• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০১৯, ০৫:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৩, ২০১৯, ০৫:৫৩ পিএম

জিতল বিজেপি কিন্তু হারল কারা!

জিতল বিজেপি কিন্তু হারল কারা!

 কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ বলে বড়াই করত, ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি লিখে দিয়েছিল, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেনি, আসলে তারা চেয়েছিল সব ধর্মের সমান মর্যাদা, যেটা মোটেই ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ তার শেষ অস্ত্রশস্ত্র ও কৌশলগুলো প্রয়োগ করছে। সভ্যতার সংকট আগেও দেখা দিয়েছে। তবে বর্তমান সংকট আগের যে কোনো সংকটের তুলনাতে ভয়াবহ।

সম্প্রতি লোকসভার নির্বাচন হয়ে গেল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতে। তাতে জিতল কে, পরাজয়ই বা কার? জিতল কে সে তো দেখাই গেছে, জিতেছেন নরেন্দ্র মোদি, হেরেছেন তার প্রতিপক্ষ, কিন্তু আসল পরাজয়টা কার? না, গণতন্ত্রের নয়; বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ তা নির্বাচন, সে নির্বাচন তো হয়েছে এবং বিরোধীরা যাই বলুন নির্বাচনে এমন কোনো বড় রকমের অনিয়ম ঘটেনি যেটা না ঘটলে ফল অন্যরকম দাঁড়াত। মোদির ঝড় তো মিথ্যা ছিল না। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়েই নির্বাচিত হয়েছেন।

আসল পরাজয়টা কিন্তু অন্য এক পক্ষের, জনগণের। জনগণ হেরে গেছে। মোদি সরকারের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন ভারতবাসীকে আরো পাঁচ বছর সহ্য করতে হবে, উৎপীড়ন ঘটবে সংখ্যালঘুসহ দুর্বল মানুষের যারা জনগণের শতকরা আশিজন এবং ভারত বাধ্য হবে তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে এক কদম এগোতে।

বিরোধী দলগুলোও হেরে গেছে। লজ্জাজনক তাদের পরাজয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে মোদির যে ঝগড়া সেটা মৌলিক শত্রুতার ছিল না; ছিল ক্ষমতা দখল-সম্পর্কিত ঝামেলার। বিরোধী দলগুলো আওয়াজ তুলেছে ‘মোদি হটাও’, কিন্তু একবারও বলেনি মোদি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিনিধি ও সংরক্ষক তাকে হটাও। তারা বলেছে মোদি চৌকিদার নয়, সে পাকা চোর অতিশয়; কিন্তু বিরোধী নেতারা এমন সাক্ষ্য উপস্থিত করতে পারেননি যে ক্ষমতায় গেলে তারা চুরি করবেন না বা অতীতে ওই কাজ করেননি। তারা চেয়েছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা যেমন আছে তেমনি থাকুক, মোদির জায়গাতে তারা আসুক। সে কাজে তারা সফল হননি। ব্যর্থতার কারণ আছে।

প্রথমত, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি; জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা ঠিক ছিল না। দ্বিতীয়ত, মোদি যে আওয়াজটা তুলেছিলেন সেটা তারা তুলতে পারেননি। মোদির আওয়াজটা ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের। পাঁচ বছর আগে তাও তিনি অর্থনীতির উন্নতি চাই, ভারতীয় পণ্যর বিক্রি চাই এসব কথা বলেছেন; এবার ওসব বাহুল্য নেই, অর্থনীতি নেই, এবার শুধু জাতীয়তাবাদ। এবার বলেছেন ভারতের গৌরবের কথা; তার বক্তব্যে ভারত অর্থ দাঁড়িয়েছে হিন্দু ভারত; ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সম্ভব হলে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রই বানিয়ে ছাড়বেন; পৃথিবীর ভেতর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র, ইসরায়েল যেমন একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র।

মোদি ম্যাজিকের কথা শোনা গেছে। তা মোদি নানা রকমের জাদু দেখিয়েছেন বৈকি, এমনকি ধ্যানেও বসেছেন। কিন্তু তার আসল শক্তি দুই জায়গাতে, একটি হচ্ছে ওই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার, অন্যটি হচ্ছে পুঁজিপতি ও পুঁজিবাদীদের অকুণ্ঠ সমর্থন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জিনিসটা সব সময়ই একটা রহস্যাবৃত জিনিস ছিল। কেননা ভারত তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, এটি বহু জাতির দেশ এবং সবাই জানেন যে জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ধর্ম নয়, প্রধান উপাদান ভাষা। সেই হিসেবে সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ভারতে কমপক্ষে সতেরটি জাতি ছিল। ভাষাগত বৈচিত্র্যের দিক থেকে এই উপমহাদেশ ইউরোপ মহাদেশের তুলনায় মোটেই ছোট নয়। বাইরে থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা এসেছে, এসে ভারতকে নিজেদের শাসন ও শোষণের অধীনে নিয়ে প্রশাসনিক প্রয়োজনে রাজনৈতিকভাবে ভারতকে এক করে দিয়েছে। সব শেষে আগমন ব্রিটিশের; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের উপযোগিতা ছিল; কিন্তু সে সময়েও ভারতের বহুজাতিক পরিচয়টা অবলুপ্ত হয়ে গেছে, তা নয়।

ওদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দাবি করেছিল যে ভারতে একটি মাত্র জাতি আছে সেটি ভারতীয় জাতি, কিন্তু ওই জাতীয়তার ভিত্তিটা যে কী তা তারা বলতে পারেনি। ভারতের মুসলমানরা ভাবল কংগ্রেস ধর্মীয় অর্থাৎ হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলছে; ভয় পেয়ে তারা তাই আওয়াজ তুলল যে ভারতে একটি জাতি নয়, রয়েছে দুটি জাতি, একটি হিন্দু অপরটি মুসলমান। সম্প্রদায়কে জাতি বলে চালিয়ে দেয়ার ওই পথেই দেশভাগ হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো প্রকার সমাধান হয়নি। ভারতীয় জনতা পার্টি সরাসরি কোনো প্রকার লুকোছাপা না করে হিন্দু ধর্মকেই জাতীয়তাবাদের প্রধান উপকরণ বলে চালানোর অটল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ভারতীয় কংগ্রেস যা করতে পারেনি ভারতীয় জনতা পার্টি সেটা সম্ভব করবে, এমন সংকল্প।

তবে তাদের ওপরের ওই হিন্দু গেরুয়া আচ্ছাদনের ভেতরে যা আছে সে বস্তুটি মোটেই আধ্যাত্মিক নয়, সেটি পুরোপুরি ইহজাগতিক। সেটি হলো পুঁজিবাদ। সারা বিশ্বে পুঁজিবাদ এখন পতনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং টিকে থাকার জন্য আগে যেসব ছাড় দিয়েছে ও উদারনৈতিকতার যে ধরনের ভান করেছে, সেসব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চরম ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। এখন সে যেমন নৃশংস তেমনি লজ্জাহীন; নৃশংসদের অবশ্য লজ্জা বা শঙ্কা কিছুই থাকার কথা নয়। এই ফ্যাসিবাদীরা ধর্ম, উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, আঞ্চলিকতা, পিতৃতান্ত্রিকতা, এসব নোংরা ও বিষাক্ত আবর্জনাকে দুহাতে ব্যবহার করে; মানুষকে তারা উত্তেজিত করে, ঠেলে দেয় আদিমতার দিকে। উত্তেজিত মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলো ভুলে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; পুঁজিবাদ ভাবে আপাতত বাঁচা গেল। এবারের ভারতীয় নির্বাচনেও ওই ফ্যাসিবাদী তৎপরতার প্রকাশটাই দেখা গেল। টাকা ও পেশিশক্তির যদৃচ্ছা ব্যবহার তো ঘটেছেই, ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদকেও।

মূল বিরোধীরা মোদি হটাও মোদি হটাও বলে পাড়া মাতিয়েছে, কিন্তু মোদির জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। মোদির দলের শপথ বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি করবে। প্রধান বিরোধী এবং বিরোধীদের ভেতর একমাত্র সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস কিন্তু বলেনি যে তারা ওইসব কাজের বিরোধী বরং নির্বাচনের অল্পদিন আগে তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেই দিয়েছেন যে রামমন্দির বানানো নিয়ে বিজেপি যা করছে তা ছলনা মাত্র; রামমন্দির বানাব আমরা। দলের পক্ষ থেকে তার এই বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। মোদি বলেছেন তিনি রামের অনুসারী; তাকে তাড়িয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞায় সবচেয়ে যিনি মুখর ছিলেন সেই মমতা ব্যানার্জি বলেছেন যে রামের চেয়ে দুর্গা বড় এবং তারা, পশ্চিমবঙ্গের লোকরা মা দুর্গার পূজারি, বাংলায় এলে রাম দুর্গাকে প্রণাম করবে। হাজার হোক রাম তো মানুষই, দুর্গা হচ্ছেন দেবী। মমতা দিদি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের স্বার্থের রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, কিন্তু তার আসল লড়াইটা দেখা গেল দুর্গার পক্ষে দাঁড়িয়ে রামের বিরোধিতার। রাম বড় না দুর্গা বড় এই ধর্মীয় বাহাসে জনগণের ইহজাগতিক স্বার্থের স্থানটা কোথায়? কোনখানে? কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ বলে বড়াই করত, ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি লিখে দিয়েছিল, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেনি, আসলে তারা চেয়েছিল সব ধর্মের সমান মর্যাদা, যেটা মোটেই ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। এখন তো কেবল তৃণমূল কংগ্রেস নয়, মূল কংগ্রেসও মোদির ধর্মবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছে।

গান্ধীজির প্রসঙ্গ এখানে আসে। তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু তাই বলে ধর্মনিরপেক্ষ যে ছিলেন তা মোটেই নয়। তিনিও চাইতেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ধর্মের সমান মর্যাদা। ওই পর্যন্তই, তার বেশি নয়। সর্বোপরি তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের লালনটা ছিল সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রাখার অপ্রত্যক্ষ চেষ্টা। ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন না করার যে নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন রাজনীতির সে ধারারই চরমপন্থি পথিক হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। দেশভাগের সময় গান্ধীজি বিপদগ্রস্ত মুলমানদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন দেখতে পেয়ে আরএসএস ক্ষিপ্ত হয়েছে। এবং গান্ধীজিকে হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপেনি। গান্ধী হত্যার নায়ক ওই আরএসএস এখন বিজেপির অন্তরঙ্গ সঙ্গী। গান্ধীজিকে বলা হতো জাতির পিতা। জাতির পিতা দুবার পরাজিত হয়েছেন। একবার সাতচল্লিশে, দেশভাগের সময়ে। পরাজিত হয়ে সেবার তিনি প্রাণ দিলেন। তারপর স্বাধীন ভারতে বিজেপির শাসনে তার দ্বিতীয় পরাজয় ঘটল, আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উল্টো দিকের যে পথটি চলে গেছে সমাজবিপ্লবের দিকে, সে পথে তিনি যাননি, কংগ্রেসকেও যেতে সাহায্য করেননি। বরং ঠেকিয়ে রেখেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটা এতদিন ছিল কিছুটা আলাদা। দল হিসেবে হিন্দু মহাসভার জনপ্রিয়তা সেখানে সীমিতই ছিল, মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরে সেটা প্রায় নিঃশেষই হয়ে গিয়েছিল। বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্য রাজ্যে যখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তখন শান্তই ছিল। রাজ্যের বামফ্রন্টের ভালো কাজগুলোর একটি ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না দেয়া।

এমনকি পাঁচ বছর আগের নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি, আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি। মমতা দিদি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন বিজেপি এবার একটাও পাবে না। তারা আসন কেবল যে পেয়েছে তা নয়, মমতার বাইশটির বিপরীতে আঠারটি দখল করে নিয়ে ইতোমধ্যে এমন আশঙ্কা তৈরি করে ফেলেছে রাজ্যের আগামী নির্বাচনে তৃণমূলকে হটিয়ে তারাই ক্ষমতা দখল করে নেবে। তার লক্ষণ যে দেখা যাচ্ছে না তাও নয়। মমতার দল ছেড়ে ইতোমধ্যেই মোদির দলে কেউ কেউ ভিড়ে গেছে, আগামীতে আরো অনেকে যাবে। সাতচল্লিশের সময় দেশভাগের ব্যাপারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে বিশেষ রকমের আগ্রহী হয়ে পড়েছিল তার একটা কারণ কলকাতা শহরকে দখলে রাখার আশা। তারপর থেকে বাঙালিদের হটিয়ে দিয়ে কলকাতা ক্রমাগত সর্বভারতীয় পুঁজিপতিদের অধীনে চলে গেছে, এবার কেবল কলকাতা নয় গোটা পশ্চিম বাংলাই হয়তো চলে যাবে তাদের কর্তৃত্বে।

মমতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা সদম্ভে উড্ডীন করেছিলেন। তিনি যে কেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেটা তো ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে যখন তিস্তার পানির হিস্যা না দিয়ে বাংলাদেশের তাবৎ বাঙালিকে কাবু করার ব্যাপারে তার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বাঙালি মমতার বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব গুজরাটি মোদিকেও লজ্জায় ফেলেছে। অন্ততপক্ষে নামে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কংগ্রেসকে এবং তারপরে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্টকে তিনি হটালেন এবং উভয়ক্ষেত্রেই সহায়ক শক্তি হিসেবে পেলেন বিজেপিকে। এবং তারপরেই হঠাৎ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেজে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় সমানে বাঙালিদের স্বার্থের পক্ষে শোরগোল শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে বিজেপি যেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সেটাই সম্ভব হয়ে গেল, বিজেপির জন্য পশ্চিমবঙ্গের দখলদারিত্বের রাস্তা খুলে গেল। বোঝা গেল আসলে মমতা দিদিও বিজেপির মতোই পুঁজিবাদী। নামেই যা পার্থক্য।

বোঝা গেল পুঁজিবাদীদের হাতে কোনো কিছুই নিরাপদ নয়, এমনকি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক যে জাতীয়তাবাদ সেটাও নয়। আগামীতে মমতা ব্যানার্জিকে হয়তো রণক্ষেত্রে আর তেমন একটা দেখা যাবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের যে ক্ষতিটা তিনি করে দিয়ে গেলেন তার মাসুল সেখানকার মানুষকে তো বটেই, পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে বাঙালিরা আছে তাদেরও বহন করতে হবে, বাংলাদেশের বাঙালিদের গায়ে তো আঁচ লাগবেই।

এই নির্বাচনে বামপন্থিরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে তাদের ঘাঁটি ছিল, সে ঘাঁটি হাতছাড়া। কেরালাতে কোনো মতে মাথাটা উঁচু করে রেখেছে। বামবিরোধীরা তো অবশ্যই, উদারনীতিকরাও মনে হচ্ছে সেটা দেখে বেশ আমোদে আছেন। তারা হয়তো জানেন না যে চরম দক্ষিণপন্থিদের বিরুদ্ধে আগামীতে যদি কেউ দাঁড়ায় তবে দাঁড়াবে ওই বামপন্থিরাই। তবে ততদিনে হয়তো বামপন্থিদের এই বোধোদয়টা ঘটবে যে ভারতের জাতি সমস্যা সমাধান না করলে শ্রেণি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অকার্যকরই রয়ে যাবে। পুঁজিবাদীদের হিন্দুত্ববাদের মানববিদ্বেষী মায়াজাল ও ঘৃণা ছড়ানোর তৎপরতার আঘাতে শ্রেণি সমস্যাটা আড়ালে চলে যাবে, এখন যেমন গিয়েছে ও যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, এবং সেটাই হয়তো প্রথম, তাদের কাজ করতে হবে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে। কোনো বামপন্থিই প্রকৃত অর্থে বামপন্থি নয়, যদি সমাজ বিপ্লবী না হয়। বামপন্থিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, কিন্তু নির্বাচনপন্থি হয়ে পড়লে বামপন্থিদের যে ভবিষ্যৎ নেই সেটা তাদের বর্তমান দুর্দশাই বলে দিচ্ছে। নির্বাচনের মোহ বিপ্লবী চেতনাকে গ্রাস করে ফেলার ক্ষমতা রাখে এবং গ্রাস করে ফেললে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায় সিপিএমের বর্তমান দুর্দশা তার জীবন্ত সাক্ষী। বামপন্থিদের আরো একটা কাজ করা চাই। সেটা হলো সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে বিস্তৃত ও গভীর করা। সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সম্পর্কটা একেবারে অঙ্গাঙ্গী। সাংস্কৃতিক কাজে সিপিএম মোটেই উৎসাহ দেখায়নি।

ভারতের জনগণ আপাতত হেরে গেছে, কিন্তু এটা চূড়ান্ত ঘটনা হতে পারে না। কারণ চূড়ান্ত হলে বুঝতে হবে ভবিষ্যৎ বলতে অন্ধকার ভিন্ন অন্যকিছু নেই। এই সংকট কেবল ভারতের নয়, সারা বিশ্বেরই। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ তার শেষ অস্ত্রশস্ত্র ও কৌশলগুলো প্রয়োগ করছে। কিন্তু তারা পারবে না, কারণ তারা শত্রুতা করছে মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎ, সবার সঙ্গে। সভ্যতার সংকট আগেও দেখা দিয়েছে। তবে বর্তমান সংকট আগের যে কোনো সংকটের তুলনাতে ভয়াবহ। কেননা এতে পৃথিবী নামের গ্রহটির অস্তিত্বই বিপন্ন, যেমনটি আগে কখনোই ঘটেনি। এর বিরুদ্ধে সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসীদের দাঁড়াতে হবে, বিশ্বব্যাপী। নিজ নিজ দেশের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ সামাজিক বিপ্লবের আবশ্যকতার এই উপলব্ধির দিকেই এগোচ্ছে, ভরসাটা সেখানেই।

 লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।