• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০১:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০৪:১১ পিএম

বন্ধ গণপরিবহন, বিপাকে শ্রমিকরা

বন্ধ গণপরিবহন, বিপাকে শ্রমিকরা

রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তায় একের পর এক ছুটে চলছে যানবাহন। রিকশা থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার, পণ্যবাহী ট্রাক থেকে স্টাফ বাস সবই চলছে রাস্তায়, নেই শুধু গণপরিবহন। শহরতলি কিংবা দূরপাল্লার—কোনো বাসই চলছে না চলমান লকডাউনে। তাই সারা দিন লোকে লোকারণ্য থাকা বাস টার্মিনালটিও দাঁড়িয়ে আছে স্থির। টার্মিনালের ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি বাস।

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে গণপরিবহনের চাকা না ঘোরায় বন্ধ হয়ে গেছে পরিবহন শ্রমিকদের আয়ের পথ। সঞ্চয় যা ছিল, তা-ও শেষ বেশির ভাগের। সরকারের পক্ষ থেকেও মেলেনি কোনো ত্রাণ বা আর্থিক অনুদান। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছেন গণপরিবহন শ্রমিকরা।

সরেজমিনে মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, কাজ না থাকায় টার্মিনালের ভেতরেই ছায়ায় শুয়ে বসে আছেন পরিবহন শ্রমিকরা। কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউ দল বেঁধে গল্প করছেন, কেউ আবার নিজের বাসটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। কিন্তু সবারই মুখ বিষণ্ণ। কীভাবে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেবেন সেই চিন্তা করতে করতেই অপেক্ষা করছেন গণপরিবহন চালু হওয়ার।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ জারি করে সরকার। ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই বিধিনিষেধ চলবে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত। এরই মধ্যে জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে মার্কেট-শপিং মল খোলাসহ বিভিন্ন বিষয় শিথিল করা হলেও শুরু থেকে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। ফলে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে চালক-হেলপারসহ পরিবহন শ্রমিকদের।

পরিবহন শ্রমিকদের কথা

ঢাকা-শেরপুর রুটে চলাচলকারী হাজী বাসের সুপারভাইজার মো. সোহাগ। ‘লকডাউনে’র আগে দৈনিক আয় করতেন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা। এখন টার্মিনালে গাড়ি পাহারা দেওয়া জন্য দৈনিক খোরাকি বাবদ পান মাত্র ৩০০ টাকা। অথচ বাড়িতে তার মা, বাবা, ভাই, বোন মিলে মোট পাঁচ সদস্য রয়েছে।

সোহাগ বলেন, “প্রায় ১০-১২ দিন ধরে গাড়ি বসা। মালিক-মহাজনরা চেষ্টা করছেন আমাদের কিছু দেওয়ার। শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রতিদিন ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এই দিয়ে নিজে কোনোভাবে চললেও বাড়িতে কিছু পাঠাতে পারি না। পরিবারের লোকজন খুব কষ্টে আছে। তাই দ্রুত গণপরিবহন চালুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।”

কয়েক বছর ধরে ঢাকা-নেত্রকোনা রুটে শাহজালাল পরিবহনের বাস চালান মো. ইউসুফ মৃধা। পরিবহন শ্রমিকদের মতো কঠিন অবস্থায় আর কেউ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে আছি। সরকারি অনুদান বা সাহায্য-সহযোগিতা কোনো কিছুই আমরা পাই না। বাস মালিক সমিতির সহযোগিতায় কোনোভাবে চলছি।”

এই চালক ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, “প্রতিবার পরিবহনের ওপরই চাপটা আসে। পরিবহন শ্রমিকদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এখনো লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ, কিন্তু বাকি সবই চলছে। রাস্তায় যানজট আছে। ট্রাক, প্রাইভেট কার, এটা-সেটা সবই চলছে, দোকানপাট খোলা আছে। অবস্থা দেখে মনে হয় শুধু গণপরিবহনে করোনা বেশি।”

মো. ইউসুফ মৃধা আরও বলেন, “গতবার লকডাউনে শুনছি সরকারি অনুদান আসবে, এই আসবে, সেই আসবে। আমরা মোবাইল নম্বর দিয়েছে, তথ্য দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত কিছুই আর আসেনি। এই বছরও সরকারি অনুদান পাওয়ার কথা শুনতেছি। কিন্তু মনে হয় না এ বছরও কিছু পাব। আর পাওয়ার চিন্তাভাবনাও আমরা করি না। সরকার লকডাউন তুলে দিলে আমরা কাজ করে বাঁচতে পারি।”

টার্মিনালের ভেতর কয়েকজন মিলে বসে ছিলেন এনা ট্রান্সপোর্টের চালক মো. কালু। তিনি বলেন, “ট্রাক, গাড়ি, মোটরসাইকেল, সিএনজি সবই চলে। শুধু আমাদের বাস বন্ধ। আজকে কত দিন যাবত আমাদের কোনো আয় নেই। কষ্ট করে দিন কাটছে আমাদের। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যও পাই না আমরা। এদিক-সেদিক করে কোনোভাবে চলছি। কখনো কখনো না খেয়েও থাকতে হয়। কবে বাস চলবে আল্লাহ জানে।”

ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের বাস জাকির ট্রাভেলসের চালক মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, “আল্লাহ যেভাবে চালায় সেভাবে চলি। রাস্তায় সবই চলতেছে, শুধু গণপরিবহনের জন্য লকডাউন। কাজ শিখছি শুধু এই একটা। চাইলেও আমরা ধান কাটতে বা রিকশা চালাতে পারব না। এখন আমাদের পরিবহন যদি না চলে তাহলে এভাবে অসহায়ের মতো বসে থাকতে হয়। আগে জমানো যা ছিল তা-ও শেষ হয়ে গেছে। এখন দিন যত যাচ্ছে, পরিস্থিতি তত খারাপ হচ্ছে।”

বিনিময় বাসের চালক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “পরিবহন সেক্টরটা এখন সরকারি সেক্টর হয়ে গেছে। এখন সরকার যদি আমাদের কোনো অনুদান না দেয়, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করে না যে, আমরা পরিবার নিয়ে কীভাবে চলছি? কী খাচ্ছি? শুধু ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা আমাদের দুই মুঠো চালডাল হাতে তুলে দিচ্ছে। তা দিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে ডালভাত, লবণ ভাত খাচ্ছি।

অসহায় পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট অন্যরাও

মহাখালী বাস টার্মিনালে ফলের জুস বিক্রি করতেন কবির। লকডাউনের আগে ভালোই বেচাকেনা ছিল তারা। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার বেচাবিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে আয়ের উৎস।

কবির বলেন, “গণপরিবহন বন্ধ, আমার আয়ও বন্ধ, কিন্তু খাওয়া তো বন্ধ নেই। বাসা ভাড়া দেওয়া বন্ধ নেই। আয় না থাকায় তিন বেলার জায়গায় এক বেলা খাই। সরকার আমাদের ভালোর জন্য ‘লকডাউন’ দিলেও আমরা সেটা বুঝি না। কী করে বুঝব আমাদের পেটে যে খিদা। খিদার কারণে মানুষ কী না করতে পারে। তাই নিয়ম সাপেক্ষে গণপরিবহন খুলে দেওয়া দরকার।”

শ্রমিক নেতাদের দাবি

ঢাকা জেলা বাস মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, “সারা দেশে সবকিছু চলমান, শুধু আমাদের গণপরিবহনটা বন্ধ। গণপরিবহনটা যাতে আগামীতে চলতে পারে, সরকারের কাছে আমাদের বিশেষ আবেদন, আমরা বিধি মেনেই স্বল্পসংখ্যক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালাতে রাজি আছি। যদি সরকার আমাদের এই সুযোগ দেয়, তাহলে দেশের ৭০ লাখ শ্রমিক খেটে-খেয়ে তাদের পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারবে।”

সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুদান পরিবহন শ্রমিকরা পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “লকডাউন শুরুর পর থেকে আমরা শ্রমিকদের দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। এখন রোজা আসার পর আমরা ৩০০ শ্রমিকের ইফতারের ব্যবস্থা করছি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি মহাখালী বাস টার্মিনালে ১২০০ শ্রমিকের মধ্যে চাল-ডাল ত্রাণ বিতরণ করেছে।”

করোনার সংক্রমণ রোধে জারি করা ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ সড়কে সব ধরনের যানবাহনই চলাচল করছে। খুলে দেওয়া হয়েছে মার্কেট-শপিং মল। তাই পরিবহন শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলে অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিক ও নেতারা।