• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৯, ২০১৯, ০৪:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৯, ২০১৯, ০৪:৪৩ পিএম

অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-উন্মাদনা

অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-উন্মাদনা
গোলাম মোস্তফা

ইরানকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে আবার যুদ্ধের সাজ সাজ রব উঠেছে। আতঙ্কিত বোধ করছে সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ পাঠানো এবং কাতারে বোমারু বিমান মোতায়েন নতুন করে এ উদ্বেগের কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে পরমাণু চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। গত বছরের মে মাসে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ালেও চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এ চুক্তি বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ির জবাবে ইরানও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের হুমকি দিয়েছে। হুমকি দিয়েছে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার।

বর্তমানে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলেও নাটাইয়ের সুতা যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই ধরা। এক সময় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ছিল দেদীপ্যমান। কিন্তু ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বরূপ পাল্টে যায়। পাশ্চাত্যের লেজুড়বৃত্তি করে সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং এ অঞ্চলসহ মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। বিপ্লবের পর ইরানও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে রাষ্ট্র দুটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের পাশে দাঁড়ায়। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমন্বয়ে একটি শক্তিজোট গড়ে ওঠে। এ শক্তিজোটের প্রতিপক্ষ হিসেবে আগেই গড়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের শক্তিজোট। আশির দশক থেকে পরস্পরবিরোধী এ শক্তিজোট মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নিয়মিত ঘটনাপ্রবাহে রসদ জুগিয়ে চলেছে।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আবির্ভূত হয় বিশ্বের পুঁজিবাদীদের লালনপালন ও রক্ষাকর্তা হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নাযুদ্ধের সময় পুঁজিবাদী অর্থনীতির কদর্য-ক্লেদাক্ততা যুদ্ধ-বিগ্রহের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকত। তখন এই অর্থনীতির দুর্ভোগ-ক্লেদাক্ততা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের চোখে খুব একটা পড়ত না, তেমনি পড়ত না বিশ্বের সাধারণ মানুষের চোখেও। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পুঁজিবাদী অর্থনীতির কালো-কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত হতে থাকে সবার সামনে। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে পৃথিবী থেকে বুঝি যুদ্ধ-বিগ্রহের চিরতরে অবসান হলো! কিন্তু বিধি বাম। জনগণের সে প্রত্যাশা প্রত্যাশাই থেকে গেল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিপতিদের রক্ষার্থে হাজির হলেন প-িতপ্রবর স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন। তিনি তখন ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার সংঘাত’ বই প্রকাশ করে বিশ্বে হইচই ফেলে দেন। ১৯৯৬ সালে বইটি প্রকাশের সময় থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে। বইটির আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে থাকারই কথা। কারণ এই হান্টিংটনের তত্ত্বের আলোকেই সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সামরিক অভু্যুত্থানকে বৈধতা দেয়। পরদেশ লুণ্ঠনের পথ উন্মোচিত হয়। তাদেরকে রক্ষা করে বলেই পশ্চিমাবিশ্বে প্রভাবশালী তাত্ত্বিক হিসেবে তাকে মান্য করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যকে কব্জায় রাখা
মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক গোত্র, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের বসবাস। এ ছাড়া ভূরাজনৈতিক এবং তেল-গ্যাসের বিশাল ভা-ারের কারণেও এলাকাটি বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমে ব্রিটেন ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেক। তাই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ব মোড়লরা এ অঞ্চলকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। একই সঙ্গে তারা এ অঞ্চলের রাজতন্ত্রশাসিত সরকারগুলোর নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তাও প্রদান করে। আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সৌদি আরবের সীমানা নিয়ে বিরোধ; এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান অন্যান্য সংকট- এসবই মধ্যপ্রাচ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের কুৎসিত ফলাফল। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনকে খণ্ডবিখণ্ড করে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে এ অঞ্চলে যে স্থায়ী সংকটের সৃষ্টি করা হয়, তাও ঔপনিবেশিক শাসনেরই অন্যতম ফসল।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব মোড়লরা ফিলিস্তিন ও ইরাকের মতো পরিস্থিতি অন্যান্য দেশেও বাস্তবায়নের পাঁয়তারা অব্যাহত রেখেছে। এর আগে আমেরিকা ২০১১ সালে আফ্রিকার দেশ সুদানকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়। সে সময় দখলদার ইসরাইলই দক্ষিণ সুদানকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট লিবিয়া ও ইয়েমেনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা। এসবের পেছনে কাজ করছে বার্নার্ড লুইস নামের এক ইহুদিবাদীর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা। বার্নার্ড লুইস আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রায় হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বইয়ের রচয়িতা। তিনি তার লেখায় ভাষা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ভিত্তিতে বড় রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন। তার মতানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করার পরিকল্পনায় এখন ইরান হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। 

এ কথারই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় আরেক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও ন্যাটোর সাবেক সুপ্রিম অ্যালায়েড কমান্ডার ওয়েসলি ক্লার্কের কথাতেও। তিনি ২০০৭ সালের অক্টোবরে (আনবার প্রদেশে তখনো পেট্রাউসের দমন অভিযান চলমান) সানফ্রান্সিসকোতে এক বুক প্রমোশন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘৯/১১ ও ইরাক অভিযানের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।’ ৯/১১-এর কয়েকদিন পর পেন্টাগনে দুটি সভায় অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘ছয় সপ্তাহ পর আমি আবার পেন্টাগনে গেলাম। ওই একই কর্মকর্তার সঙ্গে আমার দেখা হলো; তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কেন ইরাক আক্রমণ করিনি?’ তিনি বললেন, ‘স্যার, আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’ তিনি তার ডেস্ক থেকে একটি কাগজ হাতে নিয়ে বললেন, ‘প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ মেমো এসেছে।’ এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমরা সাতটি দেশের সরকারকে ধ্বংস করতে যাচ্ছি। শুরু হবে ইরাক থেকে; এরপর সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরান।’ পাঁচ বছরে সাতটি দেশ! আমি তাকে বললাম, এটা কি গোপনীয় মেমো? তিনি বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’ শয়তানের যেমন কোনো ছলনার অভাব হয় না, তেমনি পুঁজিবাদী বিশ্ব মোড়লদেরও কোনো ছলনার অভাব হচ্ছে না। বিশ্ববাসী আজ সেটাই প্রত্যক্ষ করছে।

খাদের কিনারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি
যে আমেরিকানরা বিশ্ববাসীর মাথা থাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সব সময় অন্য দেশের সরকারকে রাখছে তটস্থ- সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলে কেমন, তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। খতিয়ে দেখা দরকার তাদের জীবন-জীবিকা ও জীবনযাত্রার ধরনও। আমেরিকানদের স্বাস্থ্য ও মৃত্যুহার নিয়ে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অ্যাঙ্গাস ডেটন দেখিয়েছেন, দেশটিতে মধ্য বয়স্কদের গড়আয়ু হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষত হাইস্কুলে পঠিত বা তার নিচে অধ্যয়নরতদের মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্য বয়স্কদের মৃত্যুহারও বাড়ছে দ্রুত। এ ছাড়া এ শ্রেণির লোকের আত্মহত্যার প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের ধনীরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ৪ কোটি মানুষ। এর মধ্যে ২ কোটি মানুষই চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে। শুধু এটাই নয়, দিনে ২ ডলারেরও কম অর্থে জীবনধারণ করা লোকজনের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মার্কিন পরিসংখ্যান বিভাগের সর্বশেষ জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যারা দরিদ্র ছিল, তাদের ৪০ শতাংশই ছিল অতিদরিদ্র। ২০১৫ সালে এ হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪৬ শতাংশ। এ কারণে আমেরিকানরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে থাকেন। এ কারণেই ১% আন্দোলনের সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যে আন্দোলনের গতি ধীর হলেও এখনও চলমান। 

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ নরিয়ের রুবিনির মতে- ইউরো জোন, ব্রিটেন, জাপান ও বেশির ভাগ উদীয়মান দেশে প্রবৃদ্ধিও বেশ মন্দা। মার্কিন ও চীনা প্রবৃদ্ধির এখনও প্রসার ঘটে চললেও মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আর্থিক প্রণোদনা দ্বারা চালিত হচ্ছে, যা কখনও টেকসই নয়। ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের প্রাচীর তুলে বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তা দ্বারা মার্কিন অর্থনীতিসহ বিশ্ব অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্র্রস্ত হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও হবে বলেই প্রতীয়মান। তাই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষার জন্য আজ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব বুনো মোষের মতো সমস্ত পৃথিবী দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এক দেশ আরেক দেশকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে উসকানি দিচ্ছে, কোথাও কোথাও নিজেরাও সে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে খেলা খেলছে, তা তাদের অর্থনীতির ভঙ্গুরতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই।

