• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০১৯, ০৭:৩২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৫, ২০১৯, ০৯:৫২ পিএম

নতুন বছর নতুন হোক

নতুন বছর নতুন হোক

নববর্ষের আগমনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগ আসে, সেই সঙ্গে জেগে ওঠে প্রত্যাশা। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত পারস্পরিক শুভেচ্ছার আদান-প্রদানের ভেতরে সকলেরই থাকবে এই প্রত্যাশা যে নতুন বছর যেন পুরাতন বছরের অনুবর্তন না হয়, যেন প্রলম্বন না হয়ে ওঠে যেমন ছিলাম তেমনেরই। পুরাতনের অর্জনগুলো নিয়ে আমরা এগোতে চাইব সামনের দিকে।

নবীন প্রত্যাশার ভেতর অগ্রগমনের আকাঙ্ক্ষাটা কাজ করে চালিকাশক্তি হিসেবেই। সবাই আমরা এগোতে চাই। এটা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় দিক দিয়েই সত্য। নববর্ষের শুরুতে ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞা থাকে, তবে সে-প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবিক করে তুলতে হলে যে সকলের সহযোগিতা আবশ্যক সেই উপলব্ধিটাও ওই প্রতিজ্ঞার সঙ্গেই থাকে। নববর্ষের চরিত্র আসলে সমষ্টিগতই।

গত বছরে বিশেষভাবে সত্য ছিল সহিংসতা। রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সকল ক্ষেত্রেই হিংস্রতা দেখা গেছে। অনিরাপদ ছিল মেয়েরা। নিশ্চুপে নারী নির্যাতন ঘটেছে; ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যার খবর আমাদের বিচলিত করেছে। সমাজে মেয়েরা অর্ধেক, সর্বক্ষেত্রে তারা এগিয়েছে, এগোচ্ছে; অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা চমৎকার। তবে তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি। নারীর নিরাপত্তাহীনতা সামাজিক বাস্তবতারই প্রতিফলন। প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুর্বলের ওপর। জন্মমুহূর্তে কোনো শিশুই নারী থাকে না, তাকে নারী করে তোলা হয়, এবং শিশুটি যতই নারী হয় ততই তার বিপদ বাড়ে। বোঝা যায় সমাজ কেমন হিংস্র, সেখানে নৃশংসতা কেমন বিকাশমান।

সমাজ অসুস্থ। তার মূল ব্যাধিটা কী? সেটা অন্য কিছু নয়, সেটা হলো বৈষম্য। উন্নতি হচ্ছে। চতুর্দিকে উন্নতির নিদর্শন দৃশ্যমান। আওয়াজ শুনতে কর্ণপাতের দরকার হয় না, আপনা থেকেই এসে পড়ে। আমরা উৎসাহিত হই। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। মুশকিলটা এই যে উন্নতি সর্বত্রগামী হচ্ছে না। উন্নতি নদীর মতো হচ্ছে না, উর্বর করছে না সামাজিক ভূমিকে, পৌঁছে যাচ্ছে না সকলের কাছে, সজীব করছে না পরিবেশকে। বরঞ্চ পানি নিচ্ছে টেনে। অনেক কিছুই শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীও। নদী শুকাচ্ছে আক্ষরিক অর্থে, শুকাচ্ছে রূপক অর্থেও। দূষিত হচ্ছে অনেক কিছুই, শীর্ণ হচ্ছে সংবেদনশীলতার ধারাপ্রবাহ। নদী কাঁদে, নীরবে। সে কান্না মানুষেরই কান্না বোধ করি, ভেতরে ভেতরে।

দেখা যাচ্ছে উন্নতি যত বাড়ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈষম্য। বৈষম্যই হচ্ছে বাংলাদেশের মূল সমস্যা। পশ্চাৎপদতার কারণে বৈষম্য তৈরি হয়নি, উল্টো বৈষম্যই পশ্চাৎপদতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে, এবং জরিপও সমর্থন করে ধারণাকে যে, শতকরা ৮০ জন মানুষ এখন সুবিধাবঞ্চিত। সুবিধা পাচ্ছে শতকরা ২০ জন। এই বিভাজনকে সমীকরণের ভেতর আনা যাবে কী করে? আনাটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বৈষম্য নতুন কোনো ব্যাপার নয়। আগেও ছিল। ব্রিটিশ শাসনের কালে বাংলায় শতকরা ৫২ জন ছিল মুসলমান, শতকরা ৪৮ জন হিন্দু। সমীকরণের চেষ্টা হয়েছে, সফল হয়নি। আলাপ-আলোচনা, দরকষাকষি, মধ্যস্থতা কোনো কিছুতেই মীমাংসা ঘটেনি। দাঙ্গা বেধেছে, এবং শেষ পর্যন্ত ভাগ হয়েছে দেশ। পাকিস্তান আমলে পার্থক্য দেখা গেল বাঙালি-অবাঙালিতে। ব্যবধানটা বেড়েছে, বাঙালি ছিল শতকরা ৫৬ জন, অবাঙালি ৪৪ জন। সমীকরণের চেষ্টা হয়েছে। প্যারিটিতে কুলায়নি। রাষ্ট্র ভাঙতে হয়েছে। রাষ্ট্র ভাঙল, কিন্তু বৈষম্যের তো অবসান ঘটল না। সংখ্যার হিসাব বলে দিচ্ছে যে সেটা বিলক্ষণ বেড়েছে। এখন একদিকে ৮০ জন, বিপরীতে ২০ জন। পার্থক্যটা শ্রেণিগত। এর মীমাংসা কিন্তু করতেই হবে। না করলে যা ঘটবে তার লক্ষণ অগোচর নেই। বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশৃঙ্খলা অরাজকতার আকার নেবে এমনই আশঙ্কা। মীমাংসার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন; সর্বত্র অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা। এটি না করতে পারলে আমরা যে অন্ধকারের দিকে প্রবেশ করব সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হবে।

