• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৯, ২০১৯, ০৪:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৯, ২০১৯, ০৪:২৯ পিএম

পরিবেশগত সংকটে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

পরিবেশগত সংকটে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবালরাজ্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দ্বীপটির অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে। আয়তন খুব বেশি নয়, মাত্র সাড়ে আট বর্গকিলোমিটার। জোয়ারের সময় আয়তন খানকিটা হ্রাস পেয়ে পাঁচ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। দ্বীপটির নামকরণ হয় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র শাসনামলে। জনৈক ইংরেজ মি. মার্টিনের নামানুসারে দ্বীপের নামকরণ হয় ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’।

এটি টেকনাফ উপজেলাধীন ইউনিয়ন। টেকনাফ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। দ্বীপের অধিবাসীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়; বড়জোর হাজার দশেক। শিক্ষিতের হার শূন্যের কৌটায়। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই মত্স্যজীবী। এরা নিরীহ, দরিদ্র এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোনো ধরনের রাহাজানি কিংবা হানাহানির সঙ্গে জড়িত নয়। ফলে অদ্যাবধি এখানে খুন-খারাপির মতো বড় ধরনের কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়নি। ফলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বলা যায় চিরশান্তির স্থান। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রকৃতির অজস্র সম্পদ। যার সঠিক ব্যবহার হলে জাতীয় জীবনে আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হতাম।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, বিশ্বের দুর্লভতম প্রবালরাজ্যের একটি হচ্ছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এখানে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১২০ প্রজাতির পাখি (দেশি ও পরিযায়ী মিলিয়ে), পাঁচ প্রজাতির উভচর প্রাণী, পাঁচ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল। রয়েছে পাথুরে শিলা ও হরেক রকম শৈবালের রাজ্য। এছাড়াও অসংখ্য নারিকেলগাছ এবং কেয়াবনসহ নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। যার কারণেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বলা হয়েছে বিশ্বের দুর্লভতম স্থানের একটি। বিশেষ করে এত স্বল্প আয়তনের আর কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য ও বহুল প্রজাতির উদ্ভিদ বা জীব প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় না।

এতসব লোভনীয় কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইদানীং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। জানা যায়, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে প্রায় দেড় লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের পর্যটন খাতের জন্য বিশেষ ইতিবাচক দিক। এতে আমাদের কারো দ্বিমত নেই বোধকরি। দ্বিমতটা হচ্ছে, পর্যটকদেরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে নানান ধরনের কর্মকান্ডের ফলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটে পড়েছে। বিষয়টি যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে আমরা দ্বীপ পর্যবেক্ষণে গেলে এর সত্যতার প্রমাণ মেলে।

দ্বীপ ভ্রমণে গেলে যে জিনিসটি সর্বাগ্রে নজর কাড়ে তা হচ্ছে, বিলাসবহুল হোটেল-মোটেলসহ বেশ কিছু পাকা-সেমিপাকা দরদালান। যা ছিল না বিগত এক যুগ আগেও। এ ছাড়াও পর্যটকদের সুবিধার্থে রাতের আঁধারকে দূর করতে জেনারেটর ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে হোটেল ব্যবসায়ীদেরকে। যার ফলে রাতে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া অনেক প্রজাতির প্রাণী বা মাছ ভয়ে সটকে পড়ছে। বিশেষ করে, বিশ্বের দুর্লভ প্রজাতির ‘অলিভ রিডলে টার্টল’(জলপাইরঙা কাছিম) ভয়ে ডিম পাড়া থেকে বিরত থাকছে এবং অন্যত্র চলেও যাচ্ছে। অন্যত্র গিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেনি ওরা। কারণ পরপর কয়েক রাত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ওরা ওঠার চেষ্টা করে প্রথমে। কিন্তু ভয়ে দ্বীপে উঠতে না পেরে পরিশেষে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে গিয়েও রেহাই পায় না। পেটের ভেতর ডিম রেখেই অবশেষে মারা যায়।

দ্বীপের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বহুতল ভবন। এখানকার বহুতল ভবন গড়ার হিড়িক অবলোকন করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, এসব ভবনের ওজন বহন করার সামর্থ্য ছোট্ট এ দ্বীপটির নেই। যার ফলে এটি যে-কোনো সময়ে সমুদ্রে নিমজ্জিত হতে পারে। জানা গেছে, এটি একটি ভাসমান দ্বীপ। সুদূর মালয়েশিয়ার একটি দ্বীপের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। যতদূর জানা যায়, চামচাকৃতির একটি প্রবালপ্রাচীরের সঙ্গে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সংযোগ। সমুদ্রের গভীর তলদেশ দিয়ে প্রকৃতিকগতভাবে এ সংযোগ স্থাপন হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ সংযোগ-বাটটি প্রবালের জীবাশ্ম দিয়েই তৈরি। কাজেই অধিক ওজন বহনের ক্ষমতা নেই এটির। আর সে ধরনের কিছু ঘটে গেলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই বিষয়টি মাথায় এনে এখানে বহুতল ভবন তৈরির বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে অবৈধ পাথর উত্তোলনেরও। দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই মাটি খুঁড়ে বড় বড় পাথর উত্তোলন করে বহুতল ভবনের কারুকার্যে ব্যবহার করছে। যার ফলে দ্বীপটি তার পরিবেশগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে দ্রুততর। শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, পর্যটকরাও ছোট ছোট নুড়ি, শিলাপাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে লুকিয়ে-চুকিয়ে নিয়ে আসছে। যা তদারক করার লোক থাকলেও হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে পার পেয়ে যায়।

এ ছাড়াও পর্যটক দ্বারা পরিবেশের বহুবিধ ক্ষতি সাধন হচ্ছে। যেমন পলিথিন, কোমলপানীয় ও প্লাস্টিকের পানির বোতলসহ নানা ধরনের জিনিস ফেলে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করছে। অবস্থান নেওয়া পর্যটকরা রাতে বারবিকিউর আয়োজন করে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া প্রাণিকুলকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। এতে করে দ্বীপ প্রাণিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা আশা করব, কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবেন। পর্যটকদের আগমনকে নিরুত্সাহিত না করে বরং সুন্দর সহনীয় নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন। আমাদের এ সামান্য প্রত্যাশা পূরণ করা হলে ক্ষুদ্র দ্বীপটি টিকে থাকবে শত-হাজার বছর।

 লেখক : পরিবেশবিদ ও বন্যপ্রানী বিশারদ