• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২১, ১১:৩০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৩১, ২০২১, ১১:৩০ এএম

স্মরণঃ

কমরেড মণি সিংহ‍‍`র ৩১তম প্রয়াণ দিবস আজ

কমরেড মণি সিংহ‍‍`র ৩১তম প্রয়াণ দিবস আজ
কমরেড মনি সিংহ। ফাইল ফটো।

টংক আন্দোলনের মহানায়ক কমরেড মণি সিংহ-এর ৩১তম প্রয়াণ দিবস আজ। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম থেকে শুরু করে কলকাতার মেটিয়া বুরুজের শ্রমিক আন্দোলন, ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের অসম সাহসিকতা ও ভূমিকা অবিস্মরণীয়। 

১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কালী কুমার সিংহের মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী সাত বছরের মণি সিংহকে নিয়ে ময়মনসিংহের (বর্তমানে নেত্রকোনা) সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।

সেখানেই ১৯৩৭ সালে টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কমরেড মণি সিংহ। সে সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ এবং শেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে টংক প্রথা চলে আসছিলো। যা দরিদ্র কৃষকদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো। শোষিত কৃষকেরা এই প্রথার বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে একত্রিত হয়। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকেই আন্দোলনের শুরু। উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ১৯৫০ সালে টংক প্রথা ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। 

যদিও মণি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন তারও আগে ১৯২৮ সালে। এ সময় তিনি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকেন। তারও আগে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ কমরেড মণি সিংহ ১৯২৫ সালে প্রখ্যাত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোচনার পর মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেন।

১৯৩০ সালের ৯ মে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-খেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তাঁর দেড় বছরের জেল হয়।

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এলে পার্টির সদস্য বলে তাঁকে জানানো হয়। এরপর দুর্গাপুরে মায়ের সঙ্গে দেখা করে কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে ফিরে যেতে চাইলেও এলাকার মুসলমান কৃষক ও গাড়ো হাজং আদিবাসীরা মণি সিংহকে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। এরপর মণি সিংহ সর্বতোভাবে টংক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কালক্রমে তিনি এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৪১ সালে মণি সিংহকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

১৯৪৪ সালে সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে মণি সিংহকে বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।

১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে পুনরায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে তিনি জেলে থাকাকালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছর ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে তিনি জুলাই মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মনি সিংকে মুক্তি দেয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করেন। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়।

স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিংহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সোচ্চার হন। ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসে মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলাকালে ’৭৭ সালের মাঝামাঝি ৭৭ বছরের মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। জিয়ার শাসনামলে তাঁকে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়।

জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদান ও অনন্য কীর্তির জন্য তাঁকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরনোত্তর) ভূষিত করা হয়।

কিংবদন্তি এই বিপ্লবী ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর স্মরণে প্রতি বছর তার মৃত্যু দিবসে নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুরে টংক স্মৃতি স্তম্ভ প্রাঙ্গণে সাতদিন ব্যাপী কমরেড মণি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

এসকেএইচ//