• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০১৯, ০৩:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৫, ২০১৯, ০৩:৪২ পিএম

ভালো ছাত্রদের নিকট প্রত্যাশা

ভালো ছাত্রদের নিকট প্রত্যাশা

  অবস্তুগত এবং অদৃশ্যমান জিনিসের অধিকাংশই আপেক্ষিক। এই কারণেই এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিশ্বাস, অনুভূতি বা উপলব্ধির মাধ্যমে এ সব বিষয়ে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। ভাবুকদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা বেশি পরিলক্ষিত হয়। বস্তুগত জিনিসের গুণ বা দোষের ক্ষেত্রেও আপেক্ষিক অবস্থা বিদ্যমান। ভালো, মন্দ, খারাপ, সুন্দর এর মাত্রাগত ভিন্নতা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এগুলো সম্পর্কে ব্যক্তির মতের এবং পছন্দের ভিন্নতা। একটা সুন্দর জিনিস একজনের নিকট যতটা সুন্দর অন্যের নিকট সমভাবে সুন্দর নাও হতে পারে। বর-কনে বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের হের ফের সহজে ধরা সম্ভব- ফলে কালো, বোবা, কানা কেউই পড়ে নেই। সবারই দাম্পত্য জীবন দৃষ্টিগোচরে আছে। তেমনিভাবে ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোত্বের অবস্থাও আপেক্ষিক। তবে ভালোর প্রতি মোটা দাগে সবারই ইতিবাচক একটা ধারণা লক্ষ্যযোগ্য। 

সম্প্রতি দেশের দশটি শিক্ষাবোর্ডের এস.এস.সি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ২১ লক্ষ ২৭ হাজার ৮শ’ ১৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৭  লক্ষ ৪৯ হাজার ১শ’ ৬৫ জন পাস করেছে। এদের মধ্যে জিপিএ ৫  পেয়েছে ১ লক্ষ ৫ হাজার ৫শ’ ৯৪ জন। এই সকল ভালো ছাত্র-ছাত্রীর কৃতিত্ব, তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন, তাদের ভবিষ্যৎ ইচ্ছা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানোর খবর বিভিন্ন ইলেক্ট্রোনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। 

এ সমস্ত খবর মিডিয়ার পক্ষ থেকে অথবা ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। গুণের সমাদর না থাকলে সমাজে গুণীজনের সৃষ্টি হয় না। সেদিক থেকে এই প্রচারটা জাতির জন্য সুখবর। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের কথা প্রকাশ করেছে- কেউ ডাক্তার হবে, কেউ প্রকৌশলী হবে, কেউ সাংবাদিক এবং ব্যারিস্টার হবে, এগুলো তাদের স্বপ্ন অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কাজের আগাম সিদ্ধান্ত। ব্যবস্থাপনার ভাষায় এটাকেই পরিকল্পনা বলে। 

পরিকল্পনা সভ্য জাতির মাইল ফলক। জানিনা ছাত্র-ছাত্রীদের চাওয়া কতটুকু বাস্তবে রূপ নেবে। কারণ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে দ্ব›দ্ব আজীবনের। সেই কারণেই হয়তো কবি লিখেছেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করেই চাই/যাহা চাই তাহা পাই না।’ তবে পাওয়ার জন্য চাওয়াটার লিমিট থাকতে হবে। বিবেচনা করতে হবে চাওয়র যোগ্যতা, ইচ্ছা, সামর্থ্য এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধাকে। 
কিন্তু  দুঃখজনক হলেও সত্য সেই অর্থে ভালো হওয়ার পরিবেশ নেই। 

শিক্ষার আদর্শিক সঙ্কট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্থিতিশীল পরিবেশ, অভিভাবকের আর্থিক সংগতির অভাব, চাকরির ক্ষেত্রে উৎকোচ, দলীয়করণ এবং স্বজনপ্রীতি, এবং উৎকোচ গ্রহণ, পুলিশ ও র‌্যাবের ছিনতাই, ডাকাতি, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের অবাধ লুটপাট, পরপর ৫ বার বিশ্বে দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার ঘটনা- সব মিলে এ সমাজ ভালো হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না, বরং হতাশ করে মানুষকে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীর ভালো হওয়া ঝুঁকির মুখে। এই বলে জীবন সংগ্রামকে থামানো যাবে না। সমস্যা থাকলে সমাধানের পথও আছে। আশা করি রাষ্ট্রের কর্ণধরেরা ঐ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কারণ এই ছাত্র-ছাত্রীরাই আগামীতে দেশের সকল সেক্টরের হাল ধরবেন। 

তবে দু-চারজন যে লুটপাটকারী, ঘুষখোর,নারী নির্যাতক ও যৌতুক লোভী হবে না এমন আশা করা যায় না। কারণ বিদ্যমান বাস্তবতা তাদেরকে স্পর্শ করবে না এমন নিশ্চয়তা কোথায়? দেখতে দেখতে মানুষ অনেক শেখে। ভালো হওয়ার জন্য ভালো সঙ্গ, পরিবেশ, অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব সামনে থাকতে হয়। কিন্তু এটা কমতে কমতে এখন শূন্যের দিকে। যোগ্যতা, সততা-জ্ঞান-গরিমা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের অন্ধকারে রেখে টাকাওয়ালাদের উপস্থিতি আজকের প্রজন্মের সামনে যেভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাতে অভি-নিরু-কালা জাহাঙ্গীর বা রাজাকারদের মডেল ভেবে যারা তারা ওসব চরিত্রের মতো হতে চায়, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মুজিব, মণি সিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ, সুকান্ত-নজরুল, রোকেয়া-প্রীতিলতা হতে চাওয়া লোকের সংখ্যা খুবই কম। 

শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা, সকল ক্ষেত্রেই বিপথগামী রাজনীতির হস্তক্ষেপ, দলীয়করণের ভূত, স্বাভাবিক সৃষ্টিশীলতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো ফল করার পর ক্ষমতাসীন দল না করার কারণে চাকরি না হয়ে দলীয় আনুগত্যে তুলনামূলক কম মেধাবীর চাকরি হয়। ওসব ভালো হওয়ার আশায় হতাশ করে। থানা, কোর্ট ও বিচারালয় দলীয় নির্দেশনা আর উৎকোচে যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের নির্ভরতার জায়গা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আইন, শাসন, বিচার যেভাবে ধনীক, বণিক, লুটেরাদের পক্ষে নীতিহীনভাবে ব্যবহার হচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, ভোগবিলাস অন্যদিকে অধিকার বঞ্চিত বিশাল মানবের লাইন, এ অবস্থা বেশি দিন টিকে থাকবে না, অবশ্যই প্রতিরোধ হবে, তবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। এরপর তাদের নিকট জাতি প্রত্যাশা করতে পারে অনেক কিছু। কিছু দেওয়া ছাড়া পাওয়ার আশা করা যুক্তিহীন। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সুবিধা পেয়েছে এমন ভালো ছাত্ররা জাতির জন্য অবদান রাখছে তাতে প্রত্যাশা করাও আরেক বোকামি। জনতার খাজনা বা ভর্তুকি করের টাকায় ক্ষমতাবানদের সন্তানরা উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পর জাতির কথা ভুলে ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস ও ঐশ্বর্যের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমান। তারা যা কিছু করছে নিতান্তই ব্যক্তিগত স্বার্থে। চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারও মোটা অংকের টাকায় কিনে নিতে হচ্ছে। আজকের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব কিছুই মুষ্টিমেয় রাজনীতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক আমলাদের হাতে। সমাজের ১০ লাখ বিত্তশালী পরিবারের ৪০ লাখ মানুষের ভোগ বিলাসের যোগান দিতে ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় যন্ত্র। 

