• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০১৯, ০৮:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৯, ২০১৯, ০২:৪৪ এএম

 আমাদের প্রয়োজনে পহেলা বৈশাখ বাঁচিয়ে রাখতে হবে 

 আমাদের প্রয়োজনে পহেলা বৈশাখ বাঁচিয়ে রাখতে হবে 

নববর্ষ উদযাপনের রীতি কোনো জাতির অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে। ধারণ করে জাতিগতভাবে কতো সমৃদ্ধ তার উন্মেষ কিংবা বিকাশের ধারা। কালে কালে এই উদযাপন রং পাল্টায়, বর্ণ পাল্টায়, বৈচিত্র্যময় হয়- আগ্রাসনে অবরুদ্ধ হয়, তবু তার ভেতরে জেগে থাকে, নতুন করে জেগে ওঠার প্রেরণা। এই জেগে ওঠার প্রেরণা মানুষকে উজ্জীবিত করে জাতীয়তাবোধে, উদ্দিপীত করে জাতিসত্তা বিধ্বংসীকারী অপশক্তি রুখতে। যেমন বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জাতিসত্তা যখনই আক্রান্ত হয়েছে অপশক্তির আগ্রাসনে কিংবা সংকট উপস্থিত হয়েছে আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে তখন এই নববর্ষ উদযাপন আমাদের পথ দেখিয়েছে ধ্রুব নক্ষত্রসম। শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে তাই বারবার ফিরতে হয়েছে এই ‘নববর্ষ` উদযাপনের কাছে।

দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে নববর্ষ উদযাপনের বিভিন্ন রীতি রয়েছে। সে উদযাপনের প্রকৃতি, রীতি আলাদা বটে তবে দিনটিকে ঘিরে পুরনো জঞ্জাল ভুলে নতুন প্রত্যাশাকে স্বাগত জানানোর স্পৃহাটা চিরন্তন। এই বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে এর যোগসূত্র। প্রাচীন কৃষি সমাজে শীতের পাতা ঝরা দিন শেষে নতুন করে ধরনীর জেগে ওঠার সাথে এর সম্পর্ক ছিল। সাড়ে তিনশ বছরের আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে দিনটিকে এদেশের জনগণের ‘নওরোজ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবক্তা। কারো মতে লক্ষন সেন। `কিতাব উল হিন্দ` গ্রন্থে আল-বেরুনী প্রাচীন ভারতবর্ষে হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ ইত্যাদি নানা অব্দ পালনের উল্লেখ করেছেন। `পাল` শাসনামল তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী হলেও তারা নিজস্ব কোনো অব্দ তৈরি করে নি। লক্ষন সেন তার রাজত্ব কালে `লক্ষনাব্দ` তৈরি করে। সম্রাট আকবরের সময়কালে হিজরি সন প্রবর্তিত থাকলেও তিনি চান্দ্র ও সৌর বছরের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস নেন। ফসল কাটা শুরুর সময়ের সমন্বয় সাধনার্থে তিনি যে সৌর বছর প্রবর্তিত করেন  তার গণনাও শুরু হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকেই।

খুব সম্ভবত ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের বিপরীতে এদেশের পরাধীন জনমানসে আত্মপরিচয় সন্ধানী জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল ‘বাংলা-নববর্ষ’কে ভিন্ন আঙ্গিকে পালনের মাধ্যমে। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ মুসলিম মানসে তা অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে নি বিশেষ।   ফলে ‘ পহেলা বৈশাখ ’ দীর্ঘকাল হয়ে ছিল বাঙালি হিন্দুর উৎসব। কিন্তু বাঙালির জাতিসত্তার অহংকারে উচ্চকিত হয়ে এই দিনের পুরো দৃশ্যপটটি ধীরে ধীরে আপন মহিমায় ভাস্বর হতে থাকে ‘৪৭ পববর্তী সময়ে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা কতটা সঠিক ছিল বা বেঠিক সে বিতর্কে না গিয়েও এখানে বলা যায়, এ ধারণাতেই তো একটি ভূখণ্ড ভাগ হয়েছিল। ভাগাভাগির পরেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আসল চেহারা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে বাঙালীর জাতিসত্তাকে আক্রমণের মাধ্যমে। সে চেহারা উপনিবেশবাদী, ধর্মান্ধ, উগ্র সাম্প্রদায়িক।  সর্বোপরি যার লক্ষ্য ছিলো  বাঙালি জাতিসত্তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার অপচেষ্টা।

