• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৪, ২০১৯, ০৩:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৫, ২০১৯, ০১:০৮ এএম

আসন্ন বাজেট : শ্রমিক-কর্মচারী ও জনগণের প্রত্যাশা

আসন্ন বাজেট : শ্রমিক-কর্মচারী ও জনগণের প্রত্যাশা

অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ২০০৮-০৯ সাল থেকে প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের পর পরই একটি বিতর্ক হতে দেখি আমরা। কেউ বলেন এত উচ্চাশার এবং উচ্চ অঙ্কের বাজেট প্রণয়ন করে অর্থমন্ত্রী ‘ভুল’ করছেন। বরং কাল্পনিক উচ্ছ্বাস (Euphoria) না দেখিয়ে তার উচিত ‘বাস্তবায়নযোগ্য’ অপেক্ষাকৃত ছোট বাজেট প্রণয়ন করা। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও তার সমর্থকদের পাল্টা যুক্তি হচ্ছে–আমাদের দেশে সরকারি মোট ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি নয়। অনেক পুঁজিবাদী দেশেই সরকারি বাজেটের আপেক্ষিক আয়তন জিডিপির (মোট অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদন) ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। আমাদের চলতি বাজেটের প্রস্তাবিত আয়তন ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। যেহেতু ২০১৮-১৯ সালে আমাদের বর্তমান জিডিপি শতকরা ৭ দশমিক ৮০ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে (বাজেট বক্তৃতা, ১১২ পৃষ্ঠার সারণি-১ ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার এক দশক’– দ্রষ্টব্য), সেহেতু এই ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি হবে অনুমিত বর্ধিত জিডিপি ২৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৭ কোটির মাত্র ১৮ শতাংশ। সুতরাং পৃথিবীর গড় মানদণ্ডে তা বেশি নয় বরং কম।

মাথাপিছু ব্যয় হিসাবে নিলে দেখা যাবে প্রস্তাবিত বাজেট ব্যয় যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তা হলে ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে আমাদের মাথাপিছু সরকারি প্রস্তাবিত ব্যয় দাঁড়াবে ২৯ হাজার ৩৫ টাকা। আমাদের অনুমিত জিডিপির ভিত্তিতে মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ১ লাখ ৬১ হাজার ১১১ টাকা। এই সাধারণ অঙ্ক থেকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় প্রস্তাবিত ‘বৃহৎ বাজেটের’ প্রকৃত তাৎপর্যটি হবে নিম্নরূপ– আমরা চলতি বছরে গড়ে প্রত্যেকে মাসে ব্যয় করব (২০১৮-১৯ সালের প্রক্ষেপণ যদি ঠিক থাকে) ১৩ হাজার ৪২৬ টাকা। সুতরাং মোটা দাগে চার জনের এক পরিবারের গড় ব্যয় তাহলে হওয়ার কথা মাসে ৫৩৭০৪ টাকা। 

তবে আমরা সবাই জানি- গড় এই সত্যের মধ্যে বিরাট ফাঁকি আছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কর্মচারী জনগণকে তাদের পারিবারিক মাসিক ব্যয় কত জিজ্ঞাসা করলেই সে বলবে- কই আমার পরিবারের মধ্যে আমি তো আয় করি মাত্র ৮-১০ হাজার টাকা, আমার স্ত্রী কষ্ট করে আরো ৪-৫ হাজার টাকা সংসারে আনেন, সব মিলিয়ে আমাকে (আমি, আমার স্ত্রী, আমার কমপক্ষে আরো দুজন নির্ভরশীল-ছেলে-মেয়ে-পিতা-মাতা নিয়ে যে পরিবার) চলতে হয় মাসে ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকায়, ৫৩ হাজার টাকা পাবো কোথায়? পক্ষান্তরে একজন ধনী লোক বলবেন ২ থেকে ৩ লাখ টাকা মাসে ব্যয় না করলে আমার চলে না। আমার পরিবারের প্রত্যেকেই গড়ে ব্যয় করেন ৬০ হাজার টাকা। এই ধরনের বিপুল ব্যয় বৈষম্য নিয়েই চলমান রয়েছে আমাদের শ্রেণিবিভক্ত বর্তমান সমাজ। 

কিন্তু চলতি বছরের এমনকি এই ধরনের ব্যয় প্রত্যাশাও কি সত্যই কার্যকরী হবে? বিশেষ করে সরকারি অংশের ব্যয় প্রত্যাশা কি প্রকৃতই বাস্তবায়িত হবে? বৃক্ষের পরিচয় ফলে। আমরা যদি শুধু চলতি বছরের আগের বছরের প্রস্তাব ও সংশোধনের হিসাবের দিকে তাকাই তাহলেই আমরা দেখি সেখানে প্রস্তাবের তুলনায় বাস্তবতা কত পিছিয়ে আছে। মুহিত সাহেবের প্রস্তাবিত চলতি বাজেটে এই চিরাচরিত ব্যর্থতার একটি স্বীকৃতি নিম্নোক্ত সারণিতে তুলে ধরা হয়েছিল-

সারণি-৩ : ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল ও সংশোধিত বাজেট (কোটি টাকায়) 

উৎস– সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯, পৃষ্ঠা-১২৭

এই তালিকাটি দেখে তখন ‘বাজেট ২০১৮-১৯ প্রাথমিক মন্তব্য’ শীর্ষক একটি লেখায় আমি যে মন্তব্য করেছিলাম তা নিচে পুনরায় উদ্ধৃত করছি—-

”উল্লিখিত তালিকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ২০১৭-১৮ বাজেটে প্রস্তাব ছিল– মোট রাজস্ব আয় আহরিত হবে ১ এক বছরে ১৩ শতাংশ (ব্র্যাকেটে প্রদত্ত জিডিপির শতাংশ)। কিন্তু নয় মাসে প্রকৃত অর্জন ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ৫ দশমিক ৮ শতাংশ আহরণ বাকি তিন মাসে অর্জন সম্ভব নয় বলে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব সংশোধন করে তা ১৩ থেকে নামিয়ে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে সংশোধিত পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু সংশোধিত পরিমাপটিও যদি পূরণ করতে হয়, তা হলে নয় মাসে মার্চ পর্যন্ত যে জায়গায় প্রকৃত রাজস্ব আহরিত হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ১১০ কোটি টাকা, সে জায়গায় পরবর্তী তিন মাসে আহরণ করতে হয়েছে বা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ৯৭ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। 

রাজস্ব আহরণকারীরা যদি আশ্চর্যজনকভাবে দক্ষ না হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যদি আশ্চর্যজনকভাবে কঠোর না হয়, তা হলে তা অসম্ভবই থেকে যাওয়ার কথা। ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও খারাপ। প্রস্তাবিত ব্যয় ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সংশোধন করে তা কমানো হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ টাকায়। প্রকৃত নয় মাসের ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে পরবর্তী তিন মাসে ব্যয় হতে হবে ২ লাখ ৪ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এটা যে কী জাদুমন্ত্রবলে সম্ভব, তা আমার মাথায় আসছে না। সম্ভবত, পাবলিক যে রকম বলে বা ভাবে যে বাজেটের শেষ তিন মাস হচ্ছে ‘গৌরী সেনের’ টাকা বিলানোর মাস– সম্ভবত সে রকম একটা অনুমান এসব অদ্ভুত অঙ্কের পেছনে কাজ করছে।”

যাইহোক এসব বিষয়ে এখন আর আনুমানিক বক্তব্যের প্রয়োজন নেই। প্রকৃত হিসাবটি আমরা আগামী জুন মাসেই নতুন অর্থমন্ত্রীর নতুন ২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটেই পেয়ে যাব। তখন বোঝা যাবে “যাদুমন্ত্র” কতটুকু কার্যকরী হলো? কিন্তু কথা হলো শেষমেষ এবারের বাজেটের প্রস্তাবিত আয়তন কত হবে? যদি আগের ধারাই বর্তমান অর্থমন্ত্রীও অনুসরণ করেন তাহলে এবারো আমাদের বাজেটের প্রস্তাবিত আয়তন হবে হয়তো ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর যদি অর্থ মন্ত্রী মনে করেন এবার সামনে নির্বাচন বা “ঘোষণাতুষ্টির” কোনও তাগিদ নেই তাহলে তিনি কিছুটা সংযত হলেও হতে পারেন। তবে ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ কোটির অংকটাই বাতাসে ঘোরাঘুরি করছে। এত বৃহৎ বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা কী হতে পারে? কিন্তু সর্বাগ্রে প্রশ্ন হচ্ছে এত টাকা আসবে কোথা থেকে?

বাজেট ও শ্রমজীবী সমাজের প্রত্যাশা

বাজেটের রাজনৈতিক অর্থনীতি যা তাতে এর চরিত্র সাধারণভাবে ধনীদের দিকেই ঝুঁকে থাকার কথা। সর্বশেষ প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হচ্ছে—সেখানে একটি মাত্র দলেরই শুধু আধিপত্য বৃদ্ধি নয়, উপরন্তু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠই পরিণত হয়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিতে (প্রায় ৬৪ শতাংশ)। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে। এখন তারা বাইশশোরও অনেক অনেক বেশিতে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবানুসারে ২০১৪ সালে নগদ কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা ৫০০০০ ছাড়িয়ে গেছে। এটা তো প্রকাশিত ব্যাংক ডিপোজিটের একটা নমুনা তালিকার হিসাব মাত্র, কিন্তু সমগ্র গোপন ও প্রকাশিত সম্পদ, দেশে ও বিদেশে, সুইস ব্যাংকের সবটা মিলালে বাংলা দেশে ধনীদের মাত্রা ও সংখ্যা হবে আরো অনেক বেশি।

 বাইরে থেকে প্রকাশিত অতি ধনী বা Ultra Rich পরিবারের তথ্যানুযায়ী জানা যায় যে বাংলাদেশে অতি ধনীদের আয়-সম্পদ বাড়ছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে! ২০১৬ সনের সর্বশেষ সরকারি “খানা আয়-ব্যয় জরিপের” হিসাবানুসারে বাংলাদেশে আয় বৈষম্যের গিনি সূচক ০.৪৮৩। তার মানে আমরা বিপজ্জনক বৈষম্য মাত্রা .৫০-র কাছাকাছি চলে গিয়েছি। এই অস্বাভাবিক ও অন্যায় উচ্চ বৈষম্য কমাতে না পারলে আমাদের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না। বড় আয়তনের মধ্যবিত্ত সমাজ ও বৃহৎ আভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রও আমরা গড়ে তুলতে পারবো না। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমরা এখন ঔপনেবিশিক “দুই অর্থনীতির” মত “দুই শিক্ষাব্যবস্থা” ও দুই “স্বাস্থ্য ব্যবস্থা” তৈরি করে ফেলেছি। ধনীরা এদেশে অধিক ব্যক্তিগত ব্যয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিখাত থেকে অধিক উন্নত শিক্ষা ও অধিক উন্নত স্বাস্থ্য সেবা ভোগ করছেন। সরকারি বিদ্যালয় ও হাসপাতাল-সেবা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং মানও খুব খারাপ। সেখানে ভিড় করা গরিবরা মানহীন সেবা নিয়ে বা না নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। 

প্রতিবছর সরকার চেম্বার, অন্যান্য নাগরিক প্রতিনিধি ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বাজেটের আগে আগে একটি আলোচনা করেন। এবার শাইখ সিরাজের কল্যাণে টেলিভিশনে কৃষকদের সঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রীর অনেক আলাপের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কৃষকদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে অর্থ সাইফন হয়ে চলে আসা, আধুনিক সুযোগ সুবিধার অতি কেন্দ্রীভবন, গ্রাম-শহর বৈষম্য বৃদ্ধি, উৎপাদকদের স্তরে দাম বঞ্চনা, ইত্যাদি প্রচুর অভিযোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। পাট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনেক ইতিবাচক বক্তব্যের পরেও এই মুহূর্তে রাজপথে পাট শ্রমিকরা সড়ক অবরোধে নিয়োজিত। 

