• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০৮:৩৩ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০২১, ১০:১৪ এএম

বৈশাখের বাজারে ক্রেতাশূন্য দোকান

বৈশাখের বাজারে ক্রেতাশূন্য দোকান

রাজধানীর আজিজ সুপারমার্কেটের অভিজাত পোশাকের দোকান ‘মেঘ’। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন নতুন ডিজাইনের লাল-সাদা পাঞ্জাবি, শাড়ি, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন রকমের পোশাক তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্রেতাদের প্রদর্শনের জন্য সেগুলো পুতুলসহ বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়েও রাখা হয়েছে। প্রস্তুত বিক্রয়কর্মীরা। তবে নেই শুধু ক্রেতা।

একই দশা এই মার্কেটের প্রায় প্রতিটি পোশাকের দোকানের। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষকে ঘিরে শাহবাগের এই মার্কেটটিতে বড় রকমের বেচাকেনা হতো। ক্রেতাদের ভিড়ও হতো প্রচণ্ড রকমের। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর থেকে শুধু লোকসানই গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এই বছরও নেই তেমন ক্রেতাদের সাড়া। ফলে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিলেও হতাশ বিক্রেতারা।

গত বছর মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকার বেশ কিছুদিনের জন্য দেশজুড়ে লকডাউন জারি করে। বন্ধ থাকে মার্কেট, শপিং মল ও দোকানপাট। ফলে পয়লা বৈশাখের সময়টায় কোনো বেচাবিক্রি করতে পারেননি পোশাক বিক্রেতারা। এতে ব্যাপক লোকসান গুনতে হয় তাদের। গত বছরের লোকসান এই বছর পুষিয়ে নেওয়ার চিন্তা করেছিলেন প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়ী। কিন্তু এবারও বাদ সাধল করোনা।

দেশে করোনার সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে থাকায় ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছিল সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল গণপরিবহনসহ মার্কেট, শপিং মল ও দোকানপাট। পরে যদিও জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে গণপরিবহন ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে শর্ত সাপেক্ষে সীমিত পরিসরে মার্কেট ও দোকানপাট খুলে দিয়েছিল। তবে এতে তেমন লাভ হয়নি ব্যবসায়ীদের। কারণ, সীমিত পরিসরে দোকানপাট খোলা থাকায় ক্রেতা নেই মার্কেটগুলোতে। তার ওপর ১৪ এপ্রিল থেকে ফের এক সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। ফলে ফের লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের কথা

‘মেঘে’র ম্যানেজার শামসুল ইসলাম বলেন, ‍“আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পয়লা বৈশাখে। এবারও নববর্ষ উপলক্ষে ২৫ লাখ টাকার ওপর পোশাক তুলেছি । কিন্তু লকডাউনের কারণে আমাদের অবস্থা খারাপ। গত বছরই প্রায় এক কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে। এই বছরও একই অবস্থা। বৈশাখের সময় যা একটু বেচাবিক্রি হতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই।”

অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর পয়লা বৈশাখে বেচাকেনা অর্ধেক কমেছে ‌‘বৃত্ত ফ্যাশনে’র। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মী লিটন বলেন, ‍“সারা দিনে খুচরা ক্রেতা আসেন মাত্র দুই-তিনজন। আমাদের পাইকারি বিক্রি সবচেয়ে বেশি হলেও লকডাউনের কারণে দূরপাল্লার বাস বন্ধ। ফলে পাইকারি ক্রেতাও নেই। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে লকডাউনের পরিস্থিতি দেখে ঈদের পণ্য তুলতে হবে।”

‘নন্দন কুঠিরে’র ম্যানেজার নাহিদ খান বলেন, ‍“গত বছর আমরা পয়লা বৈশাখে বেশ কিছু ডিজাইনের পোশাক তুলেছিলাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেগুলো বিক্রি হয়নি। তাই এবার গত বছরের পণ্য দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি। নতুন করে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে কোনো প্রোডাকশন দেয়নি।”

নাহিদ খান আরও বলেন, ‍“অন্যান্য বছর পয়লা বৈশাখ ও ঈদ মিলিয়ে ৩০-৫০ লাখ টাকার পোশাক বিক্রি হতো। কিন্তু দুই বছর ধরে এর ২০-৩০ শতাংশও বিক্রি করতে পারিনি। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা না পারছি দোকান খোলা রাখতে, না পারছি বন্ধ করতে। সরকারের উচিত আমাদের দিকটাও দেখা।”

শুধু আজিজ সুপারমার্কেট নয়, বৈশাখকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বড় শপিং মলগুলোর ব্র্যান্ডের দোকানগুলোও আয়োজন করেছে বেশ। কিন্তু সেখানেও ক্রেতা সংকট।

বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে দেশীয় পোশাক বিক্রির অন্যতম প্রতিষ্ঠান সাদাকালোর এরিয়া ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম সজীব বলেন, ‍“গত এক বছর মানুষ তেমন একটা কেনাকাটা করেনি। কারণ, মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর পর ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়নি। তাই ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রতিবছরের মতো এ বছরও আমরা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক নিয়ে এসেছি। কিন্তু মানুষের তেমন সাড়া নেই।”

