• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২২, ০৮:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৪, ২০২২, ০৮:৪২ পিএম

কুষ্টিয়ার খাজানগরে ৫ বছরে ৫০টির বেশি চাউল বোঝাই ট্রাক উধাও!

কুষ্টিয়ার খাজানগরে ৫ বছরে ৫০টির বেশি চাউল বোঝাই ট্রাক উধাও!
ছবি- জাগরণ।

মহাসড়ক থেকে চাউল বোঝাই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান উধাও হয়ে যায়। মিল মালিকরা তিন থেকে চার দিন পর জানতে পারেন তাদের ট্রাক উধাও হয়ে গেছে। কোনও কুল কিনারা করতে পারেন না। মাসের পর মাস এমন আতঙ্ক নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামের চাল ব্যবসায়ীদের। ট্রাক উধাওয়ের মত ঘটনা ঘটে চললেও তা উদ্ধার হয় না বললেই চলে।

সর্বশেষ গত তিন মাসে নুর অটো রাইস মিলের দুটি চাউল বোঝাই ট্রাক গায়েব হয়ে গেছে। যার কোনও কুল-কিনারা হয়নি। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার মিল গেট থেকে একটি কাভার্ড ভ্যানে চাল বোঝাই করে নারায়নগঞ্জ জেলার উদ্দেশে রওনা হয়। সাড়ে ৮ লাখ টাকার বাসমতি চাল বোঝায় ছিলো কাভার্ড ভ্যানে। মালিক ৪দিন পর শুক্রবার জানতে পারেন তার চাউল পৌঁছায়নি। এরপর তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। থানায় অভিযোগ করেন, তবে এখনো তার চাউল ও ট্রাকের কোনও হদিস মেলেনি।

নুর অটো রাইস মিলের মত গত ৫ বছরে অন্তঃত ৫০টির বেশি চাউল বোঝাই ট্রাক উধাও হয়ে গেছে। তার মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিনটি ট্রাকের হদিস মিললেও বাকিগুলোর ব্যাপারে কোনও কুল-কিনারা হয়নি। এ অবস্থায় খাজানগর মোকামের মিল মালিকরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর মাধ্যমে এ চক্রের সদস্যদের ধরার দাবি জানিয়েছেন।

নুর অটো রাইস মিলের মালিক আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত তিন মাসের মধ্যে আমার দুটি চাউল বোঝাই ট্রাক উধাও হয়ে গেছে। যার কোনও খোঁজ হয়নি। আগের বার সাড়ে ৭ লক্ষ টাকার চাল ছিল, আর এবার বাসমতি বোঝাই চাউল ছিল যার দাম সাড়ে ৮ লক্ষ টাকা। ব্যাংকের ১৬ কোটি টাকা লোন। এখন তিন মাসে ১৫ লক্ষ টাকার চাউল হারিয়ে এখন আমার পাগল হওয়ার মত অবস্থা। শরীরের অবস্থা ভালো না। গত কয়েকদিন ধরে নিজের লোক দিয়ে ঢাকাসহ নানা জায়গায় খোঁজ করে কোনও হসিদ করতে পারিনি। পুলিশ ও র‌্যাবকেও জানিয়েছি।

নুর অটো রাইস মিলের ট্রাক ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার হারিয়ে যাওয়ার পর খবর পান ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার। ওই দিনই কুষ্টিয়া মডেল থানায় দালালদের নামে জিডি করা হয়। এই কাভার্ড ভ্যানে চাউল ছিল ৪৭০ বস্তা। মিল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাউল বোঝাই ট্রাক ছিনতাই ও উধাওয়ের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘ সময় ধরে এটি হয়ে আসছে। এর পেছনে বড় কোনও চক্র রয়েছে। কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকাম এলাকার কেউ কেউ এ চক্রে জড়িত থাকতে পারে। স্থানীয় চক্রের হাত ছাড়া একের পর এক এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়।

মালিকরা বলেন, ‘খাজানগর এলাকার যারা অটো রাইস মিলের মালিক তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিবহন রয়েছে। তবে অনেক সময় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সংকট হলে স্থানীয় দালাল অফিসের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি নুর অটো রাইস মিলের যে দুটি ট্রাক উধাও হয়েছে তা সংগ্রহ করা হয় স্থানীয় দালাল অফিসের মাধ্যমে। খাজানগরের দোস্তপাড়া এলাকায় দালাল অফিস রয়েছে। এখানে রাশেদ ও মহিদুল, মনো নামের কয়েকজন কাজ করেন। তারা মিলগুলোতে যোগাযোগ রাখেন, মালিকরা পরিবহন চাইলে সংগ্রহ করে দেন। কমিশন পান এ জন্য। রাশেদ ও মহিদুল আবার কুষ্টিয়া শহরের সঞ্জয় নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে এ পরিবহন সংগ্রহ করে চালকল মালিকদের কাছে নিয়ে আসেন।

গত ৪ জানুয়ারি নুর অটো রাইস মিল থেকে যে চাউল কাভার্ড ভ্যানে বোঝায় করা হয় সেটির রেজিঃ নম্বর ছিলো ঢাকা মেট্রো ট- ১৫-২২৫৭, ইঞ্জিন নম্বর ছিল বি৫, ৬২৬২৭৮২৯৯৯। ড্রাইভারের নাম রানা আহমেদ। উত্তরার ঠিকানা দেয়া হয়। ট্রাক বিকেলে মিলে ঢুকে রাতে বেরিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরায় সে ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। চাউল হারানোর পর বিআরটিএ অফিসে কাগজপত্র নিয়ে গেলে তারা জানায় এগুলো ভুয়া।

একইভাবে তিন মাস আগে যে গাড়িতে চাল পাঠানো হয় তার কাগজপত্র ভুয়া ছিল। সেই ট্রাক সংগ্রহ করেন মনো নামের এক দালাল। একইভাবে সম্প্রতি সময়ে আব্দুল্লাহ অটো রাইস, দাদা অটো রাইস, মামুন এগ্রোসহ আরো কয়েকটি মিল মালিকের চাউল উধাও হয়ে গেছে। আবার একই সময়ে দাদা রাইস মিলের ধান বোঝায় একাধিক ট্রাকও উধাও হয়ে গেছে মহাসড়ক থেকে। প্রতিটি ঘটনায় কোনও কোনও চক্রের হাত রয়েছে বলে মিল মালিকরা মনে করছেন।

একের পর এমন ঘটনায় শঙ্কিত মিল মালিক ও মিল মালিক সমিতির নেতারা। কুষ্টিয়া মেজর অটো এন্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির একাংশের সাধারন সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘চালকল মালিকদের এমনিতেই নানা সংকট রয়েছে। তার ওপর নতুন আতঙ্ক ট্রাক হারিয়ে যাওয়া। এতে করে লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। আবার থানা পুলিশ করেও অনেক সময় হদিস মিলছে না। একটি শক্ত সিন্ডিকেট এর পেছনে রয়েছে। পুরো চক্রকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।’

এর আগে নুর অটো রাইস মিলের প্রথম যে ট্রাকটি খোয়া গিয়েছিল তাতে চাল ছিল সাড়ে ৭ লাখ টাকার। সে সময় মিল মালিকরা বিচার বসান। এতে করে দালাল মনো, মহিদুল ও রাশেদের জরিমানা করা হয় ৪ লাখ টাকা। মনোর একাই দেড় লাখ টাকার ওপরে জরিমানা করা হয়। তবে বাকি ৪ লাখ টাকা আর ফেরৎ পাননি তিনি।

চালকল মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, সম্প্রতি সময়ে চাউল বোঝাই ট্রাক হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। একই সাথে ধান বোঝাই ট্রাক ছিনতাই হচ্ছে। বিষয়টি মিল মালিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। নুর অটো রাইস মিলের মালিক আমিরুল ইসলামের পর পর দুটি ঘটনা ঘটলো। এর পেছনে স্থানীয় চক্রের সদস্যরা জড়িত বলে আমরা আইন শৃংখলা বাহিনীকে জানিয়েছি। আর যেসব গাড়িতে চাল যাচ্ছে তাদের কাগজপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই সেগুলো নকল। এতে করে চাউল হারিয়ে যাওয়ার পর তাদের হসিদ মিলছে না।

মিল মালিকরা জানান, এসব চাল ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে থাকে চক্রের কাছ থেকে। তারা কম দামে চাল কিনে আবার অন্যদের কাছে বিক্রি করে আসছে। কুষ্টিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়া চাউল সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি মার্কেট থেকে উদ্ধার করা হয়। বছরে কোটি কোটি টাকার চাল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক ব্যবসায়ী পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অনেকে ব্যাংক লোন সময় মতো পরিশোধ করতে পারছে না। কুষ্টিয়া মডেল থানায় ট্রাক হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাব্বিরুল আলম বলেন, ‘চাল বোঝায় ট্রাক উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় কয়েকটি অভিযোগ পড়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের টিম কাজ করছে। দালালদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাইরেও খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। এর আগে এক মালিকের বেশ কিছু খোয়া যাওয়া চাউল উদ্ধার করা হয়েছে।

 

এসকেএইচ//