• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০১৯, ০৭:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৭, ২০১৯, ০২:০২ এএম

আর কোনো ব্যাখ্যা নেই, ইসরায়েলিরা খুনি বেছে নিয়েছে

আর কোনো ব্যাখ্যা নেই, ইসরায়েলিরা খুনি বেছে নিয়েছে

এখন আমি ধারণা করি, আমরা সমস্ত ব্যাখ্যার বাইরে চলে গেছি। বিবি নেতানিয়াহুর ইসরায়েলে নতুন কিছু দেখা যাবে না। আরো ডানপন্থী হওয়ার কিছু অবশিষ্ট নাই। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এই প্রপাগাণ্ডা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ? দাঁড়ান, আমাকে একটু সময় দিন।
আমার ধারণা ইসরায়েল এখন পুরোপুরি তার আরব প্রতিবেশি দেশগুলোর মত হয়ে গেছে। ইসরায়েল তার নিজের আরব সংখ্যালঘুদের উপর কর্তৃত্ব করছে। ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্যালেস্টাইনি আরবদের বৈধ জায়গা ইসরায়েলিদের জন্য সংযুক্ত করবেন। যে কলোনিতে ইতিমধ্যে ইসরায়েল সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিদের জন্য তৈরি করেছে তা আরবদের ভূমি। এই সংযুক্তির মধ্যে জেরুজালেমও আছে। ৫৭০০ স্কয়ার কিলোমিটার। যা কুয়েত দেশটির এক তৃতীয়াংশ। এই কুয়েতকে সাদ্দাম হোসেন ১৯৯০ সালে ইরাকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন। আর যে কারনে আমাদের সবার যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। একই কাজ ইসরায়েল করতে যাচ্ছে। আরেকটি মধ্যপ্রাচ্যের জাতির উপর। 
ইসরায়েল তার প্রতিবেশিদের হুমকির উপর রেখেছে, বোমা হামলা চালাচ্ছে। খোড়া যুক্তি দেখিয়ে প্যালেস্টাইনিদের বন্দী করে রাখছে। ২০ লাখ আরব প্যালেস্টাইনির উপর হত্যাকারী পুলিশ স্কোয়াড দিয়ে শাসন চালাচ্ছে। বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন চলছে, পয়সা দিয়ে গোয়েন্দা পুষছে। ইসরায়েল দাবি করে যে তারা প্যালেস্টাইনিদের ঘর এবং জমি দখল করে না। আপনি এমন কথা প্রায় সব আরব দেশগুলোতেও শুনতে পাবেন। রিয়াদ থেকে দামাস্কাস, কায়রো বা ইরাকে যান। আরবরা চিৎকার করে বলছে, ‘আমরা আমাদের রক্ত-মাংস দিয়ে তোমাদের জন্য  জীবন উৎসর্গ করছি।’
এখন ইসরায়েলিরা নেতাহিয়াহু এবং তার ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক জোটকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। তারাও নিজেদের উৎসর্গ করেছে নেতানিয়াহুর জন্য। তবে হয়তো সেটা রক্তের বিনিময়ে না। কারণ বিবি নেতানিয়াহু জানেন যে দীর্ঘ কোনো যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলিরা তাকে ভোট দেয়নি। সংক্ষিপ্ত এবং বেদনাহীন কাজের জন্য তাকে ভোট দিয়েছে, আর সে কাজে বেদনাটা আরবদেরই বহন করতে হবে। 
তাদের পেছনে আছে আমেরিকা। যে রকম আরবরা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্যবহার করেছে অনেক ক্ষেত্রেই।এখন তাদের পেছনেও ওই আমেরিকাই আছে। নেতানিয়াহুর বিজয়ের পর ট্রাম্প যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে মনে হয় যে আমেরিকায় ইসরাইলের কোনো সমালোচককে সহ্য করা হবে না। ভাগ্য ভালো যে ইসরাইলের অভ্যন্তরেই ইসরাইলের কিছু সমালোচক রয়েছেন। 
সাহস ও সত্যের দিক থেকে সব পশ্চিমা সাংবাদিকদের ছাপিয়ে অমর গিডিয়ন লেভি ইসরাইলের পত্রিকা হারেৎস(আরেক অমর)-এ গেল সপ্তাহের নির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে ইসরায়েল কে নতুন হতভাগ্য রিপাবলিক বলে উল্লেখ করেছেন। 
তিনি লিখেছেন,“সেকেন্ড রিপাবলিক কোনো কিছুই আর লুকাবে না অথবা সুন্দর মনোরম বলে দেখাতে চেষ্টা করবে না। এটাকে দেখা যাবে প্রকৃত চেহারায়। প্রথম রিপাবলিকের চেহারাটা ছিল মিশ্র, খানিকটা বাস্তব, খানিকটা প্রতারণাপূর্ণ। হ্যা, মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র, কিন্তু আরব অঞ্চলের জন্য মিলিটারি সরকার আর দখলকৃত অঞ্চলের জন্য মিলিটারি একনায়ক।”
 লেভি আরো লিখেছেন, ইসরায়েল বলে যে তারা মধ্যপ্রাচ্যের ডার্লিং। কিন্তু একই সঙ্গে  তারা পৃথিবীর সর্বশেষ উপনিবেশিক শাসকও। 
“তারা বলে যে তারা জাতিসংঘের সম্মানিত সদস্য। কিন্তু ইসরায়েল প্রায় সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। তারা দখলকৃত অঞ্চলকে সংযুক্ত করে না কারন তারা এমন একটি ধারণা তৈরি করতে চায় যে তারা এখানে অস্থায়ী। তারা গর্ব অনুভব করে যে দেশে আইনের শাসন আছে এবং সুপ্রিম কোর্ট আছে। কিন্তু সেসব শেষ। আগামী সরকার হবে বর্তমান সরকারেরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু সেই সঙ্গে হবে আরো শক্তিশালী, আরো উগ্র জাতীয়তাবাদী. আরো সাম্প্রদায়িক সেই সঙ্গে কম বৈধ এবং কম গণতান্ত্রিক।”
গিডিয়ন লেভি ঠিকই ব্যাখ্যা করেছেন,“ যে আগুন দপদপ করে জ্বলতে শুরু করেছিল শেষ সরকারের সময়, তা এখন বিস্তৃত হবে কেবল।  প্রচারমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং আরব সম্প্রদায়ের লোকেরা সর্বপ্রথম সেটা দ্রুত অনুধাবন করতে পারবে। এই পত্রিকার কিছু মতামত আর প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। প্রকাশের অনুমতি মিলবে না। আইন করে সেটা নিষিদ্ধ হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইসরায়েলি সৈনিকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা। কেউ আবার বিরোধিতা করবে!”
এমন যে কেউ ইসরায়েলকে যে বয়কটের সমর্থন করতেন তাকে গুডবাই। এটা নিষিদ্ধ হবে। গিডিয়নের কথার শেষ উদ্ধৃতি,“ বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর হবে সমালোচকদের জন্য কাছের। নন-প্রফিট সংগঠনগুলো হবে অবৈধ। আরবদের এখনকার চেয়েও বেশি বাইরে ঠেলে দেওয়া হবে। ইহুদি রাষ্ট্র কেবল সেখানে ইহুদিরাই বৈধ এই পথে হাঁটবে। এবং অবশ্যই দখল বিস্তৃত হতে থাকবে।” গিডিয়ন লিখেছেন, সারা বিশ্ব দেখুক এবং বিচার করুক।  
অবশ্যই যে সব আরব তাদের চোখের জলে প্যালেস্টাইনিদের ভাসিয়েছেন তারা ইসরায়েলকে দেখে সুখী হবেন, যে দেশটি দেখতে ঠিক তাদেরই মত নিষ্ঠুর ও রাজনীতিতে অনৈতিক, যেখানে সরকার প্রধানের দুর্নীতির স্তুপ দেখেও কোনো কিছু বলা যাবে না। অনেকটাই একনায়কের মত শোনায় না?
চিন্তা করে দেখেন বাগদাদ থেকে আম্মান, দামাস্কাস থেকে দোহা অথবা কায়রো থেকে আলজিয়ার্স পর্যন্ত রাজধানীর কথা। আপনি যদি আরবদের কথা বিবেচনা করেন যে তারা তাদের নেতাদের ব্যাপারে দায়ি না, যেখানে ৯০ ভাগ নির্বাচন কারচুপির মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাহলে আর নেতানিয়াহু এবং তার রাজনৈতিক জোটকে অস্বীকার করবেন কিভাবে? তারা তো নেসেট এর ৬৫ ভাগ সিট নিয়ে ১২০ আসন পেয়েছে। একটা কথাই বলার আছে, আরব স্বৈরশাসকরা তাদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, অন্যদিকে ইসরায়েলিরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বদমায়েশদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।
এবার বেনি গাৎটস  এর কথা বলি। তিনি কি নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলি আরবদের অপমান করেননি? তারা তো তারই দেশের নাগরিক। তারা যদি তাকে ভোট দিতে অস্বীকৃতি না জানাতো তাহলে তো তিনিই প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বাদ পেতেন। আমরা কি দেখিনি বেনি কীভাবে নির্বাচনী ভিডিওতে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো দেখিয়েছেন ইসরায়েলিদের ভোট পাওয়া জন্য? কল্পনা করে দেখুন যদি আরব একনায়কদের ভুয়া নির্বাচনে তাদের ভোটারদের সামনে জনপ্রিয়তা দেখানোর প্রশ্ন থাকতো তাহলে  কুর্দি, শিয়া বা সুন্নীদের উপর আক্রমনের চিত্র টিভিতে দেখাতো। আমরা বলতাম, এরা সব যুদ্ধাপরাধী।  কী করে একজন মানুষ এমন রক্ত ঝরানো মানুষদের তুলে ধরতে পারেন! ঠিক আছে আমরা এই প্রশ্নের উত্তরে না গেলাম। 
কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ইসরায়েলও ভালোভাবে বৈতরণী পার করে ফেলবে। আরব জাতিগুলোও তাদেরকে এভাবেই চলতে দেবে। কারণ এক নায়করা এমন একজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কেন, যিনি দিনে দিনে তাদেরই মত চরিত্রের হয়ে উঠছেন।
যদি পশ্চিমারা একটি আরব দেশকে ক্ষমা করতে পারে ইয়েমেনে বোমা ফেলার জন্য, তাহলে ইসরায়েলের গাজায় বোমা ফেলাটাও বৈধ হয়ে যায়।  যদি আমরা আরবের সঙ্গে ব্যবসায় যেতে পারি যে আরবরা নারীর অধিকার চাইলে জেলে নিয়ে যায়, সাংবাদিক হত্যা করে তাহলে তো আমরা ইসরায়েলের সঙ্গেও ব্যবসায় যেতে পারি যারা গাজায় বোমা ফেলে সাংবাদিক হত্যা করে( চিকিৎসক ও নার্সদের হত্যা করে)। 
সুতরাং আর কোনো প্রপাগান্ডা নয়, আর কোনো ব্যখ্যা নয়, আর কোনো ছদ্মবেশ নয়। আমরা জানি আমরা কোথায় দাড়িয়ে আছি। আরবরাও যেমন জানে, ইসরায়েলও তেমনি জানে। (দৈনিক জাগরণে অনূদিত)
  লেখক: দি ইনডিপেনডেন্টর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।