• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০১৯, ০৫:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০১৯, ০৮:১৯ পিএম

বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস

মিথ্যা আশ্বাস আর বঞ্চনার ইতিহাস

মিথ্যা আশ্বাস আর বঞ্চনার ইতিহাস

কথায় বলে, পরিশ্রমই সকল সাফল্যের চাবিকাঠি। শ্রমিকের শ্রমই সকল উন্নতির মূল। মানবজীবনের যত উৎকর্ষ এবং মানবসভ্যতার যত বিকাশ-এসবের মূলেও শ্রমিকের শ্রমের অবদান। শ্রমিক শ্রম দেয় বলেই কারখানার চাকা ঘোরে, সম্পদ তৈরি হয় মানবসভ্যতার বুনিয়াদ রচিত হয়। কিন্তু যে শ্রমিকের শ্রমে এসব গড়ে ওঠে, সেই শ্রমিক আদিকাল থেকেই অবহেলিত ও বঞ্চিত। ন্যায্যমজুরি আর কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য অতীতে অগণিত শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। কারাভোগ করতে হয়েছে। শ্রমশোষণ থেকে মুক্তির জন্যই এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। মেহনতি মানুষের স্বপ্ন ছিল -দেশ স্বাধীন হলে আর শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না; তাদের অন্ন-বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হবে।

কিন্তু বাস্তবে এ আকাক্সক্ষার প্রতিফলন অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে শ্রমিকরা যে অবস্থায় ছিল, আজও তারা সেই অবস্থাতেই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক শেষ হতে চললেও তাদের সমস্যার যেন শেষ নেই। গার্মেন্ট, কৃষি থেকে শুরু করে সর্বস্তরে শ্রমিকরা এখনো ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিবেশে এবং ন্যায্যমজুরির বঞ্চনা নিয়ে কাজ করছেন। প্রতিবছর মহান মে দিবসে এ নিয়ে আলোচনা হয়, সমাবেশ-র‌্যালি হয়; কিন্তু শ্রমিকদের সমস্যার তেমন সমাধান হয় না। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, শিল্পবিরোধ, স্বাস্থ্য সমস্যা, বকেয়া মজুরি, বিনা নোটিসে ছাঁটাই, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানিসহ ঘাটে ঘাটে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।

মে দিবস নিয়ে প্রহসন

প্রতিবছর মহান মে দিবসে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো যে শ্রমিক সমাবেশ ও শ্রমিক শোডাউনের আয়োজন করে, তা মূলত শ্রমিকের স্বার্থে নয়। রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য সাজানো নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। শাসক দলগুলো শ্রমিকের স্বার্থে যদি সামান্যতম অবদান রাখত, তা হলে কি দেশের লাখ লাখ শ্রমিককে দুঃসহ-দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হতো? রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা বন্ধ হতে পারত? নামমাত্র মূল্যে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে লাখ লাখ শ্রমিককে বেকারে পরিণত করতে পারত? মে দিবসের বিজয় অর্জনের ভাগীদার সেজেছে তথাকথিত বামদের সঙ্গে দেশের শাসক বুর্জোয়া দলগুলো।

তাদের মে দিবসের এ কীর্তিকলাপের সব থেকে কুৎসিতরূপে দেখা যায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়। মাথায় লাল ফিতা বেঁধে, হেঁটে ও ট্রাকে চড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এই মে দিবস উদযাপনকারীরা দিবসটিকে শ্রমিকদের সংগ্রামের দিবস হিসেবে উদযাপন না করে পালন করে এক ধরনের উৎসব ও ফুর্তির দিবস হিসেবে। এদের কাÐকারখানা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের শ্রমিকদের সব দাবি-দাওয়া পূরণ হয়ে গেছে। তারা আছে মহাসুখে! তাদের আর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই! এসব সভায় শাসক দলগুলোর প্র্রতিনিধিরা শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ, দুরবস্থা এবং তার সমাধান ও লাঘবের বিষয়ে কিছু ভন্ডামিপূর্ণ কথাবার্তা ছাড়া শ্রমিকদের উদ্দেশে যে কথাগুলো বলে তা হলো, দেশের উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের আরও কাজ করে যেতে হবে, আরও পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, আরও বেশি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে! এভাবে মে দিবস পালন করে শ্রমিকরা তাদের Ôকর্তব্যÕ সম্পর্কে যাতে আরও উৎসাহী হতে পারে, সেজন্য তাদের আরও নানা উপদেশ ও পরামর্শের কমতি থাকে না। শ্রমিকদের স্বার্থের কথা তারা বাস্তবত চিন্তা করে না, সে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন ও সময়ও তাদের নেই।

