• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৫, ২০১৯, ০২:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৫, ২০১৯, ০৯:০৫ পিএম

ইতিহাস কথা কয়

ইতিহাস কথা কয়

 মুক্তিসংগ্রামে বিদ্রোহী বেতারের অপরিসীম ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কে কতটা স্বীকার করল কি করল না, তাতে কিছুযায় আসে না। যৌবনে রাজপথে গানে উচ্চকিত কণ্ঠ, শহীদ মিনারে কী পল্টন ময়দানে, কী টঙ্গীর শ্রমিকাঞ্চলে অথবা নওগাঁর ঈদগাহময়দানে, সিলেটে কুলাউড়ার কৃষক সম্মেলনে, চট্টগ্রামের জাম্বুরী মাঠে- এমনি কত না কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতার সমাবেশে ধারাভাষ্যপাঠের বলিষ্ঠতায় যে কণ্ঠকে নিরন্তর কাজে লাগিয়েছিলাম, পাকিস্তানি বেতারে কোনোদিন যাইনি তীব্র ক্ষোভে-প্রতিবাদে; সেই আমিই গিয়ে উপস্থিতহলাম কলকাতায়, ১৯৭১-এর মে মাসে।

লক্ষ্য, আমার এই কণ্ঠ এখন দেশের মুক্তিসংগ্রামে কাজে লাগাতে চাই, তাই ভাবলাম, শ্লোগান দেয়া এ কণ্ঠকে আজ শত্রুর বিরুদ্ধে মুক্তির যুদ্ধে লাগাতে হবে। অবশেষে স্বাধীন-বাংলা বেতার কেন্দ্র বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজিজুলহক বাদশা আমাকে পৌঁছে দিলেন। (তিনি আজ নেই, তাকে স্মরণ করছি)শুরুর দিন থেকে বিজয়ের ঐতিহাসিক দিন কাটিয়ে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকা ফিরলাম মুক্ত স্বদেশে, সঙ্গে সহযোদ্ধা আশফাকুর রহমান খানও প্রকৌশলী শরফুজ্জামান। তখন ‘বাংলাদেশ বেতার’ নাম হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। ওইদিন দুপুরে ফিরলেন প্রবাসী সরকার,তার ধারাবিবরণী দিতে হলো আমাকে। তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা এলো। দু’দিন বাদেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন বেতারেই থেকে যেতে। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতার ঢাকা এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস, বাংলাদেশের দায়িত্বপালনকালে যে অম্লমধুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সে কথা পারলে পরে লেখার আশা রইল। কারণ হত্যার হুমকি তো তখন থেকেই পাচ্ছি তবুবাংলার সাহসী মানুষের সঙ্গে আজও গলা মেলাই নিঃশঙ্কচিত্তে।

এ সময়ের ঐতিহাসিক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা হলো ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। সেদিন ঢাকার তেজগাঁওবিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী প্রচার করেছিলাম আমরা আশফাকুর রহমান খান ও আমি বিমানবন্দরে আর সঙ্গে আকাশবাণী কলকাতারদেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দিল্লির ইংরেজি ভাষ্যকার সুরজিত সেন আর হিন্দিতে যশদেব সিং অথবা উর্দু ভাষ্যকার কে কে নায়ার। তবেবাংলাদেশ বেতারের চারটে স্পট ছিল ধারাভাষ্যের জন্য। মাঝে দুটোতে ছিলেন মোস্তফা আনোয়ার ও আশরাফুল আলম এবং এইচশিকদার ও শহীদুল ইসলাম। শেষ স্পটে যাওয়ার কথা ছিল আমার ও আশফাকের কিন্তু জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের কারণে আমরা শেষ পর্যন্তপৌঁছতে পারলাম না। তবে আশরাফুল কাছে থাকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এরপরই আবার বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফরে গেলেন। তখনো আমি,আশফাক, ডা. মুনীরুজ্জামান ও জনসংযোগ ব্যক্তিত্ব তাজুল ইসলাম ধারাভাষ্য দিয়েছিলাম কলকাতা দমদম বিমানবন্দর থেকে। সে এক অন্যধরনের অভিজ্ঞতা। আবার যখন ১৯৭২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি এলো, তখন বাংলাদেশ বেতারের ডিজি এমআর আখতার মুকুল বললেন,একুশের ভোররাত থেকে নিউমার্কেট আজিমপুর বেবী আইসক্রিম মোড় থেকে বাংলাদেশ বেতার সরাসরি প্রভাতফেরি ও মিছিলগুলোরধারাবিবরণী প্রচার করবে এবং শেষে আমরা চলে যাব কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখান থেকে সম্প্রচার করা হবে গোটা শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠান।