অন্ধকার বৃদ্ধির একটি লক্ষণ ধর্মীয় জঙ্গি তৎপরতার বিস্তার। শ্রেণি সমস্যাকে আড়াল করার জন্যই এক সময়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে উসকানি দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যা এখনো আছে। যোগ হয়েছে জঙ্গি সমস্যা। জঙ্গিরা সাম্প্রদায়িকতার সীমাটাকে প্রসারিত করে দিয়েছে। তারা খ্রিস্টানদের ওপর আক্রমণ করছে। শিয়া-সুন্নি পার্থক্য দাঁড় করাতে চাচ্ছে। প্রগতিশীল লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করছে। এ সবকিছুর ফলে আড়ালে চলে যাচ্ছে শ্রেণি সম্পর্কের সমস্যা।

শাসকশ্রেণি এ বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না, দেবেও না। কারণ তাদের জন্য সমস্যা হলো শ্রেণি অসন্তোষ। শতকরা ৮০ জনকে নিয়ে তাদের যত ভয়। ৮০ জন যদি নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি করে, তবে ২০ জনের তেমন কোনো অসুবিধা নেই, উল্টো সুবিধাই হতে পারে।

কিন্তু দেশের মানুষ বাড়ছে, তাদের ভবিষ্যৎ রয়েছে। বিপদ দেখলে শাসকশ্রেণির সদস্যরা বিদেশে চলে যেতে পারবে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তো সেটা পারবে না। সাধারণ মানুষ সেটা বোঝে।

তাহলে ভরসা কোথায়? ভরসার প্রধান ক্ষেত্র তরুণরা। জনসংখ্যায় তারা অর্ধেক। তারা সচেতন। বিদ্যমান ব্যবস্থাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। তারাই পারে রুখে দাঁড়াতে, অতীতে যেমন দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভরসার ওই জায়গাটা যে অক্ষত থাকছে তা নয়। তরুণরা বিভ্রান্ত হচ্ছে, তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কেউ আশ্রয় খুঁজছে মাদকে, কেউ বা হচ্ছে জঙ্গি, অধিকাংশই হতাশ। কিশোর এখন কী করে, কী দেখে, কিভাবে তার সময় কাটে, কী নিয়ে আলাপ করে এসব বিষয়ে অভিভাবকদের কোনো চিন্তা নেই। বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জীবন নেই। সেখানে ছাত্রসংসদ নেই। ছাত্রদের আন্দোলন নিরুৎসাহিত।

ওদিকে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। উদ্বৃত্ত আছে, সঞ্চয়ও হয়। কিন্তু বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত। সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বেকারের সংখ্যা ইতিমধ্যেই মারাত্মক হয়ে উঠেছে। এই বেকারদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা যা কিছু করতে পারে, করছেও। অপরাধ ও হিংস্রতা বৃদ্ধির মধ্যে বেকারত্বের সম্পর্কটা যেমন প্রত্যক্ষ তেমনি অবিচ্ছেদ্য।

নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশার তালিকাটি দীর্ঘ না করলেও চলবে, কয়েকটি ক্ষেত্রে যদি কাজ হয় তা হলেই যথেষ্ট মনে করব। এগুলো হচ্ছে বৈষম্য কমানো ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি; এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। সে-স্বাধীনতা না থাকলে আমাদের কী করণীয় সেটা বুঝব কী করে?

দুঃখের বিষয় হলো দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন না। বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা হচ্ছে তেমন মানুষ যাঁরা কি ঘটছে সেটা বুঝতে পারেন এবং ব্যবস্থাটাকে বদলাতে চান। সমস্যা বোঝেন না, এবং বুঝলেও ব্যবস্থাকে মেনে নেন এমন মানুষ বুদ্ধিজীবী নন; তা তাঁরা যতই পণ্ডিত, জ্ঞানী, দক্ষ ইত্যাদি হোন না কেন। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। বুদ্ধিমান মানুষদের অধিকাংশই এখন সুবিধাভোগী ও সুবিধালোলুপ। কোলাবরেটার কথাটা একাত্তরে বেশ শোনা যেত। সেটা ছিল খুবই ঘৃণার্হ পরিচয়; এখন যে তা প্রশংসাযোগ্য হয়েছে তা নয়। তখন কেউ কেউ সহযোগিতা করেছে হানাদারদের সঙ্গে, এখন সহযোগিতা চলছে বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে। এটা যাঁরা করছেন তাঁরা ভালো কাজ করছেন না, শতকরা ৮০ জনের বিপক্ষেই তাঁদের অবস্থান।

তবে হতাশার কারণ নেই। যুদ্ধটা বাঁচা-মরার, এ যুদ্ধে হতাশার স্থান নেই, যেমন স্থান নেই পরাজয়ের। ব্যক্তিগতভাবে বাঁচার যুদ্ধ ও স্বপ্ন সমষ্টিগত বাঁচার সংগ্রাম ও স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত। সেই যোগটা আগামী বছরে আরো নিবিড় হবে—এটাই আশা করব। কারো একার নয়, এটি আমাদের সকলেরই আশা।

নববর্ষ আমাদের জন্য শুভ হোক।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক