• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০১৮, ১২:০২ এএম

নির্বাচনী  টুকিটাকি এবং বাড়াবাড়ি

নির্বাচনী  টুকিটাকি এবং বাড়াবাড়ি
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

দ্রুত নির্বাচন এগিয়ে আসছে এবং আমরা সেই নির্বাচনের উত্তেজনা এবং তাপ অনুভব করতে শুরু করেছি। তবে সেই উত্তেজনা এবং তাপের প্রায় পুরোটুকুই আসছে রাজনৈতিক দল এবং মনোনয়ন প্রত্যাশীদের থেকে।  সাধারণ ভোটারদের ভেতর আপাতত এক ধরণের কৌতুহল এবং কারো কারো ভেতর এক ধরণের শঙ্কা ছাড়া অন্য কিছু কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না।  আমি সবসময় আশা করে থাকি যে একটি সময় আসবে যখন ভোট নিয়ে আমাদের আগ্রহ এবং কৌতুহল থাকবে, কিন্তু কোনো শঙ্কা থাকবে না।  কারণ আমরা আগে থেকেই জানব, যে দলই আসুক, সেই দলই হবে অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক, প্রগতিশীল এবং দেশপ্রেমিক অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদশে স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নে বিশ্বাসী।  তখন দিনের বেলা ভোট দিয়ে আমরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাব, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখব কারা এই বছর সরকার গঠন করছে!

এ বছর নির্বাচনের যে বিষয়টা আলাদাভাবে সবার চোখে পড়েছে সেটি হচ্ছে বড় দল থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ।  বড় দলের তিনশ সিটের জন্য চার হাজারের অধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী।  এমন নয় যে একটি ফর্ম পূরণ করে জমা দিলেই হয়ে গেল। এর জন্য রীতিমতো মোটা টাকা খরচ করতে হয়। তারপরও প্রার্থীর কোনো অভাব নেই।  প্রর্থীরা যে একা আসছেন তাও নয়, দলবল নিয়ে আসছেন। পার্টি অফিস এবং তার আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য। ক্ষমতা দেখানোর জন্য মারামারি, গাড়ি পোড়ানো, কিছুই বাকি নেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরে মারামারি করার একটি নতুন ধারা শুরু হয়েছে, মনে হয় এখন থেকে আমরা প্রায়ই এটা দেখতে পাব। (সরকারি দল না হলে অবশ্য এই টেকনিক ভালো কাজ করে না, পুলিশ ধরে ফেলতে পারে, তখন এক ধরণের বেইজুতী হয়!)

প্রশ্ন হচ্ছে সাংসদ হওয়ার জন্য সবার এতো আগ্রহ কেন? যদি এরকম হতো যে একটা আদর্শের ধারক হয়ে দেশ সেবার জন্য আগ্রহণ তাহলে অবশ্যই আমরা খুশি হতাম। কিন্তু মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। সাংসদ হতে পারলে অনেক ক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতার সাথে সাথে অর্থ বিত্ত, ব্যবসা বাণিজ্য চলে আসে এবং সেটাই মূল আগ্রহ। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সেটা নিয়ে দুঃখ করে বলেছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে হলে সেই বিষয়ে লেখাপড়া করতে হয়, কিন্তু সাংসদ হতে  হলে কিছুই করতে হয় না।  সারাজীবন ব্যবসা করে, না হয় আমলা থেকে রিটায়ার করার পর কোনো দলের টিকেট নিয়ে সাংসদ হয়ে যাওয়া যায়। আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত। আমিও মনে করি যিনি সারাজীবন নিজের এলাকায় রাজনীতি করেছেন, একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন শুধু তাদেরই মনোনয়ন পাওয়া উচিত। 

মনোনয়ন দেওয়ার পর যারা মনোনয়ন পাননি তাদের অনেকের কর্মকান্ড আরেকটি দর্শনীয় বিষয় ছিল। একজন মনোনয়ন না পেয়ে যদি বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করেন আমি সেটা পর্যন্ত বুঝতে পারব।  কিন্তু মনোনয়ন না পেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে রাস্তাঘাট বন্ধ করে সবকিছু অচল করে দেওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পানি না। যিনি দলের মনোনয়ন না পেয়ে নিজের এলাকায় মানুষকে জিম্মি করে ফেলেন, তিনি নিজের মানুষের জন্য কী কাজ করবেন অনুমান করা খুবই কঠিন।  শুধু তাই নয়, যারা একটু চালাক চতুর তারা ঝটপট ফুল হাতে অন্র এক দলে যোগ দিয়ে সেখান থেকে মনোনয়ন নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না।  রাজনৈতিক আদর্শ বলে তাহলে কিছুই নেই?

