• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০১৯, ০৮:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৮, ২০১৯, ০৮:৩৩ পিএম

মুমূর্ষু শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা

মুমূর্ষু শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা

এই শহরে বহু ঘটনা চোখের উপর দিয়ে চলে যায়। কে খবর রাখে কার? তবে অপরাধপ্রবণতা এত বেড়েছে, যা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। একবার গোপীবাগ রেলগেটের পাশে আড্ডা দিতে দিতে গভীর রাতের একটি ঘটনা আমাকে বিমর্ষ করে তোলে। এক মা ছটফট করছে রেলগেটের পাশ দিয়ে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী সমস্যা তার? তিনি বলেছিলেন? তার দুটো জমজ ছেলে এখনো ফিরছে না। জিজ্ঞেস করলাম তারা কি কাজ করেন? তিনি বলেন, তারা ছোট কাজ করতে পারে না। তাহলে? তিনি উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যান। আবার আসেন।এবারে রাত বাজে ১ টা। তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন। তার স্বামী অসুস্থ, তিনি কাজ করতে পারেন না। ওষুধ কিনতে তার একার কাজে হয় না। তাই জমজ ছেলে দুটোকে তিনি ভাড়া দেন।

ছোট শিশু কোলে নিয়ে ভিক্ষা করলে টাকা বেশি আসে। শিশুটি খায়নি বা এধরনের আবেদন যেকোনো মানুষকে ছুঁয়ে যায়। চাইতে আবেদনটা বেশি থাকে। এসব কারণে শিশু ভাড়া নেয় সব ভিক্ষুক। সে রাতে এক বয়সী চা-পানের দোকানদার, যিনি এসব জানেন, তার কাছে জেনেছিলাম, এই রেল গেটে অহর্নিশ বাচ্চা ভাড়া দেয়া-নেয়া হয়।বাচ্চারা মায়ের কোল ছাড়া থাকতে চায় না বলে তাদের ইনক্টিন ,সিডাক্সিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