রমরমা অস্ত্রের ব্যবসা
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করা অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই বিশ্বে নিত্যনতুন সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিচ্ছেন। অস্ত্রের বড় বড় বাজার তৈরি করছেন এবং সন্ত্রাসের নির্মম বলিতে পরিণত করছেন লাখ লাখ শান্তিপ্রিয় মানুষকে। কখনও ধর্মীয় উগ্রবাদ, কখনও উগ্র জাতীয়তাবাদ, কখনও বর্ণবাদী চরমপন্থি গোষ্ঠীর জন্ম এবং লালনপালন এসব অস্ত্র ব্যবসায়ীই করে চলেছেন। বিশ্বে যুদ্ধে প্রতিদিন কী পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়, সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিশ্বব্যাংকও সতর্ক করেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, একদিনের হিসাবে জনপ্রতি ৫ ডলার ব্যয় হয় যুদ্ধ ও সংঘাতে। যুদ্ধ ও সহিংসতার ফলে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে গড়ে ১৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থের পরিমাণ বিশ্বের মোট জিডিপির ১৩ দশমিক ৩ ভাগ। যুদ্ধে অর্থের এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে অস্ত্রের বাজার ১ হাজার ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বে আর কোনো শিল্পপণ্যের এককভাবে এত বড় বাজার নেই। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকারি সামরিক খাতের ব্যয়ই বেশি। এছাড়া বেসরকারি সামরিক খাতে যে ব্যয় হয়, তার পরিমাণও প্রায় ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিপরির তথ্য অনুযায়ী, দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। গত পাঁচ বছরে দেশটির সামরিক ব্যয় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। সিপরির গবেষণায় দেখা গেছে, এসব অস্ত্রের বড় ক্রেতা এখন মধ্যপ্রাচ্য। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আগের পাঁচ বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র কেনার হার ১০৩ শতাংশ বেড়েছে। আইএস এবং অন্যান্য জঙ্গিদের মোকাবিলার নামে অস্ত্রের এ জমজমাট ব্যবসা বজায় রেখেছে পশ্চিমাবিশ্বের দেশগুলো। 
                    
অস্ত্র ব্যবসার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘ধনী আমেরিকা ও ইউরোপ অস্ত্র বিক্রি করছে শিশু এবং সাধারণ মানুষ হত্যার জন্য।’ পোপ ফ্রান্সিস আরও বলেছেন, ‘পাশ্চাত্য দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে অস্ত্র বিক্রি করছে এবং ইউরোপ ও আমেরিকা যদি অস্ত্র বিক্রি না করত- তা হলে ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে আমরা যুদ্ধ দেখতাম না। এসব যুদ্ধে নিহত প্রতিটি শিশুর মৃত্যুর জন্য, প্রতিটি পরিবার ধ্বংসের জন্য অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলোর দায় রয়েছে।’ ইতালির মিলান শহরের স্যান কার্লো ইনস্টিটিউটে সম্প্রতি এক বক্তৃতায় পোপ ফ্রান্সিস নজিরবিহীন এ মন্তব্য করেছেন। আসলে পুঁজিবাদী বিশ্ব মোড়লদের যুদ্ধ ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ পুঁজিবাদের প্রধান অসুখ হলো মন্দা, যা কিছুদিন পরপরই ফিরে আসে।

পুঁজিপতিদের দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে মন্দার আতঙ্ক 
বারবার মন্দায় আক্রান্ত হওয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটা স্বাভাবিক নিয়ম। এতে সাধারণ মানুষ চরম দুর্বিষহ-দুর্ভোগে পড়লেও পুঁজিপতিদের কোনো সমস্যা হয় না। তাদের মুনাফার কোনো হেরফের হয় না। তাদের নিজেদের সৃষ্ট এ সমস্যা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করে। নিজ দেশের শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে, পরদেশের সম্পদ লুটপাট করে, যুদ্ধ-বিগ্রহ লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে তারা মন্দা থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করে। এতকিছুর পরও এই অর্থগৃধœুরা মন্দার থাবা থেকে কোনোক্রমেই রেহাই পাচ্ছে না। মন্দার ভয়াবহতা সর্বক্ষণ তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাপী মন্দার ঘনঘটা শেষ হতে না হতেই আরেকটি মন্দা আবার তাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। 

এ মন্দা আরও বেশি ভয়ঙ্কর, আরও বেশি প্রকট- এমনটিই বলেছেন ইউরো প্যাসিফিক ক্যাপিটালের সিইও এবং অভিজ্ঞ স্টক ব্রোকার পিটার শিফ। ২০০৭ সালে অর্থনৈতিক মন্দার যে ভয়ঙ্কর চিত্র বিশ্বের সবাই দেখেছে, তার থেকেও আরও ভয়ঙ্কর কিছু সামনে হতে চলেছে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। উইটম্যান নামক আরেক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদের মতে, বাণিজ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মাঝে যেভাবে টানাপড়েন বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে অন্য যেসব কারণ যুক্ত হচ্ছে তাতে এ ধারণা করা অসমীচীন নয় যে, শিগগিরই হোক আর বিলম্বে হোক বিশ্বব্যাপী আরেকটা মন্দা দ্রুত এগিয়ে আসছে। তা ২০২০ সালের মাঝামাঝি আঘাত করবে বলে অনুমান।

