিপণিবিতান, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার বা নামফলকে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার ব্যবহার করলেও সেখানে ইংরেজি ভাষাই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি।

তবে সরকারি অফিস, কিছু বিপণিবিতান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও নামফলকে এবং গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলার ব্যবহার দেখা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, সেটির হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে আদালত বলেন, দেশের সকল সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে বিদেশি দূতাবাস ও প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যানার, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড বা নামফলকে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করতে পারবে।

২০১৪ সালের ২৯ মে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উচ্চ আদালতের ওই আদেশ কার্যকর করবে স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা। তারপর থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই অভিযানে নামে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সংবাদপত্রের পাতায় বা টেলিভিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত না করার আক্ষেপ। তারপরও পুরোপুরি পাল্টেনি চিত্র।

সিটি করপোরেশন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেয়। নির্দেশনা না মানলে ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল, উচ্ছেদ ও জরিমানা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু তারপরও নানা অজুহাতে নির্দেশনা মানছেন না ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের বাংলায় সাইনবোর্ড করার কাজ চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে। কেউ আবার বলছেন, তাদের কোম্পানির লোগো ইংরেজিতে হওয়ায় সেই ভাষাই ব্যবহার করতে হচ্ছে। আবার অনেকের অজুহাত দেখাচ্ছেন, তাদের দোকানের চুক্তি প্রায় শেষের দিকে। তাই তারা চুক্তি নবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সাইনবোর্ড পাল্টাবেন না।

অজুহাত যাই হোক, শতভাগ বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারার জন্য সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা ও জনগণের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বদরুল হাসান কচি বলেন, “বাংলাভাষা ব্যবহারের জন্য আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখানে ভাবিষ্যৎব্যঞ্জক কোনো কথা বলা হয়নি। ‘হবে’ কোনো শব্দ নেই। অর্থাৎ বাংলাই এ দেশের জনগণের ভাষা। আবার ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের জন্য একটি আইন করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এতদিন পর এসেও সেই আইনটা কার্যকর করা যায়নি। সেই বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের জন্য কথা বলতে হচ্ছে।”

বদরুল হাসান কচি আরো বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশনা মানার দায়িত্ব জনগণের আছে আবার এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা নেওয়ার ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা আছে।”

তবে কিছু ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা কার্যকর হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি আরো বলেন, “আমাদের যানবাহন লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও নাম্বার প্লেটের ক্ষেত্রে এখন বাংলা ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আদালতের নির্দেশনা মানা বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন। এ জন্য সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এ বিষয়ে সরকারের আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত।”

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, “সর্বস্তরে বাংলা লেখা প্রচলনের জন্য আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করছি। আমরা যে ট্রেড লাইসেন্স দেই, সেখানেও আবশ্যিকভাবে সাইনবোর্ডে বাংলা লেখার নির্দেশনা দিয়েছি। তারপরও কোথাও এর ব্যতিক্রম হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।”

সাইনবোর্ডে বাংলা থাকলেও ইংরেজি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ইংরেজি জানতে হয়, ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সেটা বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। বাংলা ভাষকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা অন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু কেউ বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে যদি অন্য ভাষাকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে তার দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। এটি একটি অপরাধ, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।”