তারা চান তাদের পাটকলগুলি রক্ষা করতে সেখানে উপযুক্ত বিনিয়োগ হোক, প্রশাসকদের দুর্নীতি ও পাট কেনাবেচা নিয়ে দুর্নীতি দূর হোক, বকেয়া বেতন নিয়ে এবং ছেলে-মেয়েসহ বেঁচে থাকতে চান তারা। এছাড়া অনেক দিন থেকেই স্কপের পক্ষ থেকে খাত নির্বিশেষে জাতীয় ন্যূনতম ১০০০০ টাকা মজুরি দাবি করা হয়েছে। কিছুদিন আগে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি ১৬০০০ টাকার দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন। এত সংগ্রামের পরও তাদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। শ্রমিকরা আরো চান মালিকদের সঙ্গে সমান সমান দর কষাকষি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। হকার ইউনিয়নের শ্রমিকরাও এখন রাস্তায় আছেন। তারা ফুটপাথ থেকে উচ্ছেদের পর নতুনভাবে বিশেষ বাজারে বিশেষ পুনর্বাসনের সুযোগ চাচ্ছেন। অসৎ পুলিশের ও স্থানীয় মাস্তানদের ঘুষ ও চাঁদাবাজি থেকে তারা মুক্তি চান। নগরের সকল বস্তিবাসী দরিদ্ররা রেশন ও বাসস্থানের জন্য আন্দোলন করছেন। অতএব সহজেই বোঝা যায় বর্তমানে শ্রমিকরা-দরিদ্ররা ভাল নেই। গড় প্রবৃদ্ধির যে উচ্চহারের কথা বলা হচ্ছে তা তাদেরকে কমই স্পর্শ করছে। 

সাধারণভাবে সব ধরনের শ্রমিকদের জনপ্রিয় দাবি হচ্ছে স্থায়ী মজুরি কমিশন ও মুদ্রাস্ফীতির সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মজুরি বৃদ্ধির আইন। বৃদ্ধ হয়ে গেলে ব্যক্তি খাতে শ্রমিকদের পেনশনের ব্যবস্থা নাই। তাই সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির আওতায় ধাপে ধাপে সকল নাগরিকদের জন্য পেনশন সহ অন্যান্য খাদ্য অধিকার, বাসস্থান অধিকার ও ন্যূনতম জীবিকার বা কর্মসংস্থানের অধিকার কায়েমের কর্মসূচি গ্রহণ করে সেসব খাতে পরিকল্পিতভাবে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এসডিজি যদি সত্যই কার্যকরী করতে হয় তাহলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ধীরে ধীরে সকলকেই আনতে হবে। বাজেটে তার জন্য ব্যয় বরাদ্দ রাখতে হবে। আমরা যেন সেই কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করতে পারি যেখানে কেউ না খেয়ে থাকলে, মাথা গোঁজার ঠাই না পেলে এবং জীবিকা অর্জনের শিক্ষা ও সুযোগ না পেলে সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের (Duty Holder State) বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

প্রচলিত বাজেট ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ

শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত- দেশপ্রেমিক উদ্যোক্তার দৃষ্টিতে অতীতে গতানুগতিক ধারায় গঠিত বাজেটের সীমাবদ্ধতাগুলি নিম্নরুপ— 

