• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২২, ১২:০১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৯, ২০২২, ০৬:১৫ এএম

একটি গাছেই মিলবে ২০০ জাতের আম!

একটি গাছেই মিলবে ২০০ জাতের আম!
ছবি- জাগরণ।

রাজশাহী ব্যুরো// 
শখের বসে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আম পেতে অনেকেই একটি গাছে একাধিক জাতের সমন্বয় রাখেন। তাই বলে একটি গাছে ২০০ জাতের আম! এমনই এক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কয়েকমাস আগে সার্কিট হাউস চত্বরের একটি পুরাতন গুটি জাতের আমগাছের ডালপালা কেটে দুইশ জাতের আমের গ্রাফটিং বা কলম করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রাফটিং করা একেকটি ডালগুলোতে বের হয়েছে হরেকরকম জাতের আমের নতুন ডালপালা ও পাতা। 

কয়েক দশকের পরিত্যক্ত একটি বড় ও পুরাতন গাছে দুইশ জাতের আমের বিশাল সংগ্রহশালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন, সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ। জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, এই উদ্যোগের ফলে একদিকে যেমন প্রায় সবগুলো আমের সংগ্রহশালা তৈরি হবে, তেমনি অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের রাজধানী হিসেবে পর্যটন খাতেও ভূমিকা রাখবে। ফলন আসলে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকেও রেকর্ড করবে এই আমগাছ বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব (আম) গবেষণা কেন্দ্র, মনামিনা কৃষি খামার ও বিভিন্ন কৃষকদের থেকে সায়ন সংগ্রহ করা হয়েছে এই দুইশ জাতের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসে ঢুকতেই মূল ফটক পেরিয়ে বাম দিকেই এই গাছ। বিশাল বড় আমগাছকে কেটে ছোট করা হয়েছে। সেখান থেকে বের হওয়া নতুন কচি ডালে করা হয়েছে দুইশ জাতের গ্রাফটিং। ইতোমধ্যে গ্রাফটিং বা কলম থেকেও বের হয়েছে হরেকরকম জাতের ডালপালা। 

আম বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে জটিল কোন সমীকরণ নেই। একটি গাছে যতধরনের কলম করা হবে, ঠিক ততো ধরনের বা জাতের আম ধরবে। সংশ্লিষ্টদের আশা, কয়েক মাস পরের আগামী মৌসুম থেকেই আমের ফলন আসবে। যেহেতু নানা জাতের সমাহার থাকবে, ফলে বছরজুরে গাছটিতে ঝুলবে আম। কোন কৃষক বা উদ্যোক্তা চাইলেই এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন চাহিদামতো একাধিক জাতের ডাল বা সায়ন। গাছটিতে গ্রাফটিং বা কলম করার সময় আলাদাভাবে চিহ্নিত করা আছে জাতগুলোর নাম। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব (আম) গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী প্রায় ২০টি দুর্লভ জাতের সায়ন দিয়েছেন এই গাছে গ্রাফটিং করার জন্য। তিনি বলেন, একটি গাছে দুইশ জাতের আম হবে কি না, এটা নিয়ে জটিল কোন সমীকরণ নেই। কারন একটি গাছে যতগুলো গ্রাফটিং করা হবে, ততো জাতের আম ধরবে৷ সায়ন সংগ্রহ করে সঠিক উপায়ে গ্রাফটিং বা কলম করার বিষয়টিই এখানে মুখ্য। 

এই আম বিজ্ঞানী আরও বলেন, এই উদ্যোগের ফলে অনেকগুলো জাতের জামপ্লাজম একটি গাছে সংগ্রহীত থাকবে। এতে জায়গাও কম লাগবে। আম গবেষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের চাহিদামতো খুব সহজেই সংগ্রহ ও গবেষণা করতে পারবে। তবে এধরনের উদ্যোগের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা খুবই কম বলে জানান তিনি। 

যেসব জাতের আম থাকবে- 
প্রচলিত বা পরিচিত জাতগুলো ছাড়াও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাম দেয়া প্রায় একশ জাতের আম থাকবে এই গাছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো- ফজলি, বোম্বাই ফজলি, সুরমা ফজলি, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, লখনা, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, রাণী পছন্দ, ক্ষিরসাপাত, হিমসাগর, হাঁড়িভাঙ্গা, বারি আম-২, বারি-৩, মোহনভোগ, ক্ষিরমন, দুধস্বর, তোতাপুরী, গৌড়মতি, বোম্বাই, সুন্দরী, সুবর্ণরেখা, কালাপাহাড়, বউ ভুলানী, জমরুদ, অরুনা, চৌষা, রাজভোগ, কোহিতুর, বিলু পছন্দ, কাগরী, চিনিবাসা, দুধকুমার, মন্ডা, সীতাভোগ, শোভা পছন্দ, গৃঠাদাগী, লতিকা, রহনপুরি, হরমতি, ঘিনা, দিয়াড়, হেনা, জয়শ্রী, গৌড় পছন্দ, ইলামতি, রানিভোগ, পার্সী, আবির, সিন্নি, দিলখোস, শিমুলতলী, জৈষ্ঠ্যমধু, তৃপ্তিভোগ, মনমচকা, গৌড়সুন্দর, তরুলতা, জৈষ্ঠ্যিভোগ, লাবন্য, চাঁপাই সুন্দরী, কুমড়াজালি, তসলিম পছন্দ, মধুমঞ্জরি, চিনিখাজা, চন্দন, মনমোহিনী, স্বর্ণকেশর, চিতাই, মাসকলাই, কলমিলতা, বালাকা, মনময়ূরী, ভোলাভোগ, বেরকটি, জায়ান, ক্ষণিকা, অরনি, সিমকি, মধুমতি, মমতাজ, ফুলকিসহ প্রায় দুইশ জাত। 

সার্কিট হাউসের নিরাপত্তাকর্মী নাসিম আল আরাফাত জানান, গাছটিতে গুটি জাতের আম ধরতো। খেতেও তেমন ভালো ছিল না। তাই জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ স্যার আম গবেষকদের ডেকে এখানে দুইশ জাতের কলম করেছেন। এটি খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। কারন সার্কিট হাউসে বাইরে থেকে অনেক ভিআইপি লোকজন আসে। এখন থেকে তারা এখানে আসলে গাছটি দেখে মুগ্ধ হবে এবং সারাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসের মালি মোজাম্মেল হোসেন সবচেয়ে ভালো চেনেন এখানকার প্রত্যেকটি গাছ। তিনি বলেন, গাছটিতে তেমন আমের ফলন হতো না। আবার ভালো জাতেরও না। তাই ডিসি স্যার সিধান্ত নিয়েছিলেন গাছটি কেটে সেখানে বের হওয়া নতুন ডগায় দুইশ জাতের গ্রাফটিং বা কলম করা হয়েছে। প্রায় সবগুলো জাতের গ্রাফটিং থেকে নতুন ডালপালা বের হয়েছে। 

পথচারী দুরুল হোদা জানান, দেখা তো দূরের কথা, জীবনেও এমন কোন গাছ দেখিনি। দুইশ জাতের আম দিবে একটা গাছে এটা আমার ভাবনারও বাইরে ছিল। শিবগঞ্জ উপজেলার দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের উত্তর জগন্নাথপুর গ্রামের আমচাষী তোহরুল ইসলাম বলেন, উদ্যোগটা স্যতিই ভালো। এরচেয়ে বেশি ভালো সবার জন্য গাছের সায়ন সংগ্রহ করতে দেয়ার বিষয়টি। এর ফলে আমরা (আমচাষী) খুব সহজেই একাধিক জাতের ভালো ও দামি আমের সায়ন সংগ্রহ করে গ্রাফটিং করতে পারবো।

শিক্ষানবিশ চিকিৎসক পলাশ আলী জানান, এই উদ্যোগের ফলে গাছটিতে সারাবছর কেন না কোন জাতের আম থাকবে। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা দেশী-বিদেশী মানুষের জন্য এটি অত্যান্ত ভালো লাগার বিষয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য এই উদ্যোগটি গর্বের বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

কলেজছাত্র বাবু আলী বলেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা এমন অদ্ভুত উদ্যোগের কথা জানতে পারি। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ এমন উদ্যোগ নেয়া হবে সেটি আমাদের ভাবনারও বাইরে ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আমের রাজধানী বলা হয়। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের ফলে তা আরও প্রস্ফুটিত হল। ধন্যবাদ, জেলা প্রশাসনকে একটি গাছে ২০০ জাতের আম গ্রাফটিং করার মতো এমন উদ্যোগের জন্য।  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, জেলার আমের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে এমন উদ্যোগ। দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে জেলার আমভিত্তিক পর্যটন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জন্য একটি গাছে ২০০ জাতের আম অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে জানান তিনি। 

ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের উদ্যোক্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ মুঠোফোনে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১০০টি জাতের নামকরণ করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। প্রচলিত জাতগুলো ছাড়াও এসব নতুন নাম দেয়া জাতের আম সংগ্রহে রাখাও এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। পৃথিবীর কোথাও এমন নেই যে, একটি গাছে এতগুলো জাতের আম রয়েছে। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর্যটনকে আকর্ষণ করবে। এতে জেলার পর্যটন খাত সমৃদ্ধ হবে। 
 

 

এসকেএইচ//