• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২১, ০৫:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১১, ২০২১, ০৫:৫২ পিএম

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছেই ‘মাদকের হাট’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছেই ‘মাদকের হাট’

রাজধানীর কারওয়ান বাজার। সবজি থেকে পোশাক—সবই বিক্রি হয় এখানে। তবে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, এর পাশাপাশি চলে মাদক বেচাকেনা। সবজির মতোই প্রকাশ্যে বসে এই ‘মাদকের হাট’। সেবনও করা হয় প্রকাশ্যে। অথচ মাদক বিক্রির এই হটস্পটের প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয় (উত্তর) ও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র।

কয়েক বছর আগেও কারওয়ান বাজারে গাঁজার ডালা সাজিয়ে বসতেন মাদক ব্যবসায়ীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে এখন সেই চিত্র অনেকটা পাল্টেছে। তবু থেমে নেই মাদক বেচাকেনা। পুরো কারওয়ান বাজারের বেশ কয়েকটি স্পটে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে গাঁজা বিক্রি। আর ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি হয় গোপনে। জাগরণ অনলাইনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কারওয়ান বাজারের মেয়র আনিসুল হক সড়কের টিসিবি ভবনের সামনে থেকে ফলপট্টি হয়ে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত, এফডিসি রেলগেট থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত এবং প্রজাপতি আন্ডারপাস-সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজের নিচে হরদম চলে গাঁজা বিক্রি। প্রতি পুরিয়ার দাম ৭০ টাকা। তবে নতুন ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ১০০ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়া একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম নেওয়া হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে সেটি প্রকাশ্যে বিক্রি করা হয় না। ক্রেতার চাহিদামতো মাদক বিক্রেতারা সরবরাহ করেন। ফেনসিডিলও এনে দেওয়া হয় একইভাবে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারওয়ান বাজারে প্রায় দেড় শতাধিক মাদক বিক্রেতা রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই নারী। এসব নারী শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে মাদক লুকিয়ে রেখে ডেকে ডেকে বিক্রি করে। রাস্তা বা রেললাইন দিয়ে কেউ যাওয়ায় সময় হাঁকডাক দিয়ে জানতে চাইবে ‌‘কয়টা লাগবে’? এতে সাধারণ পথচারীদের অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। তবে যারা মাদকসেবী তারা এই হটস্পট থেকে অনেকটা অনায়াশেই মাদক কিনে নিয়ে যায়। প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হওয়ায় কষ্ট করে বিক্রেতাকে আর খুঁজে বের করতে হয় না তাদের। কিশোর থেকে বৃদ্ধ, সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই আনাগোনা আছে এই ‘মাদকের হাটে’।

মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এসব মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। গ্রেপ্তার করা হয় মাদক বিক্রেতাদের, জব্দ করা হয় মাদক। মাদকসেবীদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হয় ব্যবস্থা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে আবার জমে উঠে এই মাদক কেনাবেচা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত দশ মাসে কারওয়ান বাজার থেকে ১৪৫ জন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০১ জন পুরুষ ও ৪৪ জন নারী। এসব মাদক বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৪৪টি। গাঁজা জব্দ করা হয়েছে ২০ কেজির বেশি, ইয়াবা ২৬৫ পিস ও ফেনসিডিল ২২ বোতল।

সরকারি ওই সংস্থাটি বলছে, এসব মাদক বিক্রেতাদের বেশির ভাগই ভাসমান। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনে বের হয়ে একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আবার মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এই মাদক কারবার পুরোপুরি নির্মূলও করা যাচ্ছে না।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে কারওয়ান বাজারে মাদক বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং পুলিশের সামনে দেদার চলছে মাদক বেচাকেনা। কারও কারও অভিযোগ এ ব্যবসা নির্বিঘ্নে করার জন্য পুলিশকে মাসোয়ারা দেয় মাদক বিক্রেতারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বক্তব্য

কারওয়ান বাজার এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা। তিনি বলেন, ‍“আমরা প্রতিনিয়ত এখানে অভিযান পরিচালনা করেছি। যারা বিক্রেতা আছেন (মহিলা ও পুরুষ) তাদের ধরে নিয়ে মামলা দেওয়া হচ্ছে।”

পুরোপুরি মাদক নির্মূলে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‍“এখানে যারা মাদক বিক্রি করেন, তারা সবাই ভাসমান। কেউ এখানকার বাসিন্দা না। তাদের অনেকে আবার সন্তানসম্ভবা। অনেকের হাতে বা কোলে বাচ্চা থাকে। এখানে মানবিকতার একটা বিষয় কাজ করে। আমাদের আইনে ব্যবস্থা থাকলেও সব সময় আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি না। শত হলেও আমরাও মানুষ।”

মাদক বিক্রির মূল হোতাদের আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না, বলে মনে করেন এই উপপরিচালক। তিনি বলেন, “আমরা যাদের আটক করি তারা সবাই ভাসমান। এসব খেটে খাওয়া মানুষ অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে এই কাজ করে। তারা এই মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের চিনেও না। যারা কারণে আমরাও মূল হোতাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। আজকে একজন বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনলে দেখা যায় কাল সেই জায়গায় আরেকজন বিক্রি করছে। কিন্তু মূল হোতা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই মূল হোতাদের আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। আবার কারওয়ান বাজারে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”

কিছু অসাধু পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয় জানতে চাইলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, “আমি যত দূর জানি পুলিশও এই বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত আছে। তাদের পক্ষ থেকেও মাদকের বিরুদ্ধে খুব ভালোভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের পক্ষ থেকে দুই শিফটে তদরকি করা হচ্ছে। দুই একটা চিত্র হয়তো উল্টো থাকতে পারে।”

তবে মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কারও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান মুকুল জ্যোতি চাকমা।

এই মাদক সমস্যা পুরোপুরি সমাধানের জন্য সামাজিকভাবে পুনর্বাসন প্রয়োজন বলে মানে করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই উপপরিচালক। তিনি আরও বলেন, ‍“ভাসমান এসব মাদক বিক্রেতার বেশির ভাগই খুব অসহায়। অনেক নারী বিক্রেতা স্বামী পরিত্যক্তা। কিন্তু সন্তান আছে দুই-তিনটা। তাদের তো খাওয়া, ভরণ-পোষণ দরকার। তারা কোনো কাজের জন্য এলে আমরা তাদের রাখি না। তাহলে তারা কোথায় যাবে? তাই এই মাদক সমস্যার সমাধান করতে হলে তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের দরকার। তাহলে তারা আর এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে না।”

পুলিশের বক্তব্য

কারওয়ান বাজারে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হয় না বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছে। আগে কারওয়ান বাজারের রেললাইনের পাশে প্রকাশ্যে মাদকের হাট বসত। কিন্তু এখন নেই। লুকিয়ে হয়তো কিছু বিক্রেতা বিক্রি করতে পারে। তবে আমরা এই বিষয়ে কাউকেই ছাড় দিচ্ছি না।”

প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির প্রমাণ দেখালে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “এমন কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দিন। পুলিশ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”

এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন ডিএমপির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।