• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১০, ২০১৯, ০৩:০৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১০, ২০১৯, ০৩:০৪ পিএম

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনার নেপথ্যে তেলবাণিজ্য 

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনার নেপথ্যে তেলবাণিজ্য 

ইংরেজিতে প্রকাশিত সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত দ্য আরব নিউজের প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় কলামে সম্প্রতি বলা হয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সঠিক বার্তাটি  এখনও কোথাও পৌঁছায়নি। সে বার্তায় লেখা ছিল- এখন দরকার শক্ত হাতের আঘাত।  এই শক্ত হাতের আঘাতের মধ্য দিয়ে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেটা যে ইরানকে লক্ষ করেই বলা হয়েছে তা স্পষ্ট। শক্ত হাতে ইরানের ওপর আঘাত হানার জন্যই আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শক্ত হাতের আঘাত বলতে সামরিক অভিযানকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে, আয়াতুল্লাহ খামেনি যতই বলেন না কেন, ইরান যুদ্ধের অনুসন্ধান করছে না, তা সত্তে¡ও তাঁর সেনা কমান্ডার যুদ্ধের প্রস্তুতির কথাই বলছেন।

ইরানের কমান্ডার অব দ্য রেভ্যুলেশনারি গার্ডস ও দেশের সকল মিলিটারি বাহিনীর নেতা মেজর জেনারেল হোসেইন সালামী বলেছেন, ইরান-আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে, শত্রু এখন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে গেছে। তাই তার বিরুদ্ধে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ ইরানও আমেরিকাকে সামরিকভাবেই জবাব দিতে প্রস্তুত। এ সময়কালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নানা অসত্য বাহানা তুলে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করেন এবং অতিস¤প্রতি ইরানের তেলবাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এর জবাবে ইরানও জানিয়ে দিয়েছে, ইরানের তেল পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করলে ইরান হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেবে। এ নিয়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা চলছে, নতুন করে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। 

 অন্যদিকে হরমুজ প্রণালি পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌযোগাযোগের জন্য অপরিহার্য একটি রুট। হরমুজ প্রণালি ভারত মহাসাগরের সাথে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সংযোগকারী সেতুবন্ধ। হরমুজের উত্তরে ইরান এবং দক্ষিণে ইউএই ও ওমান। বিশ্বব্যাপী তেল পরিবহনে এককভাবে হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ ক্রুডওয়েল যাতায়াত করে তার ৪০% শতাংশই হরমুজ প্রণালি দিয়ে চলাচল করে। অন্যদিকে, কুয়েত, কাতার, ইরান ও বাহরাইনের সকল তেলবাণিজ্য, সৌদি আরব ও ইরাকের তেলবাণিজ্যের ৯০% শতাংশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৭৫% শতাংশ তেলবাণিজ্য হরমুজ প্রণালি দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

অতএব অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে ইরান যাতে কোনো প্রকার বাধার সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য হরমুজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং সে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা বিধানের জন্য এ অঞ্চলে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার ও বি-৫২ বোমারু বিমানসহ অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা মিসাইল মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে মোতায়েনের আদেশ জারি করেন এবং সেটি তামিলও হয়ে গেছে সাথে সাথে। অদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ১২০ হাজার সেনা মোতায়েনের ইচ্ছাও রয়েছে ট্রাম্পের। সামরিকসম্ভার গড়ে তোলা কিসের লক্ষণ বহন করছে এটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

এদিকে সৌদি রাষ্ট্রীয় প্রেস এজেন্সির বরাতে প্রচারিত এক বার্তায় সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিরাপত্তা ও মেরিটাইম বা নৌপথে চলাচলের এক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। আরও বলা হয় আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও এটা গুরুতর হুমকি। এ অবস্থায় সৌদি এনার্জি মিনিস্টার খালিদ আল ফালিহ বলেছেন, এ ঘটনা নেভিগেশনের স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক এবং তেল আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। ফলে সারাবিশ্বে তেলবাণিজ্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে।

যদিও ইরান এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলে দাবি করে আসছে, তা সত্ত্বেও আমেরিকা, সৌদি আরব বা তার বন্ধুরাষ্ট্রগুলো ইরানের দাবিকে তেমনভাবে আমল দিচ্ছে না। ফলে আরেক দফা সামরিক উত্তেজনা তীব্রতর হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, সৌদি আরব এবং আমেরিকার মধ্যে তীব্র সামরিক ও যুদ্ধ উত্তেজনা বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন আমেরিকা-ইরানের সাথে যুদ্ধ চায় না। প্রেসিডেন্টের উক্ত ঘোষণায় বিশ্ববাসীর মধ্যে শান্তির প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে না এমন আশাবাদ ব্যক্ত করছেন শান্তিবাদী মানুষেরা। কারণ যুদ্ধ মানেই অশান্তি রক্তপাত আর মানবসন্তানের নির্মম হত্যা, দুর্ভোগ আর উদ্বাস্তু জীবনের অভিশাপ বহন করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা। তাই যুদ্ধে না জড়ানোর ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ খুশি হবে। 

তবে ইরানের সাথে যুদ্ধে না জড়ানোর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা বিদ্যমান বাস্তবতার সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়ে কথা উঠেছে অভিজ্ঞ মহলে। সা¤প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনার উল্লেখ করে রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত পোষণ করেছেন।

