• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৪, ২০১৯, ০৬:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৫, ২০১৯, ০২:০৭ এএম

সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও ক্ষতিপূরণ

সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও ক্ষতিপূরণ

মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় যে হারে মৃত্যুর হার বাড়ছে তা ভাবাও কঠিন। প্রতিদিন কোন না কোন স্বজনের দুর্ঘটনার খবর আসে। বিচলিত হই, আবার নতুন খবর আসে।  বিশেষত নগরীর হাসপাতালগুলোতে একটু খবর নিলেই জানা যায় প্রতিদিন কি পরিমানে সড়ক দুর্ঘটনার রোগী আসে।  দেশে কি পরিমান সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে সেটা পরিস্কার বোঝা যায় পঙ্গু হাসপাতালে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। স্বজন হারানোর বেদনা সারা জীবন বইতে হয় ওই পরিবারটাকে। প্রিয়জন হারানোর কষ্টের কোনো বর্ণনা হয় না। 


যে হারায় কেবল সেই বোঝে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী,২০১৬ সালের চেয়ে ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে। প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ বেশি। ২০১৭ সালে ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ১৬ হাজার ১৯৩। হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন ১ হাজার ৭২২ জন। এসব দুর্ঘটনায় মোট যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাও জিডিপির প্রায় দুই শতাংশের মতো। জানমালের এমন ক্ষতি খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। প্রশ্ন হল, এর প্রতিকার কী? 

সড়ক প্রশস্ত করার জন্য গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। বড় বড় ফ্লাইওভার হচ্ছে। তারপরও কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে প্রতিদিন? কী করলে মৃত্যুর এ ‍মিছিল ছোট হবে তা জানেনা কেউ। দুর্ঘটনা রোধে সরকারি নির্দেশনা আছে তা মানা হচ্ছে না। ফিটনেসহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক আমাদের মূল সমস্যা। এ ছাড়াও গণপরিবহনের সংখ্যা এত কম যে মানুষ তার প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়ে গাড়িতে চড়ে।  অতিরিক্ত যাত্রী হতে তাকে বাধ্য করা হয়, নতুবা সে যাবে কোথায়? নষ্ট বাস চলাচলের অযোগ্য। এমন বাস চলাচলে বাধা দেয়া হয় না কেন? আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কত সম্ভাবনাময় মেধাবীরা হারিয়ে গেছে তা বলে শেষ করার মতো নয়। 

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এভাবে মৃত্যু কোনভাবে গ্রহনযোগ্য না। মৃত্যুর পরে দেখা যায় আরেক সংকট। স্বজন হারানোর পরে তার ক্ষতিপূরনের জন্য দিনের পর দিন পার হলেও ক্ষতিপূরণ পায় না পরিবারগুলো। এক্ষেত্রে মোজাম্মেল হোসেন মন্টু, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনির, রাজীব হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ও বিতার্কিক নাফিয়া গাজীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। নাফিয়া গাজী ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের সামনে বিআরটিসির বাসচাপায় নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর বাবা কামাল আহাম্মেদ গাজী মামলা করলে ঢাকার আদালত ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন। ঘটনার প্রায় ২৬ বছর পর ২০১৭ সালে ক্ষতিপূরণের অর্থ পায় নাফিয়ার পরিবার।

দুই দশকের বেশি সময় আগে রাজধানীর শান্তিনগরে রাস্তা পার হওয়ার সময় কোমল পানীয় বোঝাই একটি মিনি ট্রাক সংবাদ–এর সাবেক বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনকে (মন্টু) চাপা দেয়, পরে তিনি মারা যান। এ দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলায় ঘটনার ২৬ বছর পর ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায় আসে। এরপর আরও তিন বছর কেটে গেলেও ক্ষতিপূরণের ১ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা এখনো পায়নি বাদীপক্ষ (নিহত ব্যক্তির স্ত্রী)। তিনি দেশের সর্বোচ্চ স্থানগুলোতে ঘুরেও কোন সুরাহা করতে পারেননি।

