• ঢাকা
  • রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২১, ০৪:০৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৮, ২০২১, ০৪:০৬ পিএম

পর্ব-২

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ থেকে কীভাবে সুরক্ষা মিলবে

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ থেকে কীভাবে সুরক্ষা মিলবে

ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও ফাঙ্গাসজনিত রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। দেশটিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ও হোয়াইট ফাঙ্গাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই ইয়েলো বা হলুদ ফাঙ্গাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। 

ভারতে অনেক হাসপাতালে ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্তদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড তৈরি করা হয়। মানুষের মধ্যে এই তিন ধরনের ফাঙ্গাস সম্পর্কে আতঙ্ক রয়েছে। 

চিকিৎসকদের মতে, যাদের ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল ছিল। সুস্থ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের এই ফাঙ্গাসে সংক্রমণ হয় না। 

বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাস ও এর সুরক্ষা নিয়ে কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা হয় জাগরণ অনলাইনের। 

ইয়োলো ফাঙ্গাস বা হোয়াইট ফাঙ্গাস:

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, “ব্ল্যাক ফাঙ্গাসটা ভয়াবহ ফাঙ্গাস। ফাঙ্গাস সচরাচর হয় না, হাজার বা লাখের মধ্যে দু-একজনের হয়। ভারতে যেটা হচ্ছে, করোনা সেরে যাচ্ছে এ রকম রোগীদের ক্ষেত্রে হচ্ছে। প্রায় ২৫০ জনের বেশি মৃত্যুও হয়েছে। অনেকের চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে, তার জীবন বাঁচানোর জন্য। অনেকের চোয়াল কেটে ফেলতে হয়েছে।”

এই জনস্বাস্থ্যবিদ আরও বলেন, “ইয়োলো ফাঙ্গাস বা হোয়াইট ফাঙ্গাস এগুলো ফাঙ্গাসের আরেকটা রূপ। আমরা হয়তো কোনোখানে ইয়োলো কালার দেখি। আসলে কালার দিয়ে আমরা নাম বলি না সাধারণত। প্রতিটা ফাঙ্গাসেরই আমাদের আলাদা করে নাম আছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস অনেক পরিচিতি পেয়েছে। আক্রান্ত হলে এটা নাকের কাছে অনেক কালো করে ফেলে। ঠিক একইভাবে হোয়াইট ফাঙ্গাসও, এটা সাধারণত গোল হয়।

“এটাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটা সাধারণ ক্যানডিডাল ইনফেকশন, আরেকটা হচ্ছে মারাত্মক ক্যানডিডাল ইনফেকশন। সাধারণ ক্যানডিডাল ইনফেকশন সাধারণত চামড়ায় বা সারফেসে হয়। যেমন মুখের ভেতরে হয়, ছাতা পড়ে, বাচ্চা ও বয়স্কদের হয়, নারীদের যোনিতে হয়।”

ডা. বে-নজির আরও বলেন, “আরেকটা সিস্টেমিক ইনফেকশন, যেটা ব্লাডে ঢুকে যায়। এবং শরীরের বিভিন্নখানে এটা যায়। এটা খুবই মারাত্মক। এই ফাঙ্গাসে অনেক সময় মৃত্যু হতে পারে। অনেক সময় এটার চিকিৎসাও দেওয়া যায় না। সিস্টেমিক ক্যানডিডাল ইনফেকশন এটা নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক সংক্রমণ। এটা হয় যাদের করোনা হয়েছে। অর্থাৎ কোভিড-পরবর্তী, দ্বিতীয়ত, যাদের ডায়াবেটিস এবং ব্লাড সুগারটা অনিয়ন্ত্রিত ছিল। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো যারা স্টেরয়েড অনেক নিয়েছে। এবং চতুর্থত যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন নিয়েছেন।”

“ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিলিন্ডারে বেশি ঝুঁকি থাকতে পারে। সেগুলো ব্যবহারের পরে মাটিতে পড়ে থাকে, স্যাঁতসেঁতে জায়গায় পড়ে থাকে, সেখানে ফাঙ্গাসটা লেগে থাকতে পারে। সিলিন্ডারের গায়ে লেগে থাকতে পারে, কিংবা নজল, যেটা দ্বারা অক্সিজেনটা বের হয় সেখানে লেগে থাকতে পারে। সেই অক্সিজেনটা যখন দেওয়া হয় সেটা তীব্র বেগে দেওয়া হয়। নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে।”—যোগ করেন তিনি।

“আরেকটা হচ্ছে কোনো অক্সিজেন অর্ধেকটা ব্যবহার করে ফেলে রেখেছে। সেই অক্সিজেনটা আবার অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বা দান করেছেন, ওই সময় এই ফাঙ্গাসটা লেগে থাকতে পারে।”

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সুরক্ষা কীভাবে?

