• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০১৯, ০৮:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০৬:৫৭ পিএম

চা বাগানে শ্রমিক রাজিয়ার গল্প

চা বাগানে শ্রমিক রাজিয়ার গল্প

‘গাবাতি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ সংলগ্ন পাকা সড়কের পাশে একটি ছোট ‘টি স্টল’-এর সামনে দাঁড়িয়ে চা পান করছিলাম। এমন সময় মধ্যবয়সী এক মহিলা সেই দোকানের ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে পড়ল। চা পান শেষে মহিলার সঙ্গে আলাপ করি। মহিলা স্থানীয় একটি চা বাগানে মহিলা শ্রমিকের কাজ করেন। নাম সুফিয়া খাতুন। তিনি জানালেন, প্রায় ৩ বছর ধরে তিনি চা বাগানে কাজ করছেন। তার স্বামীও একই চা বাগানে কাজ করেন। প্রতিদিন তারা দু’জন মিলে যে মজুরি পান, তা দিয়ে চারজনের পরিবারের ভরণপোষণ ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। চা বাগানে কাজ করার আগে তাদের প্রায়শই না খেয়ে থাকতে হতো। কারণ এলাকায় তেমন একটা কাজ পাওয়া যেত না। এলাকার বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে। চা বাগান তাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। চা বাগানে কাজ করে এখন সুফিয়াদের দিন ফিরতে শুরু করেছে। পঞ্চগড় এলাকায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এই কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চগড়ের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হবে এবং পিছিয়ে থাকার দুর্নাম থেকে এলাকাটি মুক্ত হতে পারবে। 
কয়েক বছর আগেও সুফিয়াদের মতো পরিবারগুলো অর্থনৈতিক দীনতার মধ্যে ছিল। এখন তারা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কারণ পঞ্চগড়কে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এখানে নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড় না গেলে কেউ এ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারবেন না। একটি অনুন্নত এলাকাও যে উন্নয়নের ছোঁয়ায় দ্রুত বদলে যেতে পারে বৃহত্তর পঞ্চগড় জেলা তারই উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ।  
    
কয়েক বছর আগেও ‘গাবাতি’ এলাকাটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা একটি ভারতীয় ছিটমহল। বাংলাদেশের সরকারি উন্নয়নের ছোঁয়া এ এলাকায় লাগেনি। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত হলেও এটা ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড। অন্যদিকে ভৌগোলিক কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষও এ এলাকার প্রতি কোনো ধরনের সুদৃষ্টি দেয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আওতায় ‘গাবাতি’ গ্রামটি এখন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সরকার এই অনুন্নত এলাকাগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘গাবাতি’র মতো অনুন্নত এলাকাগুলোও উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান হয়েছে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, অর্গানিক পদ্ধতিতে আবাদকৃত চা বাগানগুলো পঞ্চগড়ের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে। বৃহত্তর পঞ্চগড় জেলার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ভূমিকা পালন করে চলেছে সমতল ভূমিতে সৃজিত চা বাগানগুলো। এতদিন আমাদের দেশের কৃষিবিজ্ঞানিদের ধারণা ছিল সমতল ভূমিতে চা জন্মে না। চা ভালো উৎপাদিত হয় এমন স্থানে যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, কিন্তু বৃষ্টির পানি বেশিক্ষণ আটকে থাকে না। অর্থাৎ পাহাড়ি এলাকাই চা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। সে হিসেবে সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র চা উৎপাদন কেন্দ্র। কিন্তু পঞ্চগড়ের চাষিরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, শুধু পাহাড়ি এলাকাতেই নয় উদ্যোগ নিলে সমতল ভূমিতেও বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন করা সম্ভব। পুরো পঞ্চগড় এলাকাতেই এখন প্রচুর পরিমাণে উন্নত মানের অর্গানিক চা উৎপাদিত হচ্ছে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চা গুণগতম মানের দিক থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদন যত না বিস্ময়কর, তার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর হচ্ছে আরও আগে কেন এখানে চা উৎপাাদন শুরু হয়নি? কারণ পঞ্চগড় সীমান্ত এলাকার অপরদিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে আরও অনেক দিন আগেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপন্ন হচ্ছে।

