• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২১, ০৪:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৪, ২০২১, ০৯:৩৫ এএম

করোনা সংক্রমণ

​​​​​​​‘লকডাউনে’ কাজ হচ্ছে কি?

​​​​​​​‘লকডাউনে’ কাজ হচ্ছে কি?

চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি ঘটেছে। গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের উপরে, তবে সম্প্রতি তা কমে নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। কমতে শুরু করেছে দৈনিক মৃত্যুর হারও। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ‘লকডাউন’ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে বলে অভিমত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

গত বছর মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে ওই মাসে। এরপর এপ্রিল-মে মাসে সংক্রমণ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেলে টানা ৬৬ দিন লকডাউনে ছিল গোটা দেশ। পরবর্তীকালে সংক্রমণ হার কমতে থাকলে তুলে দেওয়া হয় লকডাউন। অক্টোবরের শেষ দিকে সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহতও থাকে।

কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফের আছড়ে পড়ে করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। প্রতিদিন বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। এমনকি একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডও সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রথমে কঠোর বিধিনিষেধ ও পরে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ জারি করে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় যা পরবর্তীকালে বেশ কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের চিত্র

মার্চ মাসের শুরুর দিকে করোনায় দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর হার ছিল একেবারেই কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২ মার্চ একদিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন মাত্র ৫১৫ জন। একই সময়ে মারা গিয়েছিলেন মাত্র ৭ জন। ওইদিন পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

এর একদিন পরই মৃত্যুর সংখ্যা ৫ জনে নেমে আসে। ওইদিন আক্রান্ত হয়েছিল ৬১৪ জন। দৈনিক পরীক্ষা বিবেচনায় প্রতি শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমকি ৭৪। এরপর ধীরে ধীরে এই হার বাড়তে থাকে। গত ১৮ এপ্রিল দৈনিক আক্রান্তের হার বেড়ে ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে পৌঁছায়। ওইদিন করোনায় প্রাণ হারিয়েছিল ১৬ জন, আক্রান্ত হয়েছিল ২ হাজার ১৮৭ জন।

দৈনিক পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় ১ এপ্রিল। ওইদিন আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৪৬৯ জন। মারা যান ৫৯ জন। দৈনিক পরীক্ষা হিসেবে ওইদিন প্রতি আক্রান্তের হার ছিল ২২ দশমিক ৯৪। এর মাত্র চারদিন পরেই দৈনিক শনাক্তের হার সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৪০-এ গিয়ে পৌঁছায়। ওইদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭ হাজার ৭৫ জন। প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫২ জন।

গত ৭ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের ঘটনা ঘটে। ওইদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭ হাজার ৬২৬ জন। প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬৩ জন। দৈনিক পরীক্ষা বিবেচনায় আক্রান্তের হার ছিল ২২ দশমিক ০২ জন।

আর দেশের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ১৯ এপ্রিল। ওইদিন করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান ১১২ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪ হাজার ২৭১ জন। পরীক্ষা বিবেচনায় ওইদিন শনাক্তের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬৮।

এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমতে থাকে। সর্বশেষ গত ২ মে একদিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ৩৫৯ জন। মারা গিয়েছিলেন ৬৯ জন। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৮৬।

কঠোর বিধিনিষেধ ও ‘সর্বাত্মক লকডাউন’

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছিল সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল গণপরিবহন ও শপিংমল। কিন্তু অফিস-আদালত ও শিল্প কারখানা খোলা থাকায় সেটি তেমন একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ব্যবসায়ীদের দাবীর মুখে দোকানপাটও খুলে দেয় সরকার।

পরবর্তীকালে গত ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশজুড়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ জারি করা হয়। এবার গণপরিবহনের পাশাপাশি বন্ধ করা হয় সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। দোকানপাটও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সময়ের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ‘লকডাউনে’র মেয়াদ আরো সাতদিন বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল করা হয়। তবে জীবন ও জীবিকার কথা চিন্তা করে গত ২৫ এপ্রিল খুলে দেওয়া হয় মার্কেট-শপিংমল। তবে আগের মতোই গণপরিবহন ও সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ রাখা হয়।

দ্বিতীয় ধাপের ‘লকডাউন’ শেষ হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে চলমান বিধিনিষেধ আরো সাতদিন বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ ৩ মে সংক্রমণ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আরো একধাপ ‘লকডাউন’ বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিধিনিষেধ চলবে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত। তবে এবার নিজ জেলার মধ্যে ট্রেন ও লঞ্চ বাদে অন্যান্য গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আগের মতোই বন্ধ থাকবে বাস।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে চলমান ‘লকডাউন’ ৭০ শতাংশ কার্যকর হয়েছে বলে মনে করছেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, “এর মধ্যে দিয়ে সংক্রমণের যে ধারাবাহিকতা বা চেইন অব ইনফেকশন রয়েছে তাতে ছেদ পড়েছে বা ধারাবাহিকতাটা ভেঙে গেছে। যার কারণে সংক্রমণটা কমতে শুরু করেছে।”

ডা. লেলিন চৌধুরী আরো বলেন, ‍“লকডাউন দিয়ে যে সংক্রমণ কমানো যায়, সেটি আগেও প্রমাণিত হয়েছে, এখন আবার প্রমাণিত হলো। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, লকডাউন থেকে বেরিয়ে এসে সংক্রমণ কমার ধারাটা ধরে রাখা। এর জন্য আমাদের লকডাউন পরবর্তী পদক্ষেপগুলোকে স্থির করতে হবে।”

ঈদে সংক্রমণ বাড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টা নিয়ে শঙ্কিত। ঈদ কেন্দ্রিক বিশাল জনচলাচল এবং ভিড় সংক্রমণকে ফের বাড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।”

একই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‍“ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে অনেক বেশি জনসমাগম হয়েছে। ওই সময়টায় অনেকগুলো পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছে, বিয়ে হয়েছে, ওয়াজ মাহফিল হয়েছে, মিছিল-মিটিং হয়েছে, পর্যটন স্থানগুলোতে অসংখ্য মানুষ গিয়েছে। তখন বেশিরভাগ মানুষই স্বাস্থবিধি মানেনি। যার কারণে মার্চের দিকে এসে সংক্রমণটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গত ৫ এপ্রিল থেকে যে লকডাউনটা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে যে আন্তঃজেলা গণপরিবহনটা বন্ধ ছিল বলে সংক্রমণ অনেকটা কমেছে।”

ঈদ পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ রাখা উচিত বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তার পরামর্শ, এই মুহূর্তে মানুষের উচিত বাড়ির বাইরে না যাওয়া, ঈদের মার্কেটে না যাওয়া। এখন যদি সব খুলে দেওয়া হয়, তাহলে আবার সংক্রমণ বাড়তে পারে।

ঈদের পরে ক্রমান্বয়ে পরিবহনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালু করলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক কমবে এবং মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।