আগে এই উৎসবগুলোয় ক্রেতাদের আলাদা চাহিদা থাকতো, ভিড় থাকত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বছর লকডাউনের কারণে তেমনটা নেই। এ ছাড়া সামনে মুসলিমদের সব বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ থাকায় এ বছর পয়লা বৈশাখের প্রতি মানুষের আগ্রহটা একটু কম। এক মাস আগেও আমাদের মধ্যে একটা উৎফুল্ল ব্যাপার কাজ করছিল যে গতবারের ক্ষতিটা এবার বৈশাখ ও ঈদে পুষিয়ে নেব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, সে হিসেবে মনে হয় না আমরা তেমন একটা বেচাকেনা করতে পারব।”

তারপরও রোজার প্রথম সপ্তাহের পর যদি লকডাউন তুলে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার আশা করছেন এই বিক্রেতা।

বেতন আয় হারানোর শঙ্কায় কর্মচারীরা

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবার তেমন বিক্রি না হওয়ায় এবং রোজার কিছুদিন মার্কেট বন্ধ থাকার ঘোষণায় কর্মচারীদের বেতন নিয়ে শঙ্কায় আছেন সংশ্লিষ্টরা। দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ারও শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

আজিজ সুপারমার্কেটের ‘কাপড়-ই-বাংলা’র ম্যানেজার জুয়েল বিশ্বাস বলেন, “আমাদের এই শোরুমের সঙ্গে জড়িত আছে, সেলাই থেকে শুরু করে যারা হাতের কাজ করে সবাই। সারা বছর তাদের পাওনা বাকি থাকে। যার ৮০ শতাংশ এই রোজার মাসে পরিশোধ করা হয়। আর বছরজুড়ে দেওয়া হয় বাকি ২০ শতাংশ। আমার এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে আছি। গত বছর যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পুষিয়ে উঠতে পারিনি। এখন যদি আবার লকডাউন হয়, তাহলে দোকান বন্ধের পর্যায়ে পড়ে যাবে।”

জুয়েল আরও বলেন, “করোনার কারণে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কাপড়-ই-বাংলাকে কোটি টাকার বেশি কম বিক্রি হয়েছে। মাঝে যে সময়টায় দোকানপাট খোলা ছিল, তখন শুধু দোকান-ভাড়া বা কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি। কিন্তু যারা আমাদের সারা বছর ধরে কাপড় দেয়, সেলাই করে তাদের তো কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।”

বিসর্গ নামের আরেকটি দোকানের বিক্রয়কর্মী নাসরিন বলেন, ‍“লকডাউনের কথা শুনে আমাদের মনমানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। ক্রেতারা আসতে চাইলেও আসতে পারছে না। এতে মালিকপক্ষের তো লোকসান হচ্ছেই, পাশাপাশি আমরা যারা চাকরি করি তাদের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। পণ্য যদি বিক্রি না হয় তাহলে মালিকপক্ষ কর্মীদের বেতন দেবে কীভাবে? বিক্রয়কর্মীদের দিকে তাকিয়ে হলেও সরকারের উচিত মার্কেট খোলা রাখা।”

স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলা রাখলে বিক্রয়কর্মীদের জন্য ভালো হয় বলে জানিয়েছেন বসুন্ধরা সিটির অঞ্জনসে’র ম্যানেজার গৌতম মজুমদার। তিনি বলেন, “করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু আমাদেরও তো বাঁচতে হবে। তাই সরকারের কাছে আমাদের আশা স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন দোকানপাট খোলা রাখা হয়। পোশাক বিক্রিটাই হচ্ছে আমাদের মূল আয়ের উৎস। বিক্রি যদি না হয় তাহলে কর্মীদের বেতন দেব কীভাবে? গতবার যখন মার্কেট বন্ধ ছিল তখন কোনোভাবে কর্মীদের বেতন চালিয়ে যেতে পারছি। কিন্তু এবার কী হবে তা বুঝতে পারছি না।”

এ বিষয়ে আজিজ সুপারমার্কেটের দোকান-মালিক-ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক উজ্জ্বল আকাশ বলেন, “আমাদের একটি শোরুম টিকে থাকে উৎসবের ওপর নির্ভর করে। আমাদের নিজেদের খরচ আছে, তাঁত চালাতে হয়, কারখানা চলাতে হয়। ওইখানে একটা বড়সংখ্যক কর্মীকে বেতন, কারখানা ভাড়াসহ বিভিন্ন জিনিস দিতে হয়। আমরা এই পুরো জিনিসটা পরিশোধ করি ঈদের ও বৈশাখের মতো উৎসবের বেচাকেনার অর্থ দিয়ে। কিন্তু এবার রোজার মধ্যে বৈশাখ পড়ায় উৎসব তো নেই, তার ওপর আবার লকডাউন। সুতরাং এই লকডাউনটা হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমাদের যে ক্ষতি হবে, সেটি পোষানোর মতো না।”