ইউরোপ, আমেরিকা ও চীন তাদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিল, তা দৃশ্যত সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। ধারণা করা হয়েছিল, ২০০৭ সালে সৃষ্ট মন্দাটির যবনিকা হবে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি। কিন্তু তা হয়নি। ২০০৯ সালে এর তেজ কিছুটা স্তিমিত হলেও তা আবার ফুঁসে উঠছে। মন্দা থেকে পরিত্রাণের জন্যই পুঁজিবাদী মোড়লরা আজ দেশে দেশে যুদ্ধ লাগাতে তৎপরতা জারি রেখেছে।

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার স্বরূপ উন্মোচন করা দরকার 
এখন দেখা দরকার, পৃথিবীতে কেন এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার স্বরূপই-বা কী। ¯œায়ুযুদ্ধের পর কেন এই যুদ্ধখেলা আবার পৃথিবীতে ফিরে এলো। এখানে বিষয়টি স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার সংঘাত’ বই থেকেই খোঁজা যাক। হান্টিংটন তার বইতে সভ্যতার নানা বাঁকের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি মতবাদের সংঘাতের বিষয়টি সামনে এনেছিলেন। তিনি তার বইতে বলতে চেয়েছেন, সভ্য দুনিয়ার পরবর্তী সংঘাতটা হবে পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামের। আসলে হান্টিংটন পুঁজিবাদীদের রক্ষার্থেই পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতির সংঘাতের তত্ত্ব সামনে এনেছেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই যে মন্দার উদ্ভব হয়, যা পুঁজিপতিদের বারবার রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত করে চলেছেÑ তা থেকে তাদের রক্ষার জন্যই তিনি পরদেশের সম্পদ লুণ্ঠন, পুঁজিপতিদের শোষণ-লুণ্ঠন থেকে নিজ দেশের জনগণ এবং বিশ্বের সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আচ্ছন্নœ রাখার উদ্দেশ্যেই এ তত্ত্ব উপস্থিত করেছেন।

হান্টিংটনের এই তত্ত্ব হাজিরের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বড় তৎপরতা বাড়তে দেখা যায়। অনেক সমালোচকই মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা ইসলামী সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম দেওয়ার ছক তৈরি করে হান্টিংটনকে দিয়ে সেই ছকের সমর্থনে ‘সভ্যতার সংঘাত’ মতবাদটি প্রচার করেছেন। অনেকে তার এ গ্রন্থকে একই সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিবাদ এবং আজকের বর্ণবাদী উগ্রতা ‘রাইট উয়িং হোয়াইট মুভমেন্টে’র আঁতুড়ঘর বলে সমালোচনা করে থাকেন। পশ্চিমাবিশ্ব আল কায়েদার জন্ম দিল। আল কায়েদা ইতিহাস শেষ হতে না হতেই জন্ম দিল ইসলামিক স্টেট বা আইএসের। যুক্তরাষ্ট্রে, হল্যান্ডে, ইংল্যান্ডে বিভিন্ন সময় বর্ণবাদী হামলা চলতে দেখা গেল। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে এবং শ্রীলঙ্কার গির্জা ও রেস্টুরেন্টে সেই বর্ণবাদী উগ্রপন্থার চরমতম প্রকাশ দেখা গেল।

বিশ্বের এ প্রেক্ষাপটে অস্ত্রের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের কদর্য-ক্লেদক্ততার বিরুদ্ধে আজ শান্তিকামী মানুষের উচ্চকণ্ঠ হওয়ার সময় এসেছে। আধুনিক বিশ্বে কেন সন্ত্রাসবাদ, কেন দিকে দিকে নিরপরাধ মানুষ জীবন দিচ্ছে? রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে গিয়ে, শপিংমলে কেনাকাটা করতে গিয়ে, উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতে গিয়ে আর কত মারা যাবে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ? বিশ্বজুড়ে একটি অহিংস সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠা এখন তাই সময়ের দাবি। বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের সামনে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে, কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের কণ্ঠ উচ্চকিত হোক এই স্লোগানে-  “অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব চাই, শান্তিতে বাঁচতে চাই। দুবেলা দুমুঠো খেতে চাই, পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকতে চাই।”

লেখক : সাংবাদিক