যদিও আমেরিকা-ইরানের সাথে যুদ্ধকৌশল নিয়েই এগিয়ে চলেছে এবং পরিপূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন করেই কোনো এক সুবিধাজনক সময়ে যে কোনো অজুহাতে ইরানের ওপর সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে। ২০১৫ সালে ইরান বনাম বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তিকে ঐতিহাসিক এবং অসাধারণ ভালো একটা চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছিলো জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহ। এ চুক্তির ফলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও মজুতকরণ হতে সরে আসবে- এমনটাই বিশ্বাস ছিল শান্তিবাদী মানুষদের মধ্যে। এ চুক্তি স্বাক্ষরকালে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। এ চুক্তি সম্পাদনের মধ্যে আমেরিকার বড় ধরনের বিজয় দেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা।

ইত্যবসরে ২০১৬ সালে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান প্রশ্নে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার একদম বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ইরান ২০১৫ সালের চুক্তি মেনে চলছে না বলে অভিযোগ করে আমেরিকাকে ওই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন একতরফাভাবে। যদিও চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলো ট্রাম্পের সাথে একমত হতে পারেননি। ইরান চুক্তি মেনে চলছে এমনটাই দাবি করছে রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাতিসংঘ। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, ইরান সম্পর্কে ট্রাম্পের অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট, অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব উদ্যোগের লক্ষ হলো ইরান। এ দেশটিকে মেকাবিলা করার লক্ষে তিনি ইরাকের আমেরিকান দূতাবাসে থাকা অপ্রয়োজনীয় কূটনীতিকদের নিজ দেশে তলব করেছেন। এটা যুদ্ধপ্রস্তুতির একটা অংশ হিসাবে দেখছেন অনেকেই। 

অন্যদিকে, যুদ্ধ উত্তেজনার কারণে ডাচ ও জার্মানি ইরাকে তাদের সৈনিকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাতিল করে দিয়েছে। যুদ্ধভীতিই এর কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকা এতসব প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি ইরানকে উত্তেজিত করে যুদ্ধে জড়ানোর জন্যও নানা কৌশল গ্রহণ করে চলেছে। এসব কৌশলের অংশ হিসেবে আমেরিকা ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ‘ইসলামিক রেভ্যুরেশনারি গার্ড কর্পস বা আই.আর.জি.সি’ কে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। একটি বহিঃরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা, এই প্রথম। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশন তালিকায় অপর ৬৭ সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে আইআরজিসিও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো- যা ইরানের জন্য অবমাননাকর। ইরানের প্রতি আমেরিকার গৃহীত নানা পদক্ষেপই বিদ্বেষপূর্ণ এবং আক্রমণাত্মক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ ধরনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি বলেন, ইরানের সাথে আমেরিকা যুদ্ধ চায় না। এর জবাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনীও বলেছেন, আমরা যুদ্ধের অনুসন্ধান করছি না। দু’পক্ষই যখন যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন তথাপি উত্তেজনা কমে আসেনি উপসাগরীয় অঞ্চলে এবং দেশ দু’টির মধ্যে। একপক্ষ অন্যপক্ষকে হুমকি দিয়ে চলেছে। এ পাল্টাপাল্টি হুমকি সামরিক সংঘাতকে ত্বরান্বিত করছে। ইরান-আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে আমেরিকান বন্ধুরাষ্ট্র সৌদি আরব, ইসরাইল আমেরিকার সমর্থনে এগিয়ে আসবে, তা প্রায় নিশ্চিত। 

অপরদিকে ইয়েমেনের হুতিগোষ্ঠী, ইরাকের শিয়া জঙ্গি, সিরিয়া প্রভৃতি ইরানের বন্ধুরাষ্ট্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইরানের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি বন্ধুরাষ্ট্রও ইরানের পক্ষে সমর্থন যুগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মোট কথা,  সত্যি সত্যি যুদ্ধ যদি শুরু হয় তবে তা পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে, এমনকি বিশ্বব্যবস্থাকে অস্থির, অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং এতে পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার হতে পারে। কারণ ট্রাম্প বারকয়েক বলেছেন, ইরানের অস্তিত্ব মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য বিপজ্জনক হুমকি। উত্তেজনাকর এ অবস্থায় গত সপ্তাহে ঘটে গেছে বিপর্যয়কর আরও একটি ঘটনা।

  তেলবাহী চারটা জাহাজ যার দু’টি সৌদিয়ান, একটা নওয়েজিয়ান এবং একটা আমিরাতি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফুজাইরাতে অবস্থান করছিল সেগুলোর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সৌদি আরবের তেলবাহী জাহাজের একটা তেল নিয়ে আমেরিকায় যাচ্ছিল। এই আক্রমণ কে বা কারা করেছিল তা প্রথম জানা না গেলেও পরবর্তীতে সৌদি আরব দাবি করেছে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ড্রোন আক্রমণেই জাহাজগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে এবং এ ড্রোনগুলো সরবরাহ করেছে ইরান। সুতরাং এই আক্রমণের জন্য ইরান দায়ী। কাজেই বাস্তবতা হলো, ইরান-আমেরিকা এখন যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে এব যে কোনো সময় দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞজনেরা। 

লেখক :  কলামিস্ট