৪৭ এর পর থেকেই এই ভূখণ্ডের স্বাধীন, সচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ধর্ম-সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনায় ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ  জাতি নববর্ষ পালন শুরু করে।  মূলত এই উদযাপনের পেছনে কার্যকর ছিল দ্রোহী চেতনা। শাসন ক্ষমতা পেয়েই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বোধের চেতনা ভুলে নেমেছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে, তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল নববর্ষ উদযাপনে বাধা প্রদান। ধর্মীয় পরিচয়ের জিকির তুলে, বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পহেলা বৈশাখ পালনে। মূলত গ্রামবাংলার চিবায়ত নববর্ষ উদযাপনটি তখনই শহুরে মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ সচেতনভাবে আঁকড়ে ধরে। বলা যায় এ এক রেনেসাঁ সম-জাগরণ। নব-প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বে আত্মসর্ম্পণ নাকি স্বকীয় পরিচয়ে দৃপ্ত অহংকারে নিজের গৌরবময় অতীত তুলে ধরা, দুয়ের দ্বন্দ্বে বলা যায় পরাজিত হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের অসরতাই। তারপর থেকে বাঙালির জাতীয় অর্জন যতো, সবই তো সেই চাপিয়ে দেয়া তত্ত্বের বিরুদ্ধে।

স্বাধীনতা উওর স্বদেশে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পহেলা বৈশাখ পালনের ব্যাপ্তি। রমনার বটমূল থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, গ্রামে-গঞ্জে। এই ছড়িয়ে পরাটাকে আমার কেবলই উদযাপনের লক্ষ্যহীন আনন্দবোধ হয় না, বরং বোধ হয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের অবচেতন আবিষ্কার। সচেতনভাবে ব্যক্তিগত মানুষ ঘরে-পরিবারে যে ধর্মের অনুসারি, এই একটি উৎসবে তারা খুঁজে পায় ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে এক উদার মানবিক পরিচয়। ধর্মীয় আচারের সীমাবদ্ধতায় নয় বরং সবার সমান অংশগ্রহণে আনন্দময় উদযাপন। শিক্ষিত সচেতন বোধসম্পন্ন মানুষের এই দ্রোহী আয়োজন অবচেতনে সাধারণ মানুষকে এক করে দেয়। প্রাণের টানে স্রোতের  মতো মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসে এক রমনা বটমূলকে কেন্দ্র করে কিংবা পাড়ার মোড়ের সংগীতায়োজনকে কেন্দ্র করে। এ এক নীরব বিপ্লব। মানুষের অন্তরের আয়োজন। অন্তরে লুকিয়ে থাকা  মানবিকতার বোধে একাত্ম হয়ে ওঠার মহান প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ।

আমার কৈশোরে  সেই ‘৮০-র দশকে তখনো পহেলা বৈশাখ এই সর্বময়রূপ লাভ করে নি। পহেলা বৈশাখ নয়, আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো চৈত্র সংক্রান্তি থেকে। ঐ দিন ঘুম থেকে উঠে তেতো খেয়ে দিন শুরু করতে হতো, হয়তো বা পুরনো বছরের গ্লানি ধুয়ে দেবার প্রতীকী প্রচেষ্টা থাকতো এর মাঝে। ঐদিন শুনতাম দূর কোন গায়ে চড়ক পূজার আয়োজন বসতো। শিব গৌরি সেজে আসতো গানের দল। কালীবাড়িতে বান্নি। পরদিন ঘরের কাজের মাসী এসে বর্ণনা দিতো কি করে একটা জ্যান্ত মানুষের পিঠে বড়শি বেধে ঘুরানো হয় শত শত মানুষের সামনে। মনে হতো বড় হয়ে একদিন দেখতে যাবো। এখন বড় বেলায় শুনতে পাই সেই চড়ক পূজার মাঠ দখল করে নিয়েছে কোনো ভূমিখোর দখলদার। কেউ কোথাও প্রতিবাদ করে নি, করতে শুনিনি এ নিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তির বিকেল বেলা বান্নি থেকে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসতাম পোড়ামাটির হাঁড়ি-কুড়ি। কয়েকটা দিন বেশ কাটতো এ নিয়ে, কুচুরিপানার মাংস, জবাফুলের পাতায় মাছ, ইটের গুড়োর মশলা। ব্যাগ ভরে আসতো খই, বাতাসা। পরদিন পহেলা বৈশাখ। দোকানে দোকানে হালখাতা আর ঘরের ভেতরে পোলাও মাংসের মৌ মৌ গন্ধ। গজ কাপড় কিনে বানানো জামা গায়ে দোকান  থেকে বাসায় ছুটোছুটি দিনভর। বড়দের প্রণাম আর যৎসামান্য  প্রণামী প্রাপ্তি, কি যে স্বর্গীয় আনন্দ দিনটির! মনে পড়ে বছরে বোধহয় তখন ঐ একদিনই পোলাও রান্না হতো। পাঠার মাংস আর পুকুরের সবচে বড় মাছটা। ঐদিন মা কিছুতেই বকতেন না। নেহায়েত কোনো কারণে বকতে এলে দাদু-ঠাকুমা চোখ রাঙাতেন। নববর্ষের দিনে। বাবা বলতেন, এদিন মিথ্যে কথা বলতে নেই। পড়ার পরিবেশ না থাকলেও প্রতীকী বই নিয়ে বসতে হতো। পুরো আয়োজনটাই ছিল প্রতীকী- বছরের প্রথম দিন যা যা করবো সব যেন শ্রেষ্ঠ হয়- সারা বছরটাই তবে এমন শ্রেষ্ঠতম হবে।

ধীরে ধীরে এই মফস্বলে শিরীষ তলায় সূর্যোদয়ের ভোরে বর্ষবরণের আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। তারও সাক্ষী আমি। ভাবলে এখন হাসি পায়, খুব ভোরে সেজেগুজে আমরা দুবোন যখন অনুষ্ঠানে যেতাম, পাড়া পড়শিরা চারপাশ থেকে হা করে তাকিয়ে থাকতো- এই সাতসকালে মেয়েগুলো যায় কোথায়? আর এখন। মাসজুড়ে চলতে থাকে আয়োজন গাঁয়ে-গঞ্জে, ঘরে-ঘরে। জামা-চুরিতে শাড়ি-গয়নায়, নাচে- বাদ্যে, বাঙালিয়ানা-পঞ্চকবি, কুলা ঢেঁকি, খই-মুড়ি, কত কিছুর ব্যস্ততা। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে শহুরে আহ্লাদে স্মরণের চেষ্টায় অবসর নয় কেউ। সাতসকালে রাস্তাঘাট গিজগিজ; কাজে-অকাজে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে থেমে নেই কেউ; ছেলে-বুড়ো, এখানে সামিয়ানা, ওখানে সামিয়ানা; এখানে নজরুল তো ওখানে লালন-রবীন্দ্রনাথ, হৃদয় খুঁড়ে আনা বাঙালিয়ানা, অতীত খুঁড়ে আনা শিকড়ের গন্ধ। নতুন করে লেখা অসাম্প্রদায়িক সমাজের ইতিহাস, নতুন করে গাওয়া ভেদাভেদহীন স্বদেশের গীত।

