• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০১৯, ০৫:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৯, ২০১৯, ১১:৫৫ পিএম

আকাঙ্ক্ষা উন্নত দেশ : প্রত্যাশা স্বস্তিময় জীবন

আকাঙ্ক্ষা উন্নত দেশ : প্রত্যাশা স্বস্তিময় জীবন

সভ্য-বিবেকবান মানুষ সব সময়ই অন্ধকার পরিহার করে আলোর দিকে এগোয়। এই আলোর আলোয় নিজে সমৃদ্ধ হয়, অন্যকেও সমৃদ্ধ করে। ব্যতিক্রম শুধু আমরাই। পারিপার্শ্বিকতা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ক্রমে অন্ধকার আমাদেরকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তা না হলে ধর্ষণ নামের অমানবিক-নির্মম-নিষ্ঠুরতা দেশে দিন দিন মহামারীর আকার ধারণ করে? এক্ষেত্রে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নারীই নয়, শিশুরাও এ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে তাদেরকে খুনও করা হচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে দেশে যেন ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের মহোৎসব চলছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও এ ধরনের বর্বরতার সত্যতা মিলছে। এমনই এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ৬ বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১০ গুণ। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারীরা। আশ্চর্যের বিষয়, তিন বা চার বছরের দুধের শিশুও এ বিকৃত লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণের শিকার হওয়া এসব ভিকটিম লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনার সিংহভাগই প্রকাশ করে না। সামাজিক মান-সম্মানের ভয়ে তা গোপন রাখে তাদের পরিবার। দেশে ধর্ষণচিত্র এতটাই ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে যে, এর প্রতিকার হিসেবে ধর্ষকদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবিও উঠছে সমাজ থেকে।

মানবাধিকার সংস্থা- আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জনকে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই শিশু ও কিশোরী। প্রতিদিন পত্রিকাতে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর থাকেই।

স্বীকার করতেই হবে, নারীর অগ্রগতি শনৈঃ শনৈঃ বাড়ছে। বর্তমানে নারী শিক্ষার হার ৫০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। নারীর ক্ষমতায়নে সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪৮তম। সুতরাং উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার প্রদীপের আলোর নিচেই বিরাজ করছে গভীর অন্ধকার। সমাজে নারীরা এখনও প্রতিনিয়ত আলোর পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি দেশে অব্যাহত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্টও। আদালত বলেছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই দেশে ধর্ষণ বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনা রোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।

সামাজিক সংকটেই যে বাড়ছে এ ধরনের সহিংস-বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড, তাতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এ সমাজে এখন আর কেউ কারও বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়। প্রত্যেকেই প্রতিযোগী। সৎ প্রতিযোগী নয়, অসৎ প্রতিযোগী। তাই প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে একে-অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন। সামান্য মুঠোফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরকে পিটিয়ে বা গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। আমরা সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও চাহিদা আছে। তাই সমাজ সব সময় মানুষের কাছ থেকে সামাজিক আচরণই প্রত্যাশা করে। প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য থাকে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা। সেই নীতিমালার অভাবে সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান থাকাটাই স্বাভাবিক। সমাজে নীতিহীনতার কারণেই চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। সৃষ্টি হচ্ছে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসের। ফলে একে অপরের সম্পর্কের মাঝে জন্ম নিচ্ছে চরম আস্থার সংকট। সেটা যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, তেমনই পিতামাতা-সন্তানের মধ্যেও।

সমাজের এ অবক্ষয়ের কারণেই মাদকাসক্ত তরুণী ঐশী খুন করে নিজ পিতা-মাতাকে। অবক্ষয়ের কারণেই ঘটে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা-হত্যাকাণ্ড। হত্যা করা হয় দুই বিদেশি নাগরিককেও। হত্যা করা হয়েছে বেশ কয়েকজন ব্লগারকেও। সমাজের অবক্ষয়ের কারণেই সিলেটে শিশু রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে, পিটিয়ে, খুঁঁচিয়ে খুঁঁচিয়ে, জখম করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীরা আবার সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারও করে। কী অকল্পনীয় বীভৎসতা! যা সভ্য মনুষ্য সমাজে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর পরপরই খুলনায় আরেকটি শিশুর মলদ্বারে কম্প্রেসারের সাহায্যে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। ঘটে মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। 