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, “ভারতে মূলত করোনা রোগীরা ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতে করোনা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা রোগী কম হওয়ায় তা ওভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। ভারতে এটা নিয়ে জরুরি অবস্থা হয়েছে। আমাদের এখানে এটা তেমন কিছু না।”

সুরক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. বে-নজির বলেন, “প্রতিরোধ করায় গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন ভারত যেভাবে যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলো আমরা বলতে পারি। যেমন স্টেরয়েড বাজারে যেন বিক্রি না হয়। যে কেউ যেন স্টেরয়েড না খায়। এটা আমাদের বাজারে যে কেউ কিনতে পারে। বাংলাদেশও এটা জারি করে দিতে পারে যে স্টেরয়েড যেন কেউ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেন কোনো দোকানে বিক্রি না করে।”

“দ্বিতীয়ত, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস আমরা যত নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, সব দিক থেকেই ভালো। তৃতীয়ত, হলো করোনা রোগীদের অনেক বেশি স্টেরয়েড দেওয়া যাবে না। সীমিত সময়ের জন্য স্টেরয়েড দেওয়া যাবে। যেটাকে আমরা বলি যথেচ্ছ ব্যবহার অথবা অযৌক্তিক ব্যবহার না করা হয়। অক্সিজেন যখন আমরা দেব, তখন অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক কিংবা যে ক্যাথেটার দ্বারা আমরা অক্সিজেন দেব, সেটাকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।”

আর আমাদের যদি কখনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ব্যবহার করতে হয়, তাহলে যে সিলিন্ডার আছে সেগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। কেননা, এর গায়ে বা নজলে নিউকোর বা মাইক্রোসিস লেগে থাকতে পারে।

চিকিৎসা কী?

এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে জানতে চাইলে ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো তাড়াতাড়ি রোগটা শনাক্ত করা। আমাদের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। করোনা রোগী সুস্থ হওয়ার পরে তাদের যদি আবার ফুসফুসে কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাদের নাকে যদি কোনো সংক্রমণ দেখা দেয়, নাক দিয়ে পানি পড়ছে অথবা চোখে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, করোনা ভালো হওয়ার ১০-১৫ দিন পরে তাহলে চিকিৎসকদের এ সন্দেহ করতে হবে যে এটা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দ্বারা হতে পারে। পরীক্ষা করে বোঝা যেতে পারে। ক্লিনিক্যালিও বোঝা যেতে পারে। মাইক্রোসকোপি করা যায় তাহলে মাইক্রোসকোপির নিচে এই ফাঙ্গাসটা দেখা যায়। এটা কালচারও করা যায়, তখন যদি দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে। এটার চিকিৎসা হলো, এমপোটেরিসিন বি। দুই ধরনের এমপোটেরিসিন বি পাওয়া যায়। একটা সাধারণ এমপোটেরিসিন বি, আরেকটা লাইপোজোমাল এমফোটেরিসিন বি। এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম ও কার্যকারিতা বেশি। এটা আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। কিন্তু এটা বেশ ব্যয়বহুল। ৮-১০ সপ্তাহ দিতে হয় প্রতিদিন এক ডোজ করে দিতে হয়।

যত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হবে সরকারের সবার চিকিৎসা দেওয়া উচিত। বারডেম এটার চিকিৎসা দেয়, বারডেমকেও এটার জন্য শনাক্ত করা যেতে পারে। তাদের যদি ওষুধ ও গাইডলাইন দেওয়া যায়। এর বাইরেও আমাদের ডাক্তারদের এ বিষয়ে স্টাডি করা দরকার, এটা কীভাবে হয়, কাদের হয়, লক্ষণগুলো কী কী, চিকিৎসা কী। এবং এই ওষুধটা যাতে সরকার আগে থেকেই কিনে রাখে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বাংলাদেশে ধরা পড়েছে এই মুহূর্তে করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম আরও বাড়ানো দরকার। ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সাবধান হতে হবে। অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যদি আমরা ঠিকমতো চিকিৎসাটা করতে পারি প্রাদুর্ভাব করতে পারি, তবে এটি বিলুপ্ত কখনো হবে না।
 

আরও পড়ুন