৯ কোটি দরিদ্র। যাদের মৌলিক অধিকার পূরণের মত আয় রোজগার বা সম্পদ নেই। প্রাক্তন মেধাবীদের আচরণ থেকে বর্তমান মেধাবীদের প্রতি প্রত্যাশা করতে সন্দিহান করে শুনেছে- “সংসার সাগরে দু:খ তরঙ্গের খেলা/আশা তার একমাত্র ভেলা।” ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা জাতির প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে এটা  আমরা আশা করি। ’স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানব তারে, পশু সেই জন।’ ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েসের জন্য সব কিছুর মধ্যেই ইতর প্রাণীর বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। মানুষ হতে প্রয়োজন মানবিকতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, সবার সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগী করে নেওয়ার মানসিকতা। ছাত্ররা অনেক কিছুই হতে চেয়েছে, তবে কেউ প্রকাশ করেনি একজন ভালো মানুষ হওয়ার কথা। বিশাল ডিগ্রি  আর পান্ডিত্য দিয়ে ভালো হওয়া যায়, তবে সেই ভালো সমাজের খুব একটা কাজে আসে না।

 ভালো ছেলে আমরা অনেক পেয়েছি, বৃত্তি পাওয়া ছেলে, টেবিলের উপর একরাশ বই খোলা, চোখে নিকেলের চশমা, খেলার সময়ও গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে বই পড়ে, বছরে বছরে পরীক্ষায় প্রথম হয়ে প্রাইজ পায়, পাড়া প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যথাকালে একান্ত একটি ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে, তারপর একজন উকিল অথবা সম্পাদক অথবা প্রফেসর হয়ে মানবজীবনে পরম পুরুষার্থ লাভ করে। সুন্দরী কনের জন্য তখন অনুসন্ধান চলে। কনের পিতাকে পথে বসিয়ে যথারীতি বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়। তারপর সর্ব প্রকার বিপদকে দূরে রেখে ঢিমে তেতালায় সংসার যাত্রা অগ্রসর হতে থাকে। ছেলের অন্নপ্রাশন, পত্নীর অলঙ্কার নির্মাণ এবং কন্যার বিবাহের মধ্য দিয়ে কবর আর শ্মশানের দিকে বয়স কালের ডাক আসে পরপার থেকে। এইভাবেই সে মানবলীলা সাঙ্গ করে। 

সবাই বলে আহ! লোকটা কত ভালো ছিল। সেরকম জাতি ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট ডিগ্রি নয়, মানবিকতা, দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম প্রত্যাশা করে। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া হচ্ছে সংবর্ধনা । এই সংবর্ধনা যেন ভবিষ্যতে তাদের অভি-নীরুদের মত অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীতে পরিণত  না করে।সন্ত্রাসী অভি-নীরুরা সন্ত্রাসী ছিল না। পরীক্ষায় ভালো ফল করায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে প্রমোদ ভ্রমণে যেয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিল। সেই দীক্ষাই একদিন তাদের সন্ত্রাসীতে পরিণত করেছিল। 

অতএব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতির সাথে সম্পর্ক থাকবে, ছাত্র-সমাজের দাবি আদায়ের জন্য ভবিষ্যৎ ভালো  রাজনীতিক হওয়ার জন্য, কিন্তু রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখল আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে নয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কালো টাকা উপার্জন, আর ধর্ষণ নির্ভর রাজনীতি থেকে অবশ্যই তাকে নিরাপদ রাখতে হবে। বাধা আসলেও বিপথগামী হবো না- এমন দৃঢ়তা রাখতে হবে। মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে না পারলেও খারাপ করা থেকে বিরত থাকলেও জাতি নিরাশ হবে না, বঞ্চিত হবে না মানুষ তার অধিকার থেকে। ডিগ্রিধারী মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করবে না জগতবাসী। ভাল/মেধাবী ছাত্রদের নিকট থেকে জাতি মানবতা আর দেশপ্রেম আশা করে। এই আশা করা নিশ্চয় কোনো অপরাধ নয়।

লেখক : অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)