ক. করপোরেট কর কমানোর মাধ্যমে অতি ধনীদের আয় ও মুনাফা ভারী করা, নানারকম ভাবে তাদের থেকে প্রয়োজনীয় প্রত্যক্ষ আয় কর, সম্পদ কর ও সারচার্জগুলি আদায় না করা। ভ্যাট ও অপ্রত্যক্ষ করের উপর অতি নির্ভরশীলতা। মূলতঃ সাধারণ মানুষের টাকায় নির্মিত হয় বৃহৎ বাজেট আর তার ব্যয় থেকে ভর্তুকি দেয়া হয় অসৎ ধনীদের। সম্প্রতি ঋণ খেলাপিদের দাপটে ডুবে যাওয়া ব্যাংককে বেল আউট করা হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলির টাকা দিয়ে। 

খ. প্রতি বছর মাত্র ১০-১১ লাখ নতুন লোককে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার আওতায় এনে সমুদ্রে একবিন্দু শিশির প্রদান করা হয়েছে। তাদের ভাতার পরিমাণও কম এবং সেই ভাতা বণ্টনে ১০-২০ শতাংশ তথাকথিত সিস্টেম লস ঠেকানো যাচ্ছে না। সেখানেও সেই একই দুর্নীতির কিকেজ দিয়ে দরিদ্রের টাকা অদরিদ্ররা নিয়ে নিচ্ছে।

গ. ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু করা হচ্ছে না বরং আইন শিথিল করে খেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে কিন্তু দোষীদের যথাযথ শাস্তি হচ্ছে না। 

ঘ. বিদ্যুৎ খাতে ও মেগা প্রকল্পে প্রচুর ব্যয় হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নানা কারণে ঈড়ংঃ ধহফ ঞরসব ঙাবৎ জঁহ হওয়ায় এসব প্রকল্প শেষে সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা পাওয়া যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন খাতে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে সর্বত্র প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। 

ঙ. হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। তা ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা আর্থিক খাতে বা বাজেটে নেই। 

চ. প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু প্রবৃদ্ধি সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। 

ছ. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি সামাজিক খাতে ইস্পিত মাত্রায় বা এমনকি সরকারের ঘোষিত পলিসি বা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। যতটুকু দেয়া হয় তা-ও ঠিকমত ব্যয়ের ক্ষমতা এসব মন্ত্রণালয়ের নেই।

জ. বাজেটের জনকল্যাণমূলক দিক কম এবং তা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। প্রতিরক্ষা ও আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণ খাতের ব্যয় স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আর যেসব খাতে ধনীদের লাভ, দুর্নীতিবাজদের লাভ, ক্ষমতাসীনদের লাভ দেখা যাচ্ছে সেগুলোয় বরাদ্দ বেশি এবং তা ঠিকই বাস্তবায়িত হয়। 

ঝ. সুতরাং অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ীর ত্রয়ী কোয়ালিশন এবং ক্ষমতাকাঠামোটি না ভাঙলে এ সর্বগ্রাসী সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব।

উপসংহার

আমি বলছি না যে, এ সময়ে কোনোই অর্জন হয়নি। চলতি অর্থ বছরের ২০১৮-১৯ বাজেট বক্তৃতার ৭-২৭ পৃষ্ঠায় অর্জনগুলোর পুংখানুপুংখ বর্ণনা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব ভালোভাবেই দিয়েছেন। কিন্তু আমি বলবো এরমধ্যেও যা অর্জিত হয়েছে, তা হয়েছে মুখ্যতঃ সাধারণ জনগণের কঠোর পরিশ্রমের ভিত্তিতে। বাংলার কৃষক, পোশাক শিল্পসহ শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক এবং গ্রামেগঞ্জে ছোট ও মধ্য মানের উদ্যোক্তারা কম ভোগ করে এবং বেশি পরিশ্রম করেই এই সামগ্রিক গড় সাফল্যের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অধিকতর ক্ষমতাবানরা এর সুফল ভোগ করেছেন তুলনামূলকভাবে বেশি। জনগণ সামান্য কিছু অংশ পেলেও তাঁদেরকে যদি আমরা তাঁদের ন্যায্য পাওনাটুকু দিতে পারতাম, তা হলে আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ ও ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ অর্জনের পথে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে পারতাম।
 
 লেখক : অর্থনীতিবিদ,অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়