• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৩০, ২০১৯, ০৯:২২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৩১, ২০১৯, ০৪:০৩ পিএম

ভাটায় দেশের কৃষক-শ্রমিক : জোয়ারে কোটিপতিরা

ভাটায় দেশের কৃষক-শ্রমিক : জোয়ারে কোটিপতিরা

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক অপরূপ অনিন্দ্য সুন্দর বাংলাদেশ। বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে নাইকো শেষ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও বুড়িগঙ্গা বিধৌত বাংলার রূপ ও সৌন্দর্যে সবই মনোমুগ্ধকর। সবুজের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের অপরিণামদর্শী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে আজ আমাদের দেশ তথা বাংলাদেশের মেরুদণ্ড কৃষি নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জীবন-জীবিকার জন্য এ দেশের জনগণ ও অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখনো শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং মোট জিডিপির ২২ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নতুন এবং আরও আতঙ্কজনক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা।

বর্তমানে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৭ হাজার নতুন মুখ, বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ লোক। অপরদিকে রাস্তাঘাট, মিল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৪৮ বছরে এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিনগুণ বেশি, ভুট্টাসহ এর পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন।
 
আজও দূর হলো না কৃষকের বোবা কান্না

চীনদেশে কৃষি ও উন্নয়ন নিয়ে একটি প্রবাদ চালু আছে। প্রবাদটি হলো-- ‘জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি হলো গাছের মতো। কৃষি তার মূল, শিল্প তার শাখা এবং বাণিজ্য তার পাতা।’ অর্থাৎ কৃষিকে ভিত্তি করেই দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার নির্ভরতা। কৃষির অগ্রগতি ছাড়া কোনো অগ্রগতিই সম্ভব নয়। কৃষিই সভ্যতার মূল। 

সেই কৃষিই এখন বাংলাদেশের কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধান কাটা এবং ধানের দাম নিয়ে সারাদেশে চলছে তুলকালাম কাণ্ড। কৃষক ধানের দাম কম ও কৃষিশ্রমিকের বেশি মজুরির প্রতিবাদে ক্ষোভে-দুঃখে নিজের পাকা ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে এক অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এতে দেশের বিভিন্ন কৃষক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। দাবি উঠেছে, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান কেনার। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের। সারাদেশের হাট-বাজারে প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে ৬শ টাকায়। আর ধান কাটার শ্রমিকের দৈনিক মজুরি দিতে হচ্ছে ৭শ থেকে ৮শ টাকা। অর্থাৎ দেড় মণ ধান বিক্রি করে একজন কৃষিশ্রমিকের একদিনের মজুরি পরিশোধ করতে হচ্ছে। তারপরও দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের তিন বেলার খাবার। একদিকে বাজারে ধানের দাম কম, অন্যদিকে শ্রমিকের অধিক মজুরির কারণে কৃষক পড়েছেন মহাবিপদে। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অমানুষিক পরিশ্রম করে লাভের আশায় ধানের চাষ করেন। সেই ধান বিক্রি করে যদি তার প্রতিমণে দেড় থেকে ২শ টাকা লোকসান গুনতে হয়, তা হলে কী জন্য সে ধানের চাষ করবে?

ধান-চাল কেনার সরকারের যে নীতি, সেটা কৃষকবান্ধব নয়। এ নীতিতে লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ী, মিল মালিক, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। সিংহভাগ কৃষকের জমি থেকে ফসল উঠিয়ে চাল তৈরি করার সক্ষমতা নেই। এর ফলে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চাল মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করছে। সরকারের হিসাবে এবার প্রতি কেজি বোরোর চাল উৎপাদনে ৩৪ টাকা খরচ হচ্ছে। এ কারণে সরকার প্রতিকেজি ৩৬ টাকা দরে চাল কিনবে, যা গত বছর ৩৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও কৃষকের কাছ থেকে ধান নয়, মিলারদের কাছ থেকেই সিংহভাগ চাল সংগ্রহ করবে।

কৃষকের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ফড়িয়ারা সরকার নির্ধারিত দরের চেয়েও অনেক কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করেন। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, তারা কৃষকের কাছ থেকে ভেজা ধান সংগ্রহ করেন। সে দান শুকালে ওজন কমে যাবে। প্রতিবছরের এবারেও মতো কৃষকের ধান-চাল বিক্রি করে পোয়াবারো হবে মিলমালিকদের। হিসাব বলছে, এখনকার বাজারদরে ধান কিনে সেটা চালে রূপান্তর করলে এর দাম দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ২৭ টাকা। অর্থাৎ সেই চাল সরকারি গুদামে দিতে পারলে প্রতি কেজিতে মুনাফা হবে প্রায় ৯ টাকা। অন্য খরচ বাদে এবার ১০ লাখ টন চাল সরবরাহ করে মিলাররা হাতিয়ে নেবেন কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে ধান কেনায় লাভের অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে উৎপাদিত ফসলের ১৫ শতাংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত চালের মাত্র ৪ শতাংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়। সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতার অভাবের কারণেও সরকারিভাবে বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে দেশে ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হতো। তখন সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ছিল ১৫ থেকে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে চাল উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। আর সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা মাত্র ২১ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা ৫০ লাখ টনে উন্নীত করে চালের পরিবর্তে উৎপাদিত ধানের শতকরা ১৫ ভাগ সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে সরকারিভাবে ক্রয় করা উচিত। এতে কৃষক উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং সেই সঙ্গে টেকসই হবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