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হলেও ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা কমই হয়। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আবার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারের অনেকেই জানেন না যে মোটরযান অধ্যাদেশের বিধান অনুসারে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মোটরযান ট্রাইব্যুনালে (দায়রা জজ আদালত) মামলা করা যায়। মামলা হলেও দীর্ঘসূত্রিতা, আবার আদেশ ও রায় এলেও আইনি জটিলতায় আটকে যায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়া।অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করে কতগুলো মামলা হয়েছে, সে তথ্য সড়ক দুর্ঘটনানিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়নি। 

তবে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার ও জনস্বার্থে ক্ষতিপূরণ দাবি করে রিটসহ পৃথক ১২টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, যার চারটি করেছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনায় মোজাম্মেল হোসেনের (মন্টু)  মৃত্যর পর তাঁর স্ত্রী রওশন আখতার ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে নিম্ন আদালতে মামলা করেন। এর পাঁচ বছর পর বিচারিক আদালতে এবং আরও পাঁচ বছর পর উচ্চ আদালতের রায় হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে ওই মিনি ট্রাকের মালিক বাংলাদেশ বেভারেজ। ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগ রায় দেন। 

রায় অনুযায়ী বাদীপক্ষ ১ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী।সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর না হলে বিচারপ্রার্থী কোথায় যাবেন এমন প্রশ্ন রেখে মামলার বাদী ও নিহত মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রী রওশন আখতার গণমাধ্যমকে  বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় পেতে ২৬ বছর কেটে গেছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই অর্থ আদায়ে বিচারিক আদালতে মামলা করা হয়। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করা যায়নি। এখনো মামলা চলছে। টাকা না দেওয়ায় ঢাকার তেজগাঁওয়ে ওই কোম্পানির পাঁচ বিঘা সম্পত্তি ক্রোক করে নিলামের আদেশ হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। তবে কেউ অংশ নেয়নি। ক্ষতিপূরণের অর্থ কবে পাবেন, এমন প্রশ্ন রেখে ওই অর্থ পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন রওশন আখতার।

অবশ্য বিচারিক আদালতের রায়ে ক্ষতিপূরণের ১০ লাখ টাকা পেতে ২৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী নাফিয়া গাজীর পরিবারকে। যদিও ওই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিল, যা ২০১৫ সালে বিফল হয়। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিসি ২০১৭ সালে সাতটি কিস্তিতে নাফিয়া গাজীর পরিবারকে ওই অর্থ পরিশোধ করে বলে বিআরটিসির একজন কর্মকর্তা জানান।

তারেক মাসুদ- মিশুক মুনির ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান । তারেক মাসুদ ছিলেন বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মিশুক মুনির ছিলেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) । এরপর নিহত দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে মোটরযান অধ্যাদেশের বিধান অনুসারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করা হয়। তারেক মাসুদের পরিবারের করা মামলায় ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়।

তবে রায়ের পর বাস মালিকপক্ষ ও বাদীপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে, যা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণ মামলা হাইকোর্টে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে। এ মামলায় হাইকোর্টে ১৯ জুন সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে ।সাংবাদিক মন্টু ও তারেক মাসুদের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলার প্রসঙ্গেখবর নিতে গিয়ে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় গেল ২৬ বছরে দুটি মাইলফলক মামলা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার জরুরি। আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে আদালত থেকে রায় হয়েছে।

দুটির একটি ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা আজও। সাংবাদিক, নির্মাতা ,বা ছাত্র -ছাত্রী আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কারো কোন জমা টাকা থাকে না । সাধারণত প্রায় সবার অবস্থাই থাকে হাত সম্বল। এমন পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম বা উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হন, সে ক্ষেত্রে ওই পরিবারের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ক্ষতিপূরণ জরুরি বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট জনেরা। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ঘটলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যেই ব্যাহত হতে পারে। উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকেন।

যেহেতু আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, এ দিকটি বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।  এ সংস্কৃতি চালু না করলে মৃত্যুর পরেও পরিবারগুলোর ভোগান্তির শেষ হবে না্। যেটা দুর্ঘটনার চেয়েও অমানবিক।

লেখক: সাংবাদিক

/ডিজি