• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১০, ২০১৯, ০১:৫৫ পিএম

শিশু ধর্ষণ

বত্তিচেল্লির ‘ভেনাস’ থেকে ‘বিপন্ন গৌরী’

বত্তিচেল্লির ‘ভেনাস’ থেকে ‘বিপন্ন গৌরী’

   বহু যুগ আগে থেকে শিশুদের ‘দেবশিশু’ বা ‘স্বর্গের দূত’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিলো। শিশুদের মধ্যে দেবতার বাস - একথা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করে আজও। এই বিশ্বাসের বাস্তবতা দেখি মানুষের চিন্তায়,বিশ্বাসে, লেখায়, চিত্রকলায় মননশীল প্রকাশে। বিশেষত বিশ্বখ্যাত শিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লির আঁকা ‘ভেনাসের জন্ম’ ছবিটা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। মনে হয় এইতো ঈশ্বর , এভাবেই ঈশ্বরের জন্ম যা বিশ্বখ্যাত শিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লি জেনেছিলেন ও বুঝেছিলেন ,তাই এঁকেছিলেনও। সেই সঙ্গে শিশুদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে পবিত্র কর্তব্য হিসেবেই জ্ঞান করার বিধান ছিলো সবখানে। কিন্তু  এখন শিশুর বিপন্নতায় কেঁদে উঠছে মানবিকতা।

 সম্প্রতি শুরু হয়েছে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী । সেখানের একজন শিল্পীর কাজ সবার দৃষ্টি কেড়েছে। চারপাশে কয়লা  ময়লা আর বর্জনা। তার মধ্যে স্ট্রেচারে শুয়ে আছে একটি রক্তাক্ত শিশু।  পাশে ময়লা আবর্জনার মধ্যে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে  শিশুটির খেলনা । মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার স্কুলের খাতা- তাও ছেড়া। খাতায় কোমল হাতের একটা ছবি আঁকা যার পাশে লেখা রয়েছে ‘বাবা পচা’। স্ট্রেচারের পুতুলটি খেলনা পুতুল। কিন্তু এটা দেখে কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে এটা দিয়ে শিল্পী কি বোঝাতে চেয়েছেন?  শিশু ধর্ষনের   ভয়াবহতাকে শিল্পী তুলে ধরেছেন তার শিল্প কর্মেরে মাধ্যমে। এ শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। শিল্পী রাজীব রায়ের ‘বিপন্ন গৌরী’ শিরোনামের শিল্পকর্মটি এটি।  

রেনেসাঁর অন্যতম মহান চিত্রশিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লির সময় (১৪৪৫-১৫১০)। আর রাজীব রায়ের সময় ২০১৯। বতিচেল্লির ‘ভেনাস’ অর্ধশতাব্দি পরে এখন ‘বিপন্ন গৌরী’ নামে আত্ম প্রকাশ করেছে। এটা যে কত আতংকের, কত বিপন্নতার, কতোটা অমানবিক তা বলে শেষ করার মতো নয়। একদিন যে দেবশিশুকে কেন্দ্র করে শিল্পীদের চিত্রকলায় দেবশিশু কেন্দ্রিক চিন্তা বিকশিত হয়েছে, একটি শিশুকে এঁকে বতিচেল্লির মতো শিল্পী নাম দিয়েছে ভেনাস। গ্রীকের প্রেমের দেবী ভেনাস। গ্রীক পুরাণ মতে ,আমরা যাকে ‘আফ্রোদিতি’ বলেও জানি। সমুদ্রের ফেনা থেকে তার জন্ম। সেই ভেনাসকেই চিত্রিত করা হয়েছে এখানে।  সাগরের বুকের গহন থেকে  উঠে আসছেন দেবী ভেনাস, ঝিনুকের তরী বেয়ে । বতিচেল্লির এ চিন্তা রেনেসাঁর সময়ের। তারপর কেটে গেছে পাঁচশ’ বছর। এখন আমাদের শিল্পীর হাতে তৈরী হচ্ছে ‘বিপন্ন গৌরী’। সেই দেবশিশু ধর্ষণ হচ্ছে ,হত্যা হচ্ছে,নারকীয় ভাবে যাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে চোখে আগুন জ্বলে ওঠে, বুকে ক্ষোভের দানা দাবানল হয়ে উঠতে চায় । তারপরও  দেশে এ অপকাণ্ড  বেড়েই চলছে। 

কয়েকদিন আগে ফেসবুকে সিলভারডেল স্কুলের নার্সারি, প্লে গ্রুপের শিশুদের একটা মানব বন্ধনের ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যায় স্কুলের পোশাক পড়া মেয়ে শিশুরা প্লাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্লাকার্ডে তারা তাদের সমবয়সী শিশু সামিয়া আফরিন হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছে । এই সব দেবশিশুরা যখোন কোন ধর্ষকের ফাঁসি চায় তখন কি বলার থাকে? লজ্জায় -ঘৃনায় বিবেক কুকড়ে ওঠে। যে বয়সে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের দেবশিশুদের মিছিল করতে হচ্ছে সেটা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার আমানবিক দৃষ্টান্তের একটি। আমি একজন কন্যা সন্তানের বাবা। আমারে চোখে এ মিছিলটি কেমন প্রভাব ফেলতে পারে,আমাকে কতোটা অসহায় করতে পারে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়া কথা নয়। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটেই চলেছে। এ ঘটনার শেষ কোথায় আমরা জানি না। অর্থাৎ এই ধরনের নারকীয়তা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে সেটাও আমাদের জানা নেই । শিশু ধর্ষনের বিষয়টি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে এবং  ক্রমশ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে রূপ নিচ্ছে । প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই সে রূপ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। 

তারপরও থামছে না এ নারকীয়তা। থানাগুলোতে শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ  এ সামাজিক বিকৃত ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ।  ঘর থেকে বাইরে, স্কুল- মাদ্রাসা থেকে তার এক্কা দোক্কা খেলার জায়গা কোথাও শিশুরা নিরাপদ না। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শী থেকে তার বিদ্যাপীঠের সম্মানিত শিক্ষক কারো কাছে তার নিরাপত্তা নেই।  এ  দুঃসহ ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে । কোন কিছুই যেন একে ঠেকাতে পারছে না ।  শুধু কি তাই? শিশু ধর্ষণই শুধু আতংক নয় ধর্ষনের পর ঘটনা থেকে নিজেকে আড়াল করতে ধর্ষক খুনের পথ বেছে নিচ্ছে । অর্থাৎ একটা শিশুর জন্য ধর্ষনই শেষ পরিণতি নয়। যৌন নিপীড়নে ছেলে-মেয়ে সব শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার কথা উঠে আসছে অধিকাংশ জরিপে ।শিশুরা যাবে কোথায়? কোথায় তারা নিরাপদ?

 গত শুক্রবার নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করতে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে ধরা পড়েন শহরের একটি কওমি মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তার নাম আবুল খায়ের বেলালী। তাকে গ্রেফতারের পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। পুলিশের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, এর আগে ওই মাদ্রাসার অন্তত ৮ শিশু শিক্ষার্থীকে তিনি ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণের পর শিশুদের পবিত্র কোরান ছুঁইয়ে শপথ করাতেন যেন ধর্ষণের ঘটনা কাউকে ফাঁস করে না দেয়। সব ঘটনাগুলোর বর্ননা শুনলে ভাবতে কষ্ট হয় মানুষ এত নিকৃষ্ট কাজে মানুষ প্রবৃত্ত হয় কিভাবে? যতই বলি এটা সামাজিক ব্যাধি তারপরও এটাই ঠিক যে একজন মানুষ এ কাজ করছে। হোক সে বিকৃত রুচির । সাত বছরের একটি পুতুলের মতো শিশুকে দেখে যাদের ঘৃণ্য লালসা জাগে, তাদের জন্য যাদের বুকটা একটুও কাঁপে না,তারা কি মানুষ ? তাদের বেঁচে থাকার অথধকার আছে?  এসব প্রশ্নের পরেও এটাই সত্যি যে শিশুটির নিরাপত্তা দিতে আমরা অক্ষম। মায়ের কোল শুন্য করে তাকে শীতল মৃত্যুর দিকে টেনে নিতে অজস্র বর্বর পাষন্ড আজ তৎপর। গত শুক্রবার ছুটির দিনের বিকালে খেলতে বেরিয়েছিল  ৭ বছরের শিশু সামিয়া আক্তার সায়মা। ওয়ারিতে উদ্ধার হওয়া সায়মার লাশের ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে,তাকে ধর্ষণ করে ঘটনার ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হত্যা করা হয়েছে। গণমাধ্যমে এসব খবর বিস্তারিতভাবে এসেছে।

 ক্রমাগত ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় আতংকিত প্রহর গুনছে শিশুদের বাবা-মায়েরা। বিভিন্ন সংগঠন এতে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তাতে হালে পানি পাচ্ছে না। শিশু ধর্ষন সবকিছুর পরেও কিভাবে বাড়ছে সেটা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম নামের একটি সংগঠন গত ২ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। তারা বলেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) মোট ২১৫৮টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ৯৮৮টি শিশু বিভিন্ন ধরনের অপমৃত্যু এবং ৭২৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেওয়া এ প্রতিবেদনে তারা বলেছে, গত বছরের তুলনায় এই বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ হারে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯৬টি শিশু। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৫১টি। এটাই যে সব তথ্য তা মনে হয় না। লোকচক্ষুর অন্তরালে আরও অনেক খবর থেকে যায়,যা ভুক্তভোগিরা ছাড়া জানেন না কেউ।

সারা দেশের অভিভাবকরা আশ -পাশের ঘটনা ও পত্রিকার তথ্য দেখে শংকিত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছে কয়েকজন।  পরিবারের কাছেই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে শিশুরা। নিজ ঘর বা পরিবারেও শিশুদের প্রতি ঘটছে এমন ধরনের পৈশাচিক ঘটনা। মানুষ যাবে কোথায়? আমার কাছে বাসার ফোন আসলে ফোনটা দেখেই আমি বিচলিত হই। ফোন রিসিভ করে প্রথম খবর নেই মেয়েটার। এমন আতংকিত থেকে কতকাল বাঁচা যায়? আমার মতো সব বাবা-মায়েরাই আতংকিত সময় পার করছে। এর কোন নিরাময় নেই?

মানসিক বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত  প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। তারা বলছেন, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানসিক ও সামাজিক অধঃপতন ঘটছে। তা বিকৃত রুচিতে রূপ নিচ্ছে। অবক্ষয়িষ্ণু সমাজে অসুস্থ যৌনতা চর্চার যেমন প্রসার ঘটে তেমনি মানসিক বিকার গ্রস্ততাও বাড়ে। আমরা মানসিক বিকারগ্রস্ত এক সহিংস সমাজে বসবাস করছি। যেখানে শিশু পর্যন্ত ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। 

 শিশুর প্রতি সহিংসতা যতটা বাড়ছে, তার সঙ্গে ঘটনা চেপে না রেখে প্রকাশ করার সাহস ও সচেতনতাও বাড়ছে।  এ ক্ষেত্রে  ঘরে বসে আতংকিত প্রহর পার না করে মানুষের সুপ্ত প্রতিবাদ নিয়ে প্রকাশ্যে আসা উচিৎ । এই স্পৃহাকে ইতিবাচকভাবে দেখে অপরাধ কমানোর মতো পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারের আরো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার ঘরে ঘরে, তার সাথে সরকারের উচিৎ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা । যাতে   মধ্য যুগের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুনাকারের ভাষায় যেন বলা যায়- “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’