• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০১৯, ০২:২১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১২, ২০১৯, ০২:২৮ পিএম

বাংলাদেশ ‘মিরাকেল’ আটকে যাচ্ছে কি?

বাংলাদেশ ‘মিরাকেল’ আটকে যাচ্ছে কি?

  নব্বইয়ের দশকের পর প্রত্যেক দশ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ করে বেড়েছে। ২০০০ সালে প্রবৃদ্ধিতে আমরা ৫ শতাংশে পৌঁছে গেলাম। ২০১০ সালে ৬ শতাংশ এবং এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অতিক্রম করেছি। বাংলাদেশের এই অগ্রগতিকে বিদেশিরা ‘মিরাকেল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু যদি বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র না থাকে, আর সরকারি দলের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে ইপ্সিত পরিবর্তন আসবে না। তখন ‘মিরাকেলের’ চাকা থেমেও যেতে পারে।

বাংলাদেশের জন্ম ও প্রতিবিপ্লব

এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। সেটা ছিল এক ‘মিরাকেল’! সম্পূর্ণ দেশ তখন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কলকারখানা ছিল বন্ধ, সব মিলিয়ে একটা ধ্বংসস্তূপ ছিল। যেখানে প্রধান সমস্যা হলো পুনর্বাসন। আমরা গ্রহণ করেছিলাম রাষ্ট্রীয় খাতের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন পরিকল্পিত উন্নয়নের নীতি। পরিকল্পনা কমিশনের ওপরে উন্নয়নের নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তদানীন্তন পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের পরিকল্পনা অনিবার্য ছিল কিন্তু আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় রাজনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের প্রতিকূলে চলে যায়। প্রধান প্রশ্ন দাঁড়াল, খাদ্য কোথা থেকে আসবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন দাঁড়াল, পুঁজি কোথা থেকে আসবে? তৃতীয় প্রশ্ন হলো, মধ্যবিত্তের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কীভাবে তৈরি হবে? সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। সে জন্য প্রয়োজন হলো আমদানির।

কিন্তু হাতে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। প্রয়োজন দেখা দিল বিদেশি সাহায্যের। পশ্চিমা বিদেশিদাতারা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। কিন্তু চাপ দিলেন সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি থেকে সরে আসতে হবে। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ বিদেশি সাহায্য যথাসম্ভব কম নিয়ে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাবের মূল কথা ছিল কৃচ্ছ্রসাধন। আমার শিক্ষক আনিসুর রহমানের ‘যে আগুন জ্বলেছিল’ গ্রন্থে এসব স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুলিঙ্গের কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে।

নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে রেশনিং, ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, লাইসেন্স এবং পারমিটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল একটি দুর্নীতিবাজ মধ্যস্বত্বভোগী ধনিক শ্রেণি। এরাই আবার খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কোণঠাসা দক্ষিণপন্থিদের নিয়ে চাইল দেশকে সমাজতন্ত্র থেকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সরিয়ে নিতে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা চাইল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে আসতে।

সে সময় খাদ্য সাহায্য প্রত্যাহার করে নিল যুক্তরাষ্ট্র। খোঁড়া অজুহাতে পিএল-৪৮০-এর মাধ্যমে যে খাদ্য সহায়তা আসার কথা ছিল সেটা সমুদ্রের মাঝপথ থেকে প্রত্যাহার করে আমেরিকা। অজুহাত ছিল, বাংলাদেশ সরকার কিউবায় চটের বস্তা রপ্তানি করে। কিউবা সে চটের বস্তা পাঠিয়ে দেয় ভিয়েতনামে। ভিয়েতনামের গেরিলারা সেই চটের বস্তা ব্যবহার করে অস্ত্র বহন করে, ওই অস্ত্র দিয়ে ভিয়েতনামি গেরিলারা মার্কিন সৈন্যদের মারে। সুতরাং বাংলাদেশ মার্কিন নিরাপত্তার বিরুদ্ধে কাজ করছে! খাদ্য সাহায্য না আসায় বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে দুর্ভিক্ষ হলো।

অবশ্য অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে বহিঃস্থ কারণ ছাড়াও ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে অন্তঃস্থ নেতিবাচক কারণও ছিল, যেমন- বন্যা, কৃষিতে কর্মহীনতা, গ্রামীণ মজুরদের ক্রয়ক্ষমতার অভাব ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু এরপর থেকে কিছুটা জনপ্রিয়তা হারালেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে বাকশাল করে তিনি অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ উগ্র বিপ্লবী হঠকারী স্লোগান দিয়ে ভারত এবং সোভিয়েতবিরোধী সব দক্ষিণ ও উগ্র বামপন্থি শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে শেখ মুজিবকে উৎখাতের ডাক দিল। এক ফাঁকে সামরিক বাহিনীর বিপথগামীদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন। ক্ষমতায় এল আওয়ামী লীগেরই দক্ষিণপন্থি নেতা তথাকথিত খন্দকার মোশতাক ‘চাচা’। বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হলো দক্ষিণপন্থি লাইনে।

স্বৈরতন্ত্র ও স্থবিরতার দশক

পরবর্তী ১৯৯০ পর্যন্ত ইতিহাস হচ্ছে ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার ইতিহাস। আশির দশকজুড়ে উন্নয়ন ক্রমাগত আরো পরনির্ভরশীল ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির মধ্যে আটকে থাকল। এরশাদ আমলকে তাই ‘Decade of Stagnation’বলা হয়। উৎপাদনশীল খাতকে তিনি অবহেলা করেছিলেন। তবে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রচুর বিদেশি সহায়তা তিনি পেয়েছেন। বিদেশি সাহায্য দিয়ে দুটি তথাকথিত উন্নয়ন ব্যাংক করা হয়, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা। এই ব্যাংকগুলো পুঁজিপতিদের Spoon Feeding করছিল। কিন্তু এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নিয়ে উৎপাদনশীল পুঁজিপতি তৈরি হয় না। যেটা তৈরি হয়েছিল সেটা হলো খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি। এরা টাকা নিয়েছিল কিন্তু শোধ করেনি। শিল্পও করেনি। ফলে ক্রমাগত বিদেশি নির্ভরতা বাড়তে থাকে।

এরশাদের সময় কোনো এক বছর উন্নয়ন বাজেটের ১০০ ভাগ বা পুরোটাই বিদেশি সাহায্য নির্ভর হয়ে পড়ে, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বেতনও বিদেশি সাহায্য থেকে দিতে হয়েছিল। সুতরাং এরশাদের আমলে আমরা পরনির্ভরশীল হলাম, গণতন্ত্রহীন হলাম এবং প্রবৃদ্ধিও ৪ শতাংশের বেশি হলো না। পাশাপাশি একটি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক আমলাচক্র গড়ে উঠল।

গণতন্ত্রের চড়াই-উৎরাই

নব্বইয়ে গণঅভ্যুত্থানের পর ধারণা করা হয়েছিল একটা গণতান্ত্রিক সরকার আসবে এবং গণমুখী উন্নয়ন শুরু হবে। নব্বইয়ের দশকের পর প্রত্যেক দশ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ করে বেড়েছে। ২০০০ সালে প্রবৃদ্ধিতে আমরা ৫ শতাংশে পৌঁছে গেলাম। ২০১০ সালে ৬ শতাংশ এবং এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অতিক্রম করেছি। বাংলাদেশের এই অগ্রগতিকে বিদেশিরা ‘মিরাকেল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই ‘মিরাকেলের’ ব্যাখ্যা কী?

এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে তিনটি বিপ্লব। একটা হলো কৃষি বিপ্লব। যেটা করছেন কৃষক এবং কৃষি বিজ্ঞানীরা। এর ফলে এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চলতি বছরে এমনকি চাল রপ্তানিও হয়তো হবে! ১৯৭২-৭৩ সালে গ্রামের শতকরা ৮০ ভাগ লোক ছিল দরিদ্র। এখন এ সংখ্যা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য দূর করার মূল চাবিকাঠি সস্তা খাদ্য। সেটা কৃষকরা আমাদের তৈরি করে দিয়েছে।

বস্ত্র খাতে আমরা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়েছি। এটি হলো তৈরি পোশাক খাত। এর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব সমাজে পড়েছে। নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন। আমরা শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তুলতে পেরেছি। সস্তা শ্রমের কারণে আমরা তৈরি পোশাকে বিশ্ববাজার দখল করতে পেরেছি। এখন তৈরি পোশাক খাতে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয়।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বিপ্লব আমরা করতে পেরেছি রেমিট্যান্স অর্জনকারী গরিব মানুষের কল্যাণে। তারা বিদেশে পরিশ্রম করে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। এর থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা নিজে ভোগ করে বাকি টাকা দেশে পাঠান। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তাই এখন অনেক শক্তিশালী। আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান তথা SME-তেও কিছু উন্নয়ন হয়েছে।

‘মিরাকেল’ কি থেমে যাবে?

কিন্তু সামগ্রিকভাবে এত উন্নয়ন সত্ত্বেও এসব অগ্রণী খাতে ব্যাপক পরিমাণ কর্মসংস্থান হচ্ছে না। শিক্ষিত বেকার ভয়াবহভাবে বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে তীব্র গুণগত ও পরিমাণগত ঘাটতিও আছে। এখানে একটা ‘মিসম্যাচের’ বা চাহিদা-সরবরাহে অমিলের সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কার অন্য দিকটি হচ্ছে দেশে বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে ছিল ২২ পরিবার। এর মধ্যে একটি মাত্র বাঙালি পরিবার। এখন প্রায় ৫০ হাজার ধনী পরিবার রয়েছে দেশে। এদের একটা অংশের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে। অবলোপন-অ-অবলোপন ইত্যাদি সংজ্ঞার মারপ্যাঁচ বাদ দিলে মোট খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এটা সংশোধন করতে না পারলে আর্থিক খাতে ধস অনিবার্য। খেলাপিদের কেউ কেউ বিদেশেও টাকা পাচার করে দিচ্ছেন।

পুঁজি পাচার, বৈষম্য এবং দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য উচ্চ পর্যায় থেকে প্রথমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অতি ধনী অসৎ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমাতে হবে। গত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ৬৪ শতাংশ ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য হলো ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের শ্রেণিবিন্যাস পরিবর্তন করে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। উৎপাদনশীল শ্রেণিগুলোকে চিহ্নিত করে সংগঠিত ও উৎসাহিত করতে হবে।

তাদের নিয়ে দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারলে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি শুধু রক্ষা পাবে না, প্রবৃদ্ধি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। কিন্তু সরকার ও সরকারের বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্বে নবচরিত্রের শক্তিসমাবেশ ছাড়া সেটা অসম্ভব। কিন্তু যদি বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র না থাকে, আর সরকারি দলের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে ইপ্সিত পরিবর্তন আসবে না। তখন ‘মিরাকেলের’ চাকা থেমেও যেতে পারে।

 লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।