এর আগে ১৯৯০-এর দশকে দিনাজপুরের ইয়াসমিনকে নিয়ে ঘটেছিল এ রকম একটি ঘটনা। যতটুকু মনে পড়ে, অভিযুক্তরা সবাই ছিল মহাসড়কের পুলিশ। তারা মেয়েটিকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গাড়িতে তোলে এবং ধর্ষণের পর মেরে ফেলে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন অপরাধ সংঘটনের। অপরাধীরা অপরাধ ঘটাতে ক্রমেই সাহসী হচ্ছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের এই ক্রম-অবক্ষয়ে চিন্তিত দেশের সচেতন ও বিবেকবান মানুষ। তারা নৈরাশ্যের অতলে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছেন। এসব ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রতিনিয়ত বক্তৃতা-বিবৃতি, সেমিনার, মানববন্ধন হচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও টেলিভিশনের টকশোগুলোয় বিস্তর ও বিশদ বিশ্লেষণ, বিষোদগারের মহোৎসব চলছে।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, অতীতের গর্ভে জন্ম নেয় বর্তমান- বর্তমানের গর্ভে থাকে ভবিষ্যৎ। তাই বর্তমান সংকট বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হয় অতীতে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি জাতিসত্তার সংকট নতুন করে শুরু হয়। পঁচাত্তরপরবর্তী শাসকদের শাসনের মূলকথা ছিল : সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা ধনবাদের ধারা অনুসরণ এবং সাম্রাজ্যবাদনির্ভর আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁঁজির প্রসার, তাদের স্বার্থে বিরাষ্ট্রীয়করণ, গ্রামাঞ্চলে নব্য কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি, স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত সুফল নস্যাৎ করা, পাকিস্তানি আমলের সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শ ও তাদের অনুসারীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এ প্রক্রিয়া আরও বেগবান হয়। জেনারেল জিয়া তখন বলতেন, “আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব, (Money is no Problem) টাকা কোনো সমস্যা নয়।” আসলেই জিয়াউর রহমানই রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দিয়ে গেছেন। জিয়া রাজনীতিতে যে পথ-পদ্ধতি চালু করেছে তা হলো-  টোপ-লোভ, সুবিধাবাদ, পেশীশক্তি, আমলা কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের গড়ে তোলা। ঢালাও বিরাষ্ট্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পানির ধরে বিক্রি করে লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণির সৃষ্টি, গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে মাস্তাননির্ভর রাজনীতি চালু করা।

জেনারেল এরশাদের আমলে এটা আরও গতিশীলতা লাভ করে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হলেও লুটপাটের অর্থনীতি চালু থাকায় আজও সমাজ ও রাজনীতিতে সেই অস্থিরতা অব্যাহত আছে। লুটপাটের অর্থনীতি, লুটেরা রাজনীতি ও লুটেরা মূল্যবোধ সমাজ-মানস, সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে এখন একেবারেই গ্রাস করে ফেলেছে। তারই খেসারত তিলে তিলে দিতে হচ্ছে অবলা-অসহায় শিশু-কিশোরী-নারীকে। 

একাত্তরে যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীন হয়েছি, সেই স্বাধীনতার পাঁচ দশক পার করতে চলেছি আমরা। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই প্রায় ২০ শতাংশ। সে হিসাবে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘রিসার্চ ফর ওয়েলথ’-এর জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে অতি ধনী লোকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বৃদ্ধির হার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা, চীন ও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘অক্সফাম’-এর বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতির সূচক অনুযায়ী বিশ্বের ১৫৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, মাত্র ১০ শতাংশ ধনী মানুষ দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ উপার্জন করে থাকেন, যেখানে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ। এ আয় বৈষম্য থেকেই আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের সূচনা হয়, যা সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে।

 

এক সাগর রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ ধরনের বাংলাদেশের প্রত্যাশা আমরা করিনি। বাংলাদেশের সব জনসাধারণ সব অবস্থায় দেশের সার্বিক কল্যাণ প্রত্যাশা করে। দেশ এগিয়ে যাক সমৃদ্ধির পথে, দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটুক, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর হোক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক এবং আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য একটি সুন্দর-স্বস্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক- এমন আকাঙ্ক্ষাই সাধারণ মানুষের। এই চাওয়া শুধু চাওয়ার জন্য চাওয়া নয়, অন্তরের কামনা এবং আকুতিও বটে। তাদের অন্তরের এই কামনার বাস্তবায়নের জন্যই তারা ক্ষমতাসীনদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরু করেছে, যার গন্তব্য হচ্ছে সবদিক থেকে উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নীত হওয়া। বর্তমান সরকার কৃষি, অর্থনীতি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা নানা ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পেরেছে। কিন্তু দলীয়করণ, দুর্নীতির ক্রমবিস্তার সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ কারণে সরকারের কৃতিত্বও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তাই আইনের শাসনের প্রতি আস্থা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিতে সততার সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব সীমাবদ্ধতার পরও মানুষ বিশ্বাস করে রাজনৈতিক জীবনের সুস্থতা, জনগণের প্রতি রাজনীতিকদের দায়বদ্ধতা, সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সব অন্যায়-অবিচারের লাগাম টেনে ধরতে পারবে। যদিও চলমান বাস্তবতা মানুষকে অতটা স্বপ্ন না দেখালেও, তবু এ দুঃসময়ে মানুষ আশাবাদী হতে চায়। তারা বিশ্বাস করতে চায়, আমাদের রাজনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস আর সব অনাচারের লাগাম টেনে ধরবে নির্মোহ মানসিকতায়।