এতদিন আমরা নিয়োগ বাণিজ্য বলে একটা কথা শুনে এসেছি। আমাদের মত “সৌভাগ্যবান” কিছু মানুষ সেগুলো অল্প বিস্তার দেখেও এসেছি। এ বছর আমার শব্দ ভান্ডারে “মনোনয়ন বাণিজ্য”  নামে একটা নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। নিজের রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলের কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দেওয়া হচ্ছে মনোনয়ন বাণিজ্যের কার্যপদ্ধতি। জাতীয় পার্টি এই নতুন অভিযোগে অভিযুক্ত।  যিনি ঘুষ দিয়েও মনোনয়ন পাননি তিনি স্বয়ং এই অভিযোগ করেছেন। আমার হিসাবে এটা একেবারে “হৈ হৈ কান্ড-রই রই ব্যাপার” হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখছি না! কিন্তু কে জানে, রাজনীতির বেলায় এগুলো হয়তো নেহায়েতই স্বাভাবিক ব্যাপার, কেবল আমাদের কমনসেন্সের অভাব বলে বুঝতে পারছি না!

“স্বশিক্ষিত” বলে আরেকটা নতুন শব্দের সাথে এবারে পরিচিত হলাম।  এতোদিনে জেনে এসেছি যে কোনো শিক্ষিত মানুষই স্বশিক্ষিত, কারণ শিক্ষার কোনো ট্যাবলেট নাই যেটা পানি দিয়ে খেলেই আমরা শিক্ষিত হয়ে যাই। সবারই নিজের লেখাপড়া করতে হয়, শিখতে হয় এবং স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পরিক্ষা দিতে হয়। শিক্ষিত মানুষ মানেই স্বশিক্ষিত মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে একজন সম্ভবত সেঠা জানাতে সঙ্কোচ বোধ করেন, সেজন্যই এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেই একজনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে রাজি নই। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে অসাধারণ একটি বই আছে। বইটি পড়ার সময় আমি ভেবেছিলাম সেটি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কাহিনী। পড়ার সময় বুঝেছিলাম তিনি মোটেও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেননি।  এই পৃথিবীটা ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়।  তিনি পৃথিবীতে তার কঠোর একটা জীবন থেকে  সবকিছু শিখেছিলেন। যারা রাজনীতি করেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু গণমানুষের সাথে থেকে কাজ করেছেন সেটি আমার কাছে বিন্দুমাত্র অগৌরবের কিছু নয়। 

নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশ হতে শুরু করেছে। সবাইকে নিজের ধন-সম্পদের বর্ণনা দিতে হচ্ছে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে সেগুলো পড়ছি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, কাজেই দশ বছর আগে একজনের যত ধন সম্পদ ছিল, এতদিনে সেটা বাড়তেই পারে। কিন্তু যখন দেখি দশগুণ বেড়ে গেছে তখন একটু চমকে উঠি। তবে যখন দেখি স্বামী বেচারা এখনো টেনে-টুনে দিন কাটাচ্ছে কিন্তু স্ত্রীর ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই, তখন একটুখানি কৌতুক অনুভব করি। আশা করছি স্ত্রীরা বিপদে আপদে তাদের স্বামীদের টাকা পয়সা দিয়ে একটু সাহায্য করবেন। 

এতক্ষণ যে সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি সেগুলো ছিল টুকিটাকি বিষয়। এবার বাড়াবাড়ি বিষয় নিয়ে একটু কথা বলি।  আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি কিছুদিন আগে বিএনপি’র একজন দায়িত্বশীল মানুষ বলেছেন যে জামায়েত ইসলামীতেও মুক্তিযোদ্ধা আছেন। সংবাদ মাধ্যমে কথাটি পড়ে আমি কী হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।  এই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞানও আছে, সেও জানে ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। শুধুমাত্র মৌখিক বিবৃতি দিয়ে বিরোধিতা নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। অক্ষরিক অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছিল। তাদের তৈরি বদর বাহিনী স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে এই দেশের কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকদের হত্যা করেছে।  বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা সেসব বুদ্ধিজীবিদের মৃতদেহে ছিল অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার ছাপ।  যিনি হৃদরোগের চিকিৎসক তার বুক চিড়ে হৃৎপি- বের করে আনা হয়েছে, যিনি চক্ষু চিকিৎসক তার চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছে, যিনি লেখক তার হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। সেইসব মুহূর্তের কথা চিন্তা করলে এখনো আমরা শিউরে উঠি। 

তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে।  পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা রাজনীতি করার সুযোগ পায় না।  আমাদের অনেক বড় দুর্ভাগ্য তারা শুধু যে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে তা নয়, বিএনপি’র হাত ধরে তার ক্ষমতার অংশ হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা কখনো এই দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি, কখনো বলেনি যে একাত্তরে তারা ভুল করেছিল। তাই যখন কেউ বলে জামায়াতে ইসলামিতে মুক্তিযোদ্ধা আছে তখন আমি চমকে উঠি। সত্যি যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধা জামায়াতে ইসলামিতে যোগ দিয়ে থাকেন তার অর্থ এই নয় যে জামায়াতে ইসলামি মুক্তিযুদ্ধের ধারক বাহক হয়ে গেছে। বুঝতে হবে সেই মুক্তিযোদ্ধার মতিভ্রম হয়েছে। আমাদের চারপাশে এরকম অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, আমরা তাদের দেখি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি। 

বিএনপি নির্বাচন করার জন্য জামায়াতে ইসলামিকে সাথে নিয়েছে, দেশের অনেক বড় রাজনীতিবিদরা তার মাঝে কোনো দোষ খুঁজে পাননি। জামায়াতে ইসলামির মত তারাও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন। আমরা সেগুলো মেনে নিতে পারি কিন্তু জামায়াতে ইসলামিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন সেরকম ঘোষণা দিয়ে সেরকম ঘোষণা দিয়ে মুক্তযোদ্ধাদের অপমান করবেন সেটা আমরা কখনো মেনে নেব না। 
আমি চাই আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী এই রাজনৈতিক দলটিকে এই দেশে পুরোপুরি গুরুত্বহীন একটি সংগঠনে পাল্টে দিক। 
***

"....আমি যদি একটিবার কথা বলার সুযোগ পেতাম"

এবারে সম্পূর্ণ  একটি ভিন্ন  বিষয় নিয়ে কথা বলি।  যখন এই লেখাটা লিখছি তখন  হঠাৎ করে দেখলাম ভিখারুননিসা স্কুলের একটি কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।  এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি সব সময়ই এক ধরণের আত্মার সংযোগ অনুভব করি।  খবরটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, আহা! অভিমানী  কিশোরীর সাথে আমি যদি একটিবার কথা বলার সুযোগ পেতাম তাহলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারতাম, পৃথিবীটা বিশাল, একটা মানুষের জীবন তার থেকেও বিশাল।  সবার জীবনে কখনো না কখনো দুঃখ-হতাশা-লজ্জা-অপমান আসে।  সেগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে এগিয়ে যেতে হয়।  কারণ সবকিচুর পর এই জীবনটি অনেক সুন্দর। 

আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি।  সারা পৃথিবীর উপর তীব্র একটা অভিমান নিয়ে সে পৃথিবী থেকে বিদায়  নিয়েছে। আমি নিজে তীব্র অপরাধবোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে তার মৃত্যুর জন্য আমিও বুঝি কোনো না কোনো ভাবে দায়ি।  বড় মানুষদের আমরা শুধু শাসন করতে শিখিয়েছি, ছেলে মেয়েদের ভালোবাসতে শেখাইনি।

আমাদের মাঝে সত্যিই কি কেউ জানে না, যদি তাদেরকে গভীর মমতা দিয়ে ভালোবাসা যায় তাহলে শুধুমাত্র ভালোবাসার 
মানুষটি যেন মনে কষ্ট না পায় সেজন্য তারা কখনো কোনো অন্যায় করে না! কেউ কি জানে না এই বয়সটি কী অসম্ভব স্পর্শকাতর একটি বয়স? কেউ কি জানে না অপমানের জ্বালা কত তীব্র? কেউ কি জানে না পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যবহার করেও একটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে ফিরিয়ে আনা যায় না? 

অরিত্রী, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই।  আমরা তোমাকে এই পৃথিবীতে বাঁচতে দিইনি। 
***

 

 

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়