হা-হুতাশে ভরপুর শ্রমিকের জীবন

এ দেশে শুধু কৃষকরাই বোবা কান্না করেন না, নীরবে-নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দেন উৎপাদনের মূল উপাদান হাজার হাজার, লাখ লাখ শ্রমিকও। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য এবং শ্রমিকের শ্রমশোষণ থেকে মুক্তির জন্যই এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এসব মেহনতি মানুষের স্বপ্ন ছিল-- দেশ স্বাধীন হলে আর শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না; তাদের অন্ন-বস্ত্র বাসস্থান, সন্তানের শিক্ষা-চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে এ দেশের কৃষক-শ্রমিক যে অবস্থায় ছিল, আজও তারা প্রায় সেই অবস্থাতেই রয়ে গেছেন। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক শেষ হতে চললেও তাদের সমস্যার কোনো শেষ নেই। গার্মেন্ট, কৃষি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শ্রমিকরা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে এবং ন্যায্যমজুরির বঞ্চনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, শিল্প-বিরোধ, স্বাস্থ্য সমস্যা, বকেয়া মজুরি, বিনা নোটিসে শ্রমিক ছাঁটাই, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানিসহ ঘাটে ঘাটে নানা সমস্যা তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। 

একটি গণতান্ত্রিক শ্রমআইনের দাবি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর শ্রমিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শ-প্রস্তাব উপেক্ষা করে, এমনকি সংসদ সদস্যদের অবহিত না করে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শ্রমআইন সংসদে পাস করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। সংসদে আলাপ-আলোচনার কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে মাত্র ২ মিনিটে আইনটি পাস করা হয়। ২ মিনিটে আইন পাসের মধ্য দিয়েই শ্রমিকদের প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ববোধের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রমিকদের প্রতি শাসকদের অবজ্ঞা-অবহেলার জন্যই ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্রমআইনের সংশোধন করতে হয়। আইএলওর চাপে সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্রমআইনের সংশোধন করা হলেও এখনও আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অনেকের অভিমত। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী বহু ধারা বারবার আইন সংশোধনের পরও রয়েই গেছে। শ্রমআইন সংশোধনের নামে যা করা হয়েছে, তা শ্রমিকের অধিকার সংকোচনেরই নামান্তর।

পাস হওয়া আইনে দৈনিক কর্মঘণ্টাকে ৮ থেকে বাড়িয়ে ১০ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে খাওয়া ও প্রার্থনার বিরতিসহ কর্মঘণ্টা হিসাব করা হলেও নতুন আইনে খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য বিরতি ব্যতীত সময়কে কর্মঘণ্টা ধরা হয়েছে। অথচ দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টার দাবি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দাবি, একটি স্বীকৃত মানবাধিকার। আইনের এ ধারার মাধ্যমে মালিকপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের অতিরিক্ত খাটানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কাঠামো এখনও শুভঙ্করের ফাঁকির মতোই রয়ে গেছে।

শ্রমিক-কৃষকের প্রতি এ দেশের শাসকদের চোখের অশ্রু যে কতটুকু ভণিতা ও ছলনাপূর্ণ, তা গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বশেষ বেতন-ভাতা নির্ধারণ থেকেই বোঝা যায়। ২০১৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বাড়ার কথা। ৫ শতাংশ হারে বেতন বাড়লে যে শ্রমিকের এখন পাওয়ার কথা ৫২০০ টাকা, তিনি পাচ্ছেন ৫১৬০ টাকা। অর্থাৎ সে শ্রমিকের মজুরি তো বাড়েইনি, বরং আরও কমেছে ৪০ টাকা! নতুন বেতনকাঠামো অনুযায়ী যে শ্রমিকের পাওয়া উচিত ৮৯৩২ টাকা, তিনি নতুন স্কেলে বেতন পাচ্ছেন ৮৫২০ টাকা। সে শ্রমিকের বেতন আগের চেয়ে ৪১২ টাকাই কম! তা ছাড়া ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডের অনেক শ্রমিকের বর্তমান বেতন আর বর্ধিত বেতন প্রায় একই। শুভঙ্করের ফাঁকি আর কাকে বলে! শ্রমিকদের নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর এ তামাশার আসলে শেষ কোথায়? পাঁচ বছর পর নতুন মজুরি কাঠামোয় প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকরা ফুঁসে হয়ে উঠেছিলেন। এক সপ্তাহের আন্দোলনের মুখে নতুন মজুরি কাঠামোর ছয়টি গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে মাত্র ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা!

শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে সাঁতরিয়েই মধ্যআয়ের দেশে পৌঁছাচ্ছে বাংলাদেশ। তাদের শ্রমের ওপর ভর করেই বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। তাই টেকসই উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে হলে সব খাতের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নতির কথা ভাবতে হবে। শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশ, ন্যায্য শ্রমমূল্য, জীবনমান উন্নয়নসহ সবদিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এসব শুধু কথায় বা কাগজেকলমে নয়, কাজে বাস্তবায়ন করতে হবে। 

জোয়ারে ভাসছে কোটিপতিরা

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না; তবে সেই এগিয়ে যাওয়া সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন নির্বাহ করতে এখনো নাভিশ্বাস উঠছে। আর হাতেগোনা মুষ্টিমেয় মানুষ দিনের পর দিন ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স এ তথ্যেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাদের তথ্যটি হলো, ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে চীন এখন আর বিশ্বের এক নম্বর দেশ নয়, এ অবস্থান এখন বাংলাদেশের। চীনকে হারিয়ে গত পাঁচ বছরে এ অবস্থানটি দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এখন ১৭ দশমিক ৩ ভাগ হারে অতিধনীর সংখ্যা বাড়ছে। আর এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। চীনে বাড়ছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধনকুবের বাড়ার হার পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের এ শীর্ষ অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। কিন্তু ধনকুবের বাড়ার নেপথ্যে আসলে কী? কোন জাদুমন্ত্রে চীনকে টপকে বাংলাদেশ এ শীর্ষস্থান দখল করল? আসলে রাষ্ট্রীয় বা প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট, ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়া এবং সরকারি ক্রয়-বিক্রয় খাতে ব্যাপক কারচুপিই এ শীর্ষস্থান অর্জনের মূল। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হরিলুটের চিত্র শাসকদের চোখে পড়ে না বলেই সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে স্পিড মানি দেওয়া কোনো অবৈধ বিষয় নয়।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকেও দেশে কোটিপতিদের জোয়ারের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। “দেশে গত এক দশকে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় চারগুণ। এ সময়ে দেশে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৬৪০ জন কোটিপতি হয়েছেন।” বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে কোটিপতি আমানতকারী হলেন ৭৫ হাজার ৫৬৩ জন। ২০০৮ সালে যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন। পাঁচ বছর পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৪৭৭ জনে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতি আমানতকারীর আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি আমানতকারীদের অর্থের পরিমাণ বেড়ে হয় ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। (আমাদের সময়, মে ২৫, ২০১৯)। দেশে কোটিপতির অ্যাকাউন্ট বাড়ার অর্থ দেশের সম্পদ ক্রমেই কিছুসংখ্যক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। এতে ধনী-গরিব বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোক উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। প্রকট বৈষম্যের কারণেই একদিকে কিছু লোক সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অন্যদিকে নিঃস্ব হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। দেশে বিচার ও জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিজ্ঞদের অভিমত।

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা

আমাদের উন্নয়ন সাফল্যে দারিদ্র্যের হার কমার কথা বলা হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েই চলছে। রাজনৈতিক আনুকূল্যে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সমাজের কিছু লোক রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ায় সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, সত্যিকারের উদ্যোগী লোকেরা হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক উচ্চাশা আর আকাঙ্ক্ষা ছিল সবার মনে। তবে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটির কারণে সামাজিক অসমতা ও বৈষম্য যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে পাকিস্তান আমলের অর্থনীতিরই যেন পুনরুজ্জীবন ঘটছে। সমাজের বিরাট এক অংশ এখনো ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমাতে যায়। মানসম্মত শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবেশসম্মত আবাসন সুবিধা এখনো সাধারণের আয়ত্তের বাইরে। সমাজের ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনে অসচ্ছলতা ও অস্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ চোখেমুখে এখনো বহমান। জাতীয় আয় বাড়ার প্রধান সুবিধাভোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমিত কিছু মানুষ, আর বিরাট অংশের সম্ভাবনা এখনো রয়েছে অবহেলিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ওয়েলফেয়ার মনিটরিং সার্ভে অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশের হাতেই সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ কুক্ষিগত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বাইরে ৭৫ শতাংশ মানুষই উন্নয়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কোনো রকমে দিন পার করছে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা দেশে ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার। দারিদ্র্যের চরম কশাঘাতে জর্জরিতের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ খাদ্যচাহিদা মেটাতে ক্রমেই ঋণভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কেবল মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যুতসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুণগত পরিবর্তন।

ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তার ইচ্ছে ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার। তিনি ভালোভাবেই জানতেন, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়; সম্ভব নয় তার স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো সে প্রত্যাশাতেই বুক বেঁধে আছে।

লেখক : সাংবাদিক