বোমা মেরে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে একে, ঐ তো সেদিনও স্বপ্নের স্বদেশে। এই উদার জেগে ওঠা বড় ভয় প্রতিক্রিয়াশীলতার কিন্তু থেমে তো থাকে নি। বরং দ্বিগুণ হয়েছে পরের বৈশাখে। নারীকে লাঞ্ছিত করার হাতিয়ার শান দেয়া হয়েছে পুর্নবার। এগুলো ভোঁতা-অক্ষম হয়ে পড়বে তাও বিশ্বাস করি। মানুষ জাগবে ঠিকই তার ভেতরের উদারতান্ত্রিক মূল্যবোধে। হাজার বছরের এই উদার তান্ত্রিকতা যে তার জীনবাহিত। এরই মাঝে টের পাই কর্পোরেটরা দখল নিতে আসে বাঙালির এই স্বতঃর্স্ফূত আয়োজন। পসরা বসে কৃত্রিম-ইলিশ-পান্তার, এটা সেটা কতো কি! দোকানে দোকানে ব্র্যান্ডের নতুন আইটেম, প্রতিযোগিতা, কেনার ধুম। কোথাও যেন আবারো গ্রাস করে নেয়ার পাঁয়তারা বেনিয়াদের। মাঝে মাঝে বৈশাখেরও বুঝি হাফ ধরে যায়। আর কতো প্রতিবন্ধকতায় লড়ে যেতে হবে এর স্বকীয়তায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবার জন্য? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই নববর্ষে ইলিশ পান্তার হুজুগ আসলে কোনো সুচতুর প্রয়াস না তো হিন্দুদের মাংস-পোলাও, ভালো-মন্দ খাওয়ার সংস্কৃতির বিপরীতে অন্য আরেক সংস্কৃতি তৈরির অপচেষ্টা? আমি এর কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।

কিন্তু আশা খুঁজে পাই, সেই কবে যে জমিদারের আঙিনায় দিনটিকে কেন্দ্র করে খাজনা দেয়ায় নামে সাধারণ প্রজারা আপ্যায়িত হতো- কালে তার বিবর্তন দেখে। হালখাতার উৎসব দেখে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দোকানে দোকানে মিষ্টি মুখের ধুম দেখে। জমিদারের প্রজার বিভাজন ঘুচে কবে তা হয়ে উঠেছে সার্বজনিন।

একদা তো গ্রামবাংলার হালখাতা, মেলা, চড়ক পূজা, নৃত্য এ সবই ছিল পহেলা বৈশাখের প্রাণ। আজ যে তা শহুরে আনন্দ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে- তার সবটুকুই  কি মেকি? মোটেই তা বলতে রাজি নই আমি।  যদিও এর সংগে গ্রামীণ সংস্কৃতির সংযোগ কম। কিন্তু এই শহুরে আয়োজনটাকেই পুঁজি করার যে অপচেষ্টা বেনিয়াদের, তাতে যদি গা ভাসাই আমরা তবে পহেলা বৈশাখ তার আসল চেতনা হারাতে বাধ্য। এখন খুব করে প্রয়োজন গ্রামীণ বৃহত্তর জনজীবনের সাথে, শ্রমজীবী মানুষের স্বতঃর্স্ফূত আয়োজনগুলোর সাথে এর একটা যোগসূত্র তৈরি করা। খুব করে দরকার। সচেতনভাবে দরকার, যদি তা সম্ভব হয় তবেই পহেলা বৈশাখ ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় মহিমায় উদ্ভাসিত করে তুলতে পারবে আমাদের। নইলে একদিকে বেনিয়াদের দল তাদের উগ্র ব্যবসায়ী  হাত, অন্যদিকে মৌলবাদের রক্তচক্ষু- এ দুয়ের টানাপোড়েনে অচিরেই পথ থাকবে তা? এ হতে দেয়া যায় না। পহেলা বৈশাখকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদেরই প্রয়োজনে।