হলোও তাই। মিছিল প্রভাতফেরি যাচ্ছে আজিমপুর কবরস্থান আর ফিরে চলেছে শহীদ মিনারে, তার বিবরণী আশরাফুল প্রচার করছেননিউমার্কেট থেকে আর মুকুল ভাই, আশফাকসহ আমরা বেবী আইসক্রিম মোড় থেকে। শেষে গেলাম শহীদ মিনারে। এই প্রথম স্টুডিওরবাইরে শহীদ দিবসে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান ও ধারাবিবরণী প্রচার করা হলো। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ছাড়লেও শহীদ দিবসেধারাভাষ্যের জন্য আমাকে থাকতে হয়েছিল। আমি তখন দৈনিক জনপদে বার্তা সম্পাদক। সেবার ধারাবিবরণী সম্প্রচারের সময় শহীদ
মিনারের ওপর ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ও জাসদপন্থিদের পাল্টাপাল্টি মিছিলে শেষ পর্যন্ত সম্প্রচার চালানো সম্ভব হয়নি। যে ধরনের শ্লোগান চলছিল শহীদ মিনার চত্বরে, তাতে সম্প্রচার সম্ভব ছিল না। এছাড়া ১৯৭৩ সালে যে অনন্যসাধারণ লোকসংগীত উৎসব শাহবাগ বেতার ভবন চত্বরে আয়োজিত হয়েছিল, আজ পর্যন্ত আর কেউ এমনটি আয়োজন করতে পারেনি। দুঃখের ব্যাপার, এক কুৎসিত চক্রান্তে আমাকে বেতার ছাড়তে হয়েছিল সেদিন। তবে সাংবাদিকতায় আবার ফিরেছিলাম।

বিজয়ের পরপরই বাংলাদেশ বেতার ঢাকার দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ায় আমি বিপদে পড়েছিলাম দুটি কারণে, এক. যারা বেতারে কাজ করছেন, তাদের কেউ বা ভূমিকা সেই যাচাই-বাছাই করা এবং দুই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেতার পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন।কোথায় পাব টাকা। তখন তো বাংলাদেশের টাঁকশাল চালু হয়নি, কিন্তু বেতার চালাতে গেলে তো অর্থের প্রয়োজন। তাছাড়া বেতারের নিরাপত্তা বিধান করছিল ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হতো। অবশেষে আমার অগ্রজ সাংবাদিক
ফয়েজ আহমদের কাছ থেকে দুই হাজার ভারতীয় টাকা ধার করে চালাতে হয়েছিল। ফয়েজ ভাই সে টাকা ফেরত নিয়েছিলেন যথাসময়েই কিন্তু আমি যাদের দিয়েছিলাম, তাদের কাছে আর চাইতে পারলাম না।

এই সময় আমাদের নিরাপত্তার জন্য ‘হোটেল পূর্বাণী’তেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। সচিবরা সবাই এখানেই ছিলেন। আমি এবং আশফাকুর রহমান খান দুজনই থাকতাম। কারণ আমি বেতারের লোক নই। বেতার কাঠামো কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া আগেবর্ণিত দুটির প্রথম কারণটির জন্য আশফাক সাহেব ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু যত যাই বাছাই করি না কেন, যারামুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকায় থেকে পাকিস্তান সরকারের তাঁবেদারি করেছেন, দেখলাম তারাই যেন আমাদের চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা। যেহেতু আমি
বেতারের লোক ছিলাম না, সে জন্য ওদের আমার প্রতি অনীহা ছিল। কিন্তু প্রবীণ বেতার ব্যক্তিত্ব আশরাফুজ্জামান খান যখন ডিরেক্টর ইনচার্জহয়ে এলেন। তার পরামর্শে কাজ করছিলাম। এরপর এলেন এমআর আখতার মুকুল তারপর এনামুল হক। ভদ্রলোক পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগের সহকারী তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন ‘৭১জুড়ে। এমনকি বৌদ্ধভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোকে পাকিস্তান সামরিক সরকার যখন হেলিকপ্টারেকরে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ‘মটিভিশনাল’ বক্তৃতা করাতেন, সেই সময়জুড়েই এনামুল হক সাহেব বিশুদ্ধানন্দের সঙ্গেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ধরে বেতারের মহাপরিচালক হয়েছিলেন।

তিনি আসার পর তাকে যারা ডিজি হিসেবে মানতে চাননি, তারাই দেখলাম একদিন আমার অফিস কক্ষ দখল করে সভা করছেন, আমি সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে তারা এই দখল খাটিয়ে তাদের পছন্দ মতন একজনকে আমার আসনে বসিয়ে ভেতরেই সভা করছিলেন। ঘরে ঢুকে আমি তো থ। তারপর ডিজি অফিসে আমার জায়গা হলো বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার। তারপর অবশ্য ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের সহযোদ্ধা শহীদুলইসলামের দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতায়। সেখানে মুকুল ভাই আমাকে প্রথম পরিচালক করে বসালেন। বিব্রতবোধ করলাম। সহযোদ্ধার সবকাজ ছিল সৃজনশীল, তাকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইনি। তার যোগ্যতা, সৃজনশীল কর্মকা-কে বাধাগ্রস্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ঠিকতেরো মাসের বিড়ম্বিত বেতার অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে এবং দুর্যোগপূর্ণ পুনর্গঠনের সময় পার করে বেতার ছেড়ে চলে এসেছিলাম সেই
পুরনো সাংবাদিকতা পেশায়। এ কথাগুলো বাহুল্য নয়, বাস্তব। তাই সংক্ষিপ্তাকারে বলে ফেললাম। কারণ এসব কথা কেউ লেখেন না।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিন দিন কর্মবিরতি পালন করেছিলেন কতিপয় শিল্পী, লেখক ও কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের লড়াইকালে নিজেদেরপদমর্যাদা ও বেতন হারের দাবিতে। এটি আমাদের কয়েকজনকে ভীষণভাবে বিড়ম্বিত করেছিলাম। তাই ইতিহাস বিকৃত না করে বিষয়টিসংক্ষিপ্ত হলেও লিখলাম।

\
এছাড়া ‘জয় বাংলা বেতার’ নামেও একটি বেতার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। সে এক দুঃসাধ্য স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বেতার মেরামতের দোকান তার মালিক কী করে বুয়েটের এক ছাত্রের সাহায্য নিয়ে অসাধ্য সাধন করার প্রয়াসে ট্রান্সমিটার কী করে তৈরি করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং তার নাম দিলেন ‘জয় বাংলা বেতার’। এর অনুষ্ঠান বিস্তৃত ছিল মাত্র ২৫ মাইল। সেখানে তরুণ-তরুণী যারাকাজ করতেন, তারা এক-দুজন ছাড়া সবাই বেঁচে আছেন। এরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাদের তৈরি ‘ট্রান্সমিটার’ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ দিয়েদিয়েছেন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিরাজগঞ্জ শহরে।  এর কথা কেউ লেখেননি কোনো বইতে। এই দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীরা এখনবয়োজ্যেষ্ঠ হয়েছেন, তাদের সবাইকে অভিনন্দন। আমি তাদের দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের কথা সামান্য হলেও উল্লেখ করলামছবিসহ।না বলা অনেক কথা এবং স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর কাজের মধ্যে দেশপ্রেম ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আর স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতার কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বেতারকর্মী ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে। স্থাপিত ও প্রচলিতনেতার সম্প্রচারে অভ্যস্ত এবং কারিগরি সহযোগিতা তাদের ছিল বটে কিন্তু ঝুঁকি ছিল সার্বক্ষণিক। তাই চট্টগ্রামের ‘বিপ্লবী বেতার’ প্রতিষ্ঠারউদ্যোগ ছিল তাৎক্ষণিক ও প্রয়োজনানুযায়ী একটি সিদ্ধান্ত। তাদের সময়ও পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। বহু ঘাত-প্রতিঘাতেরমধ্য দিয়ে তাদের পৌঁছতে হয়েছিল প্রতিবেশী দেশে।কিন্তু সিরাজগঞ্জ শহরের একটি বেতার মেরামতের দোকানে, দোকান মালিকের বেতার সম্প্রচারের উদ্যোগটি ছিল একেবারেই ব্যক্তি পর্যায়েএবং দুঃসাহসিক প্রয়াস। কোনো যান্ত্রিক সহযোগিতা ছাড়াই তারা সাধারণভাবে সম্প্রচার যন্ত্র তৈরি করে ‘জয় বাংলা বেতার’-এর অনুষ্ঠানপরিচালনা করতেন।এমন অনেক অজানা ঘটনাই জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে। এসিব নিয়ে আবারো লেখা হবে


লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক