• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২১, ০৩:৫৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১১, ২০২১, ০৩:২৩ পিএম

কতটা নারীবান্ধব হতে পেরেছে ঢাকা?

কতটা নারীবান্ধব হতে পেরেছে ঢাকা?

প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। পুরুষের পাশাপাশি এখানে সমান তালে এগিয়ে চলছেন নারীরা। শিক্ষা, দীক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে নারীদের এখন জয়জয়কার। কিন্তু এই নারীরাই ঘর থেকে বের হলে পড়েন নানা সমস্যায়। গণপরিবহন কিংবা ভিড়ের মধ্যে শরীর টের পায় অযাচিত স্পর্শ, কখনো কানে ভেসে আসে বাজে মন্তব্য। প্রতিবাদ করলেও বেশিরভাগ সময় পান না সহযোগিতা।

কথায় আছে ঢাকা কখনো ঘুমায় না। তারপরও একটু রাত হলেই অনিরাপত্তায় ভুগতে হয় নারীদের। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে না পড়ার জন্য সতর্ক থাকতে হয় সবসময়। এছাড়া বন্ধুসুলভ পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতা বা চলতে ফিরতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের মতো বিষয়ের অভাব তো আছেই। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে রাজধানী ঢাকা কতটা নারীবান্ধব?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দৈনিক জাগরণ কথা বলে বিভিন্ন পেশার কয়েকজন নারীর সঙ্গে। তাদেরই একজন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী। স্নাতকোত্তর পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে। তিনি বলেন, “ঢাকা মোটেও নারীবান্ধব না। আমাকে যদি ১০ এর মধ্যে মার্ক দিতে হয় তাহলে আমি মাত্র ১ দেবো। কারণ একজন নারীকে ঘর থেকে বের হলেই ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়, পাবলিক প্লেসে বা গণপরিবহনে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে পোশাক নিয়ে কটু কথা শুনতে হয়।”

প্রতিটা নারীকেই রাজধানীতে বেশ সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় মন্তব্য করে এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, “রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নারীদের অনুকূলে না। সব মিলিয়ে বেশ সংগ্রাম করেই নারীদের ঢাকায় চলাফেরা করতে হয়। এই জায়গা থেকে আমি বলবো, যেসব নারীরা ঘরের বাইরে বের হন তারা স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সাহসিকতার পরিচয় দেন।”

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করা ফারহানা আহমেদ বলেন, “নারীকে ঘর থেকে বের হলেই বিভিন্ন ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হয়। গণপরিবহনে ওঠার সময় হেলপাররা কারণ ছাড়াই অযাচিতভাবে শরীরে হাত দেন। পাশের সিটে বসে থাকা পুরুষ যাত্রীকে একটু সরে বসতে বললেই তারা নানা যুক্তি দেখান। মাঝে মাঝে রাস্তায় মানুষজন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে, মনে হয় চোখ দিয়েই ধর্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া বাজে মন্তব্য তো নিত্য ব্যাপার। এ নিয়ে এখন আর ভাবিই না।”

ফারহানা আরো জানান, “অফিসে একটু দেরি হলেই একা একা বাসায় ফেরাটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এই নগরীতেই মাঝে মাঝেই ধর্ষণ বা যৌন হেনস্তার শিকার হন মেয়েরা।”

গণমাধ্যমকর্মী অনন্যা আশরাফ বলেন, “ঢাকার পরিবেশ এখনো নারীর অনুকূলে আসেনি। রাজধানীর পথে নারীদের সুবিধায় তেমন কোনো বিশেষ ব্যবস্থা দেখা যায় না। বাসে উঠতে এখনও নারীদের প্রতিযোগিতা করতে হয়। একটি বন্ধু সুলভ পরিবেশ পেলে নারীরা আরও সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারতো।”

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী প্রমা ইসরাত বলেন, “ঢাকা নারীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং জায়গা। নারীবান্ধবের বিষয়টি তো পরে আসবে, আগে নারী সহনীয় কীনা তা দেখা প্রয়োজন। একজন নারীকে গণপরিবহনে উঠতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। বাসগুলো নারীদের নিতে চায় না। নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলোতে পুরুষ বসে থাকে। আবার গণপরিবহনে নারীদের জামা কেটে দেওয়ার মতোও ঘটনাও এই রাজধানীতে ঘটতে দেখা গেছে।”

গণপরিবহনে ভিড়ের ভেতর নারীদের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের শিকার হতে হয় মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, “এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। অনেককেই বলতে শোনা যায় গণপরিবহনে এমন ধাক্কাধাক্কি হয়। যদি এটা সহ্য না হয়, তাহলে নিজের গাড়ি নিয়ে যেনো চলাফেরা করি। আবার ঢাকা শহরে নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেটেরও ব্যাপক অভাব রয়েছে।”

এই আইনজীবী আরো বলেন, “এখন রাজধানী কিছুটা নারীবান্ধব হয়ে উঠছে। তবে সেটা সকল শ্রেণির জন্য নয়। যাদের টাকা আছে, নিজের গাড়ি আছে তাদের জন্য ঢাকা নারীবান্ধব। কারণ তাদের গণপরিবহনে উঠতে হয় না। তারা যেখানে শপিং বা কাজ করতে যান, সেখানে একটা ভালো পরিবেশ পান। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত তাদের জন্য ঢাকা নারীবান্ধব না। তাদের প্রতিদিন একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার সকল পুরুষ যে খারাপ তা নয়। অনেক সময় অপরিচিত একজন পুরুষকেও নারীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়।”

তবে নারীর নিরাপত্তা তার অভ্যন্তরীণ সাহসের ওপর নির্ভর করে বলে মনে করেন ভাষানটেক থানার নারী উপ-পরিদর্শক (এসআই) কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, “নারী নিরাপত্তার বিষয়টা একান্তই তার নিজের বলে আমি মনে করি। সে নিজেকে যতটা সক্ষম, সাহসী, স্বনির্ভর বলে মনে করবে পারিপার্শ্বিক ভাবে সে নিজেকে ততটাই রক্ষা করতে পারবে।”

নিজে সক্ষম না হলে পৃথিবীর কোনো শহরই নারীবান্ধব হবে না মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, “রাজধানীতে হয় তো মাঝে মাঝে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখা যায়। তবে সেটা সবসময় না। নারীদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা না গেলেও আগের তুলনায় অনেকটা নিশ্চিন্তে নারীরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন। নারীরা কোনো সমস্যায় পড়লে নিজেরাই প্রতিবাদ করছেন, নিজেদের সুরক্ষা নিজেরা দিচ্ছেন। নারী যদি নিজেকে সক্ষম না ভাবে তাহলে পৃথিবীর কোনো শহরই তার জন্য নিরাপদ হবে না। কোনো নারী গণপরিবহনে যৌন হেনস্তার শিকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রতিবাদ করেন বা আওয়াজ তোলেন, তখন আশপাশের আরো ১০ জন এগিয়ে আসবে। সেই হেনস্তাকারীকে গণধোলাই দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিবে। কিন্তু যদি চুপ থেকে নীরবে সহ্য করে তাহলে এমন হেনস্তা সব সময়ই হতে হবে।”

নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, “নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এখন প্রতিটি থানায় ব্যবস্থা আছে। একজন নারী যাতে তার সমস্যার কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন তার জন্য ব্যবস্থা থাকে। তারপরও পুরুষদের উচিত নারীদের সম্মান করে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। যাতে প্রতিটা নারীই তার চলার পথে কোনো বাধার সম্মুখীন না হন। একটি সুন্দর পরিবেশ পান।”
 

আরও পড়ুন