পঞ্চগড়ের মাটি ও আবহাওয়া উন্নত মানের চা উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী এটা আজ প্রমাণিত। প্রতি বছরই এ জেলায় চায়ের আবাদ বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, পঞ্চগড় এলাকায় ২০০০ সালে সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু হয়। প্রথম বছরেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই কৃষকদের মাঝে চা উৎপাদনের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে এ এলাকায় নিবন্ধিত বড় বাণিজ্যিক চা বাগান আছে ৮টি। নিবন্ধনবিহীন বড় চা বাগান আছে ১৮টি। নিবন্ধিত ছোট চা বাগান আছে ৬৬২টি এবং অনিবন্ধিত ছোট চা বাগানের সংখ্যা ৩ হাজার ৬০০টি। ইতোমধ্যেই ১২টি ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে, যারা স্থানীয়ভাবে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ করছে। আরও ২০টি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০১৭ সালে এ জেলায় মোট ৫৪ দশমিক ৪৬ লাখ কেজি উন্নত মানের চা উৎপাদিত হয়। গত বছর চা উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮১ লাখ কেজিতে। গত বছর মোট ৫ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে চা আবাদ হয়েছিল। প্রতি বছরই চা আবাদের পরিমাণ বাড়ছে। এ বছর ১ কোটি কেজি চা উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

সম্প্রতি পঞ্চগড় এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, এ এলাকায় চা বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। অনেকেই নতুন নতুন চা বাগান তৈরি করছেন। এ ছাড়া যাদের জমির পরিমাণ কম, তারাও নানাভাবে চা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। বাড়ির আনাচে-কানাচে পতিত জমিতে সীমিত পরিসরে হলেও, তারা চা আবাদ করছেন। এ এলাকায় খুব কম বাড়িই আছে যারা সামান্য হলেও চা আবাদ করেননি। এলাকার কয়েকজন চা উৎপাদক জানালেন, চা আবাদ করা অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি লাভজনক। প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ২৩/২৪ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। চা আবাদের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এতে পরিচর্যার তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। আর একবার চা গাছ রোপণ করা হলে অনেক দিন পর্যন্ত তা থেকে পাতা আহরণ করা যেতে পারে। চা গাছে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণও তুলনামূলক কম হয়। যেহেতু পঞ্চগড় এলাকায় বেশির ভাগ চা-ই অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়, তাই এতে কেমিক্যাল সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এলাকার স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি জানালেন, এ এলাকায় যেভাবে চা উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামীতে এ চা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও তা বিদেশে রফতানি করা যাবে। পঞ্চগড় এলাকার চা যেহেতু অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে, তাই এর চাহিদাও বেশ ভালো। ইতোমধ্যেই পঞ্চগড় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। 

দেশের অন্যতম অনুন্নত এবং দরিদ্র এলাকা হিসেবে পঞ্চগড়ের যে দুর্নাম ছিল তা ইতোমধ্যেই কাটতে শুরু করেছে। পঞ্চগড়ের প্রতিটি স্তরে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। স্থানীয়ভাবে সৃজিত চা বাগানগুলো এলাকায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রাখছে। দক্ষ এবং অদক্ষ মিলিয়ে এ এলাকার চা বাগানে ৭ হাজারেরও বেশি শ্রমিক নিয়মিত চা বাগানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। এদের বেশির ভাগই আবার দরিদ্র মহিলা শ্রমিক। আগে এ এলাকায় বছরের একটি বিশেষ সময় মঙ্গা বা অর্থনৈতিক দুরবস্থার সৃষ্টি হতো। এখন সেই অবস্থা আর নেই। কারণ সাধারণ মানুষ এখন চা বাগানে সারা বছরই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

পঞ্চগড়বাসীরা সমতল ভূমিতে চা আবাদে সাফল্য লাভ করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা দেশের অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দেশের আরও অনেক এলাকাই চা চাষের জন্য উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে।     
                     

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড