• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৪, ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি

আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের যবনিকাপাতের দিন। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিলেনখ্যাত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দেহাবসান ঘটে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের একটি কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন বন্দুকের নল উঁচিয়ে রাতের অন্ধকারে। তিনি বছরের পর বছর এ দেশের গণতন্ত্র নিয়ে উপহাস করেছেন। হয়েছেন তিনি নিজেও উপহাসের পাত্র। তিনি শুধু রাষ্ট্র আর গণতন্ত্রকেই উপহাস করেননি, আপাদমস্তক ভণ্ডামিতে দূষিত করেছেন চারপাশ। কবিতা লেখার ভড়ং করেছেন, নারীলিপ্সুতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, অত্যন্ত দক্ষতায় খেলা করেছেন ধর্মপ্রাণদের অনুভূতি নিয়ে, আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার রক্তে রাজপথকে করেছেন পিচ্ছিল। 

ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখেতে ছাত্র-জনতার রক্ত নিয়ে এ হোলিখেলা এইচএম এরশাদ রপ্ত করেছিলেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এবং জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। জিয়াউর রহমানের দেখানো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কাজটিই সুচারুরূপে সম্পাদন করেন জেনারেল এরশাদ। তিনি এ দুর্বৃত্তায়নকে আরও পাকাপোক্ত এবং একটি রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করান। 

জিয়াউর রহমানের মতোই ক্ষমতা দখল করে প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে একই কায়দায় রাজনৈতিক দল গঠন করেন এইচএম এরশাদ। তিনি অবসরপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, কিছু পতিত বামপন্থি আর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। বিভিন্ন দল থেকে রাজনীতিবিদদের নানা প্রলোভন দিয়ে তার দলে ভেড়ান। তবে জিয়ার চেয়ে এরশাদের আমলে রাজনীতিবিদ কেনাবেচা বিস্তার লাভ করে ব্যাপকভাবে। কোনো সংকট দেখা দিলেই বিরোধী দলের নেতাদের টোপ দিতেন এরশাদ। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, মেয়রসহ নানা পদ দেওয়া হতো। এ সর্বনাশা প্রক্রিয়া সামরিক শাসনপরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলেও চলমান। রাজনৈতিক এ দুর্বৃত্তায়নের ফল রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু ইতোমধ্যেই ভোগ করতে শুরু করেছে। 


স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ কলুষিত করতে জিয়ার তুলনা জিয়া নিজেই। জিয়ার শাসনামল বিশ্লেষণ করলে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে- একজন সামরিক অফিসারের বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখল, নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা, হ্যাঁ-না ভোট, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, ইচ্ছামতো ফরমান-আদেশ অধ্যাদেশ জারি, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সৈনিককে হত্যা, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা এবং জেলহত্যা বিচারের উদ্যোগ না নেয়া, খুনিদের সুরক্ষা ও হত্যাকারীদের বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করার মতো কলঙ্কিত ইতিহাস। তিনিই ‘রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন’ করে দেওয়ার তত্ত্বের প্রবক্তা। ছাত্রনেতাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থ তুলে দেয়ার সূচনা করেছেন তিনিই। আজ সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি, মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের রাজনীতি, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের জন্মসূত্র কোথা থেকে। 

জিয়ার মতো এরশাদও শিয়ালের মতো ধূর্ত কোনো অংশেই কম নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়া যেমন ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এরশাদের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় এরশাদ ছুটিতে রংপুর ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তান থেকে আটকেপড়া বাঙালিরা যখন ১৯৭৩ সালে দেশে ফেরেন, তখন তিনিও প্রত্যাবর্তন করেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে তাকে সেনাপ্রধান করেন। এক সময় এরশাদ ছিলেন তার সামরিক ও রাজনৈতিক পরামর্শক। এরশাদকে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। শোনা যায়, তার পরামর্শেই নাকি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের দূরে ঠেলে দেন জিয়াউর রহমান। দেশে চাউর আছে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদের নির্দেশেই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা আবুল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকা-ের বিচার শুরু করবে বিএনপি সরকার। বিএনপি দু-দুবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। অথচ ১০ বছর এ বিষয়ে কোনো কথাবার্তাও হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মঞ্জুর হত্যাকা-ের বিচার শুরু করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাজনৈতিক কারণে সেই উদ্যোগেও ভাটায় পড়ে আছে। এখন অবস্থাটা এমন, এরশাদ নড়লে মামলা নড়ত। এরশাদ চুপচাপ থাকলে মঞ্জুর হত্যা মামলার ফাইলও টেবিলের নিচে চলে যেত।

-------------------------------------------------------

স্বৈরাচারী কোনো শাসকের পতনের পর রাজনীতিতে টিকে থাকা মনে হয় বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম। এর জন্য যেমন রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ দায়ী, তেমনি দায়ী এ দেশের জনগণও। এ বিষয়ে কোনো শিক্ষা না নিলে দুর্বৃত্তায়নের ঘূর্ণাবর্তে আমরা চিরদিন ঘুরপাকই খেতে থাকব।

-------------------------------------------------------


রাজনীতিকে কলুষিত করার ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের কোনো জুড়ি ছিল না। এরশাদকে অনুগত ও বিশ্বস্ত মনে করে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। অথচ জিয়া হত্যার কিছুকাল পরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। অনেকেই সন্দেহ করেন, জিয়া হত্যায় এরশাদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। অবশ্য জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার অন্যতম আসামিও এরশাদ। যদিও মঞ্জুর হত্যাকা-ের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। এখন যা মনে হচ্ছে, এরশাদকে চাপে রাখার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এটি।
রাজনীতিতে হত্যা ও দুর্বৃত্তায়নের এখানেই শেষ নয়। জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খুনিদের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখেন আমৃত্যু, কিন্তু তার স্ত্রীর আমলে এসেও যদি বঙ্গবন্ধুর জীবিত কন্যাদের হত্যার ছক তৈরি হয় এবং এ হত্যাচেষ্টাকে ঢাকা দেয়ার চেষ্টাই প্রমাণ করে যে, তারা এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রক্তাক্ত সংঘাত বাবা থেকে মা এবং মায়ের কাছ থেকে পুত্রও বয়ে চলেছেন। নাকি ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে কখনই হারানো সম্ভব নয় বলে দলটির নেতৃত্বকেই শেষ করে দিতে এ এক মরিয়া চেষ্টা! দেশের জনগণকে পুরোপুরি স্বাধীনতার স্বাদ দিতে হলে একে অপরের হত্যার এ প্রবণতা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। 

’৯০-এর আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এইচএম এরশাদ জেলে গেলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই তাকে জোটে টানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এতে এরশাদও বেশ মওকা পেয়ে যান। তিনি বুঝে যান, তাকে ছাড়া কোনো দল চলতে পারবে না। তাই তিনি তখন সভা-সমাবেশে বলতেন, জাতীয় পার্টি ছাড়া এককভাবে কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না। তাই তিনি উভয়পক্ষের সঙ্গেই দরকষাকষি শুরু করেন। এ নিয়ে আমাদের অনেক ধরনের রাজনৈতিক খেলাও দেখতে হয়েছে। এরশাদ বিএনপি জোটে; আবার কখনো আওয়ামী লীগ জোটে যাচ্ছেন! আবার বলা হতো, জাতীয় পার্টি এককভাবেই নির্বাচন করবে এবং ৩শ আসনে প্রার্থী দেবে। শেষ পর্যন্ত এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে গিয়েই মহাজোট করেন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মহাজোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে জাতীয় পার্টি যোগ দেয়। আসলে এরশাদ যে স্বার্থ ছাড়া কিছু করেন না, সেটাই তিনি জীবদ্দশায় বারবার প্রমাণ করেছেন।

স্বৈরাচারী কোনো শাসকের পতনের পর রাজনীতিতে টিকে থাকা মনে হয় বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম। এর জন্য যেমন রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ দায়ী, তেমনি দায়ী এ দেশের জনগণও। এ বিষয়ে কোনো শিক্ষা না নিলে দুর্বৃত্তায়নের ঘূর্ণাবর্তে আমরা চিরদিন ঘুরপাকই খেতে থাকব। প্রকৃতির নিয়মে এক দুর্বৃত্তের দেহাবসান হলেও আরও অনেক দুর্বৃত্ত এখনও দুর্বৃত্তপনায় নিয়োজিত। এদের সম্পর্কে সদাসর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক 
 

আরও পড়ুন