আইন প্রণয়নে শাসকদের অনীহা

গণতান্ত্রিক শ্রমআইনের দাবি স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘদিনের। শ্রমিকদের দাবি ও আন্দোলনের ফলে ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে শ্রমআইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে প্রণীত আইনগুলো আলাদা আলাদাভাবে থাকা ৫০টি আইন একত্রিত করে একটি একক আইন হিসেবে প্রণয়নের কথা ছিল। কিন্তু শ্রমিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শ-প্রস্তাব উপেক্ষা করে, এমনকি সংসদ সদস্যদের অবহিত না করে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শ্রমআইন সংসদে পাস করা হয়। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার সংসদে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা সুযোগ না দিয়ে মাত্র ২ মিনিটে আইনটি পাস করে। ২ মিনিটে আইন পাসের মধ্য দিয়েই শ্রমিকদের প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর মনোভাবের ধারণা পাওয়া যায়। তাই এ শ্রমআইনকে শুরু থেকেই দেশের ক্রিয়াশীল সব শ্রমিক সংগঠন অগণতান্ত্রিক শ্রমআইন হিসেবে আখ্যায়িত করে।

শ্রমিক সংগঠনগুলো এ আইনকে অগণতান্ত্রিক শ্রমআইন আখ্যায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে। সে কারণে সংগ্রামরত শ্রমিকদের সন্তুষ্টি বিধানে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণেই মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৩ সালে শ্রমআইনে সংশোধনী আনে। নামকাওয়াস্তে শ্রমআইনের এই সংশোধনী নিয়েও দেশে-বিদেশে সমালচনা-আলোচনা শুরু হয়। সংশোধিত এ আইনকেও  কালো আইন আখ্যায়িত করে শ্রমিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। শ্রমিকদের প্রতি শাসকদের অবজ্ঞা-অবহেলার জন্যই ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে চার দফা শ্রমআইনের সংশোধন করতে হলো। শ্রমিকদের প্রতি তাদের অবজ্ঞা-অবহেলার এখানেই শেষ নয়।

শ্রম বিধিমালা প্রণীত হয় ২০১৫ সালে। ত্রিপক্ষীয় (সরকার, মালিক, ও শ্রমিক) পরামর্শক কমিটির আলোচনায় খসড়া বিধিমালা নিয়ে আপত্তি তুলে কিছু সুপারিশ করে শ্রমিকপক্ষ। সেসব সুপারিশ যোগ করে পুনরায় বিধিমালাটি শ্রমিকপক্ষকে দেখানোর পরই তা গেজেট আকারে প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রæতি রক্ষা করা হয়নি। বিধিতে জায়গা পায়নি শ্রমিকপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সুপারিশ। এখানেও মালিকপক্ষের চাপে মূলত মালিক-সহায়ক বিধিমালা তৈরি করে সরকার।

 

শ্রমআইনে শ্রমিকের স্বার্থ

 

৪১টি ধারা সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮ দশম সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়। আইএলওর চাপে এ সংশোধন করা হলেও এখনও আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অনেকের অভিমত। স্বাধীনভাবে সংগঠন করা এবং পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করার আইএলও স্বীকৃত অধিকারের জন্য বাংলাদেশের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। ২ হাজারের বেশি শ্রমিক যেসব কারখানায় আছে, সেখানে ২০ শতাংশ শ্রমিক সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন করার বিধান করা হচ্ছে বলে প্রচার করা হলেও ২ হাজারের কম শ্রমিকের কারখানায় আগের বিধানই কার্যকর রয়েছে। শ্রমআইনের ২৩, ২৬, ১৮০ ধারা বহাল রেখে ইউনিয়ন করা যে কার্যত অসম্ভব, তা শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে। এসব ধারা সংশোধিত আইনে এখনও বহাল আছে।

কর্মক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ২ লাখ টাকা নির্ধারণ করাকে মেহনতী মানুষের জীবনের সঙ্গে উপহাস করার সামিল বলে মন্তব্য করেছেন শ্রমিক নেতারা। রানা প্লাজা ধসের পর হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছিল। স্কপের পক্ষ থেকে কর্মক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের জন্য আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের দাবি জানানো হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এসবের ধারেকাছেও রাখা হয়নি।

পাস হওয়া আইনে, দৈনিক কর্মঘণ্টাকে ৮ ঘণ্টা থেকে ১০ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে খাওয়া ও প্রার্থনার বিরতিসহ কর্মঘণ্টা হিসাব করা হলেও নতুন আইনে খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য বিরতি ব্যতীত সময়কে কর্মঘণ্টা বলা হয়েছে। অথচ দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টার দাবি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দাবি, একটি স্বীকৃত মানবাধিকার। আইনের এই ধারার মাধ্যমে মালিকপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের অতিরিক্ত খাটানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

বিদেশিদের চাপে নামকাওয়াস্তে শ্রমআইনের চতুর্থবার সংশোধন করা হলেও শ্রমিকদের স্বার্থহানিকর ধারাগুলোয় কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এ রকম কয়েকটি ধারাÑ ২৭-এর ৩ (ক) : এ ধারা নতুন সংযোজন করা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে শ্রমিক ১০ দিনের অধিক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে- মালিকের হাতে এমন অধিকার দেয়া হয়েছে যা প্রয়োগ করে শ্রমিকের সমস্ত পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারবে। ৪-এর (১১) নং ধারা : আউট সোর্সিংয়ের বিধান থাকছে। তা হলে আর নিয়মিত চাকরি বলে কিছু থাকবে না। ঠিকাদার কর্তৃক নিয়োগকৃত শ্রমিককে দিয়েই কাজ চালাবে মালিক। এ ধারার মাধ্যমে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির পথ প্রায় রুদ্ধ করে দেয়া হলো।

পাঁচ. পূর্বেকার আইনে ছিল, কোনো কারণ না দেখিয়ে মালিক শ্রমিকের চাকরির অবসান করতে পারবেন না। তবে মাসিক বেতনভুক্ত/নিযুক্ত শ্রমিকদেরকে ১২০ দিনের লিখিত নোটিশ অথবা ১২০ দিনের মজুরি দিয়ে বিদায় করতে পারবেন। অন্যান্য শ্রমিককে ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ অথবা সমপরিমাণ মজুরি দিয়ে বিদায় দিতে পারবেন। নতুন আইনে শ্রমিকদের টারমিনেশন বেনিফিট থেকে বঞ্চিত করার- মালিকদের আরও পাওয়ার এবং শ্রমিকদের না পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী এ রকম আরও বহু ধারা বারবার আইন সংশোধনের পরও রয়েই গেছে। শ্রমআইন সংশোধনের নামে যা করা হচ্ছে তা শ্রমিকের অধিকার সংকোচনেরই নামান্তর।

আইনের প্রয়োগহীনতা

সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, শ্রমআদালতগুলো মামলা দায়েরের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রায় দিয়ে দেবে। ৯০ দিনের মধ্যে কোনোভাবে দেয়া সম্ভব না হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই রায় দিতে হবে। অর্থাৎ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ করতে হবে। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালকেও ৯০ দিন করে দুই দফায় ১৮০ দিনে মধ্যে অবশ্যই আপীল শেষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে তা ভুক্তভোগীরা ভালো করেই জানে।

কোনো আইন প্রণয়নের চেয়ে তার প্রয়োগই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ছয়টি শ্রমআদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৪ সালে চট্টগ্রামে আরেকটি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতার পর দেশে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের মতো। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৮২ লাখ। এ বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কোনো আইনি সুবিধা পেতে হলে ওই সাত আদালতেরই দ্বারস্থ হতে হয়। শ্রমআদালতের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলা হলেও কার্যকর তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আবার দেশে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল মাত্র একটি, সেটাও রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। তাই আদালত শ্রমিকরা নিজেদের পক্ষে রায় পেলেও মালিকপক্ষের আপিলের কারণে নতুন করে হয়রানিতে পড়তে হয়। ঢাকার বাইরে কোনো শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় আপিলে শেষ পর্যন্ত মালিকপক্ষেরই জয় হয়। এসব অসুবিধার কারণে শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কাঠামো এখনও শুভঙ্করের ফাঁকির মতোই রয়ে গেছে।

মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে তামাশা

মায়ের চেয়ে যখন মাসির দরদ বেশি দেখা যায়, তখন বুঝতে হবে সে দরদের মধ্যে নিশ্চয় কোনো অভিসন্ধি লুকায়িত আছে। সে কথারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখতে পেলাম গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে মালিকদের আগ্রহে। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন মালিকরা। খবরটা পড়ে দেশের মানুষ তখন আশ্চর্যই হয়েছিল। একেকবার মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার ও জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়। অথচ সেই মালিকরাই কি তাহলে আজ বদলে গেল! যা হোক, তারা পোশাক শ্রমিকদের জন্য মজুরি ৫ হাজার ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। এতে এসব শ্রমিকের মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়ে বলে পত্রপত্রিকায় দেখা যায়। অথচ এ মজুরি নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে মতভেদ আগেও ছিল, পরেও দেখা যায়।  বিলস ২০১৩ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি হওয়া উচিত ১৯ হাজার টাকা। অন্য এক গবেষণায় ১৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বর্তমান বাজারদরের গড় করে দেখা গেছে, স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের আমলে সর্বনিম্ন মজুরিতে যেসব পণ্য পাওয়া যেত, সেসব পণ্য পেতে এখন লাগে ২৩ হাজার ৬৫০ টাকা। তৈরি পোশাকশিল্পের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করে আসছিল। সিপিডির এক গবেষণায় দেখানো হয়, প্রত্যেক শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছে, একজন শ্রমিকের মূল বেতন ১০ হাজার ও মোট বেতন ১৬ হাজার টাকা হওয়া প্রয়োজন। শ্রমিকদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মূল্যায়নকে থোড়াই কেয়ার করে সরকার ৮ হাজার টাকা ঘোষণা করে। তাদের মনোভাব এমন, এ বেতন দিয়ে শ্রমিকরা যেন স্বর্গসুখে বাস করতে পারবে!

মজুরি নিয়ে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে- নতুন কাঠামোতে মজুরি বাড়েনি, উল্টো ২৬ শতাংশ কমেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে টিআইবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পর্যালোচনায়ও পোশাক শ্রমিকদের বেতনে কমছে মূল মজুরির অংশ। ২০১৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বাড়ার কথা। ৫% হারে বাড়লে যার এখন পাওয়ার কথা ৫২০০ টাকা, তিনি পাচ্ছেন ৫১৬০ টাকা। অর্থাৎ কমেছে ৪০ টাকা! যার পাওয়া উচিত ৮৯৩২ টাকা, তিনি পাচ্ছেন ৮৫২০ টাকা। পুরো ৪১২ টাকা কম! তা ছাড়া ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডের অনেক শ্রমিকের বর্তমান বেতন আর বর্ধিত বেতন প্রায় একই। তার মানে আসলে শ্রমিকের বেতন বাড়েইনি। পাঁচ বছর পর নতুন মজুরি কাঠামোতে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কারণেই শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। পোশাক শ্রমিকদের এক সপ্তাহের আন্দোলনের মুখে নতুন মজুরি কাঠামোর ছয়টি গ্রেডে মজুরি বাড়ায় মাত্র ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা। এত আন্দোলন, এত কষ্ট, এত আলোচনা বিফলের ষড়যন্ত্রটা আসলে কার?

জাতীয়ভিত্তিক মজুরিকাঠামো নেই

বাংলাদেশে জাতীয়ভিত্তিক কোনো ন্যূনতম মজুরি নেই। শ্রমিকদের দিক থেকে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরির দাবি থাকলেও শিল্প মালিকরা কোনোভাবেই এর পক্ষে নন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৮৯ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মাত্র ১১ ভাগ মানুষ কাজ করেন তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। শ্রম পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকরা শ্রম দিচ্ছেন দেশে এমন খাতের সংখ্যা ৬৭টি। এর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা রয়েছে ৪৩ খাতে। দুপক্ষের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে সরকারের পক্ষে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে সরকারও চায় না জাতীয়ভিত্তিক মজুরিকাঠামো হোক। ‘শ্রমআদালতের মামলা দ্রæত নিষ্পত্তিতে আনুষ্ঠানিক এডিআরের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাজের ধরন ভিন্ন হওয়ায় জাতীয় শ্রমমূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। তিনি আরও বলেন, জাতীয়ভাবে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় এখনও আসেনি। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শ্রমিকের প্রতি শাসকদের মনোভাব পরিষ্কার।

শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে সাঁতরিয়ে মধ্যআয়ের দেশে পৌঁছাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও উৎপাদনের মূল কারিগর শ্রমিকরা। তাদের শ্রমের ওপর ভর করেই বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। তাই প্রতিবছর বাড়ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার। দেশে এখন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও পায়রা বন্দরের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো গৃহীত হচ্ছে, কোনো কোনোটি বাস্তবায়িতও হচ্ছে। সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কের নিয়মিত উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ তো চলছেই। শিল্পায়নেও পিছিয়ে নেই দেশ। এ খাতে উৎপাদনের যে মহাযজ্ঞ, তার নেপথ্যেও রয়েছে শ্রমিকের শ্রম। স্বাধীনতাপরবর্তী ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ আজ যাদের হাড়ভাঙা শ্রমে উন্নয়নের মহাসড়কে পা রেখেছে, মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে জাতি। তাই টেকসই উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে হলে সব খাতের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নতির কথা ভাবতে হবে। শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশ, ন্যায্য শ্রমমূল্য, জীবনমান উন্নয়নসহ সবদিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। শ্রমিকরা ভালো থাকলে উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন বাড়লে মুনাফা বাড়বে। বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার আয়। এর অন্যথা হলে কাউকে ছাড়বে না মৃত ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের তরুণ প্রজন্ম।

লেখক :  সাংবাদিক