• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৯, ২০১৯, ০৪:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১১, ২০১৯, ১১:০৭ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়

বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা এক ছিল না। কিন্তু একটি অভিন্ন স্বপ্ন ছিল, সেটা হলো মুক্তি।এই যুদ্ধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ হিসেবেই দেখি। কেবল স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার চেয়েও বেশি। '৪৭ সালে আমরা একবার স্বাধীন হয়েছিলাম।তার পরও দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার প্রয়োজন হলো এ জন্য যে '৪৭-এরস্বাধীনতা আমাদের মুক্তি দেয়নি। মুক্তি অর্থটি স্পষ্ট করা দরকার।

মুক্তি হচ্ছে, প্রধানত অর্থনৈতিক মুক্তি। অন্য মুক্তি অর্থাৎ, সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক ও ভাষাগত মুক্তির কথা আসবেই; কিন্তু আমি মনে করি, সব শ্রেণীর মানুষই আশা করেছিল এই সংগ্রাম তাদের অর্থনৈতিক মুক্তিদেবে। মানুষ দেখেছে '৪৭-এর পর যে অর্থনৈতিক মুক্তির আশা ছিল, তা পূরণ হলো না যার জন্য '৪৭-এর পর থেকেই মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেবিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। '৫২ সালে যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, তা ওই বিক্ষোভকেই রূপ দিয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই আসলে বিদ্রোহ ছিল। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পেছনেও মুক্তির ব্যাপারটা ছিল। ভাষার ওপর যে আক্রমণ, সেটাকে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যতের ওপর আক্রমণ বলেইমনে করেছে। মনে করেছে, এ রাষ্ট্রে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবে। অবাঙালিদের কিংবা উর্দুভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে না।অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না। অস্পষ্ট হলেও সেটিই উপলব্ধি ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা যে সামনে এসেছে, তার কারণ হচ্ছে ছাত্ররা দেখতে পেয়েছে যদি রাষ্ট্রভাষা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তবে তার ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন।

 দেশের সব মানুষ ক্রমে বুঝতে পারল পাকিস্তানি এই রাষ্ট্রে তাদের মুক্তি মিলছে না। অর্থনৈতিক বৈষম্যটা প্রবল হলো। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধিশালী হচ্ছিল। মুক্তির ওই আকাঙ্ক্ষাতেই মানুষ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার কথা ভেবেছে। সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে জনগণ ওই মুক্তির এক ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ থাকবে, সবটা মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের কথাও ছিল।সমাজতন্ত্রের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণাটা অস্পষ্ট হলেও তা এই রকমের ছিল যে এই রাষ্ট্র তাকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেবে। গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। সমাজতন্ত্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলে।

 গণতন্ত্র  মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়তিষ্ঠিত হবে না, যদি অর্থনৈতিকভাবে মানুষের মুক্তি না আসে। গণতন্ত্র বলতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে কথাটা বলা হয় ভোটাধিকার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সেসব তো থাকবেই; কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমরা তাকেই বলব, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটাবে, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাবে। দ্বিতীয় হলো, সমাজে অধিকার এবং সুযোগের একটা সাম্য থাকবে। যেখানে অধিকার এবং সুযোগের সাম্য নেই সে রাষ্ট্রকে, সে সমাজকে কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক বলা চলে না।মুক্তির দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানুষ যুদ্ধ করল। 

যুদ্ধের মধ্য দিয়েই মানুষের গণতন্ত্রের দাবি প্রতিষ্ঠিত হলো।যদিও সমাজতন্ত্রকেও মুছে ফেলা হয়েছে, তবুও মানুষ যে একটি নতুন সমাজ চায় এ আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। মানুষের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। রাষ্ট্র যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, কাজেই আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নানা জায়গায় মর্যাদা পাচ্ছি। স্বীকৃতি পাচ্ছি।বাঙালিরা সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে পারছে, যে সুযোগ লাভ পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে কখনোই সম্ভবপর ছিল না। বিদেশে চাকরি ও কর্মসংস্থান হচ্ছে এটা অবশ্যই বড় অর্জন। তবে মুক্তির জন্য সমাজে মৌলিক পরিবর্তন দরকার। আমাদের এখানে উন্নতি অনেক হচ্ছে। 

একদিক থেকে এটাকে আমরা ইতিবাচক দিক বলতে পারি; কিন্তু এটির নেতিবাচক দিকও আছে। উন্নতি মানে এখানে ২০ শতাংশ লোকেরউন্নতি, আর ৮০ জন লোক নানাভাবে এই উন্নতির বোঝা বহন করছে। কাজেই অল্প লোক ধনী হচ্ছে বহু লোককে দরিদ্র করে। এই ধনবাদীবিকাশের প্রক্রিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রেও ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলা হয়। প্রথমে অসামরিক, পরে সামরিকআমলাতন্ত্র শাসন করছিল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের উন্নতির দর্শন ছিল পুঁজিবাদী দর্শন। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের মধ্যে রাষ্ট্র বিকশিত হবে। মাথাপিছুআয়কে প্রবৃদ্ধির লক্ষণ ধরা হতো। এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেই কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম।

আমরা পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাইনি; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমলাতন্ত্র রয়ে গেল। অবিশ্বাস্য ছিল যে বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তো সত্য,সামরিক শাসন তার পরও এসেছে। আমরা এখন নির্বাচিত সরকার পেয়েছি, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক শাসন এখনো যায়নি।অস্থিতিশীল অবস্থায় আছি আমরা। এই অবস্থাকে বাইরে থেকে মনে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। তা তো বটেই। রাষ্ট্রের যে তিনটি অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ, তারা কে কতটা দায়িত্ব পালন করছে সে প্রশ্নটি বড়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গেবেকারত্বের যোগ রয়েছে। 

এ সমাজে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন। উপার্জনের সৎপথ খোলা নেই। তাই সে বেছে নেয় নৈতিক আত্মহত্যার পথ, মূলত ওই বেকারত্বের কারণে। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা জানে যে ওটা বিপজ্জনক কাজ। পরিণতিও জানে। সে এ কাজে জড়িত হতেও চায় না, কিন্তু তার কাছে এর কোনো বিকল্প নেই। অপরাধের যথাযথ শাস্তি হচ্ছে না। অপরাধীর শাস্তি না হলে অপরাধ বাড়বেই। মানুষ স্বর্গীয় প্রাণীনয়। তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকবেই। এই ইতর প্রবৃত্তিকে শাসন করা দরকার। শাসন করার দুটি পদ্ধতি আছেএকটি হচ্ছে অপরাধ
করলে শাস্তি দেওয়া হবে, দ্বিতীয়টি হলো দৃষ্টান্ত।

 শাস্তিও বটে, আবার দৃষ্টান্ত তুলে ধরাও বটে, দুটিই চাই। যাদের দেখে পরোপকারী দেশপ্রেমিক হওয়া যায়, সে দৃষ্টান্তের অভাব রয়েছে। '৪৭ সালের পর থেকে '৭১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় তরুণের সামনে একটা লক্ষ্য ছিল,বিশ্বাস ছিল সে এ ব্যবস্থাকে বদলাবে। বদলনোর সে স্রোতধারা ক্রমে বিকশিত হয়ে রূপ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ব্যবস্থা বদলেরকাজ আনন্দদায়ক, সৃষ্টিশীল কাজ। এই সৃষ্টিশীল আনন্দদায়ক ও দুঃসাহসিক কাজের যে চ্যালেঞ্জ তরুণের কাছে ছিল, আজ তা নেই। স্বাধীনতার পরই যদি আমরা সমাজবদলের আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারতাম, তবে তরুণরা এ আন্দোলনে যোগ দিত, চরিতার্থতা খুঁজে আনন্দ পেতো বুঝত সামনে ভবিষ্যৎ আছে। মানুষের মধ্যে মহত্ত্ব ও দুর্বৃত্তপনা থাকে, ব্যক্তি কোনটিকে বিকশিত করবে সেটাই বড় ব্যাপার। আমরা যেহেতু ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছি না, সেহেতু দোষগুলোই বেরিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে এখন বড় দুই দলের রাজনীতি হচ্ছে ভোট পাওয়ার রাজনীতি। কোনো প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। ক্ষমতায় এইযাওয়া-আসার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দল-ও দল ক্ষমতায় যাবে-আসবে, কিন্তু জনগণের মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটাসফল হবে না। অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নকে তারা প্রধান করে তুলছে না। একজন অপরজনকে বিশ্রি ভাষায় গালাগাল করছে। কে ভোট চোর,কে চুরি বেশি করে, কে কম করে, কে হরতাল করে ইত্যাদি বক্তব্যই প্রধান। তারা মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবে না। অভাবটা নেতৃত্বের।
নিজেদের, দলীয়, বড়জোর শ্রেণী স্বার্থই তারা দেখে।

 এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, গ্যাস ও তেল বাংলাদেশের লুকানো সম্পদ। এ সম্পদ আমরা ব্যবহার করতে পারি। ব্যবহার করে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারি। কিন্তু দেখা গেছে, এই গ্যাস ও তেল বিদেশিকম্পানিগুলো যেভাবে তাদের সুবিধামতো অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিতরণ করছে, তাতে সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এটি নতুন বিষয় নয়, অতীতেও তাই হয়েছে। গ্যাস ও তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে অথচ গ্যাস ও তেল সম্পদ কার কাছে যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে এই বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট।

আদর্শের জন্য সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ হলো নিজের জীবনদান, সেটাও মানুষ করেছে। মানুষ অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধএকটি বিরাট সৃষ্টিশীল ঘটনা, এত বড় সৃষ্টিশীল ঘটনা বাঙালির জীবনে আগে কখনো আসেনি। সব মিলে মানুষ একটি নতুন সম্পর্ক সৃষ্টিকরেছিল। সৃষ্টিশীলতার দিকটি বড় দিক। কোনো অভিজ্ঞতাই হারিয়ে যায় না। এই অভিজ্ঞতাকে আরো বিকশিত তীব্র দৃঢ় ব্যাপক করারঅনুশীলন দরকার। চেতনা ও অর্জিত অভিজ্ঞতার অনুশীলন খুব জরুরি। আমরা কারা? যদি মনে করি আমরা হচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ,
তবে মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ও অভিজ্ঞতা সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সংজ্ঞাটি নিরূপণ করতে হবে।
 
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেকারা? চিহ্নিতকরণের কাজটা শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে হবে না। আমি একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলাম বলেই আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এমন নয়। পক্ষপাতিত্বটা চিরকালের ব্যাপার। এটির পরীক্ষা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। ৪০ বছর ধরে দেখছি, ভবিষ্যতেও দেখব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যদি হই, তবে তা পকেটের সার্টিফিকেট কিংবা বংশগৌরব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমার বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। আমি জনগণের মুক্তির পক্ষে কাজ করছি কি না, তা দেখতে হবে। যদি জনগণের হয়ে কাজ করে থাকি, তবে বলতে পারব আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক।

 সমমনাদের অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন তাদের পেশাগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অবশ্যইরাজনৈতিকভাবে ঐক্য গড়তে হবে। মূলকথা হচ্ছে, সংগঠিত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া। মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়টি খুব অনুপ্রাণিত করে তা হলোঐক্য এবং আপসবিমুখতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বড় অপরাধের বিরুদ্ধে লড়ছিল মানুষ, তখন ছোট অপরাধগুলো ছিল না। এক ধরনেরমহত্ত্ব এসেছিল, যেহেতু সবাই ছিল সহযোদ্ধা। এই সহযোদ্ধাদের ছিল অভিন্ন লক্ষ্য। লক্ষ্যের কারণেই গড়ে উঠেছিল ঐক্য।

 আর ছিল আপসবিমুখতা। আপসের জায়গা থেকে সরে মানুষ চূড়ান্ত জায়গায় যেতে চেয়েছে। যুদ্ধের মাঠে মনোভাবটা ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াব। বাঙালি সেদিন আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি। পরনির্ভরশীলতার পুরনো ঐতিহ্যকে ঝেড়ে ফেলে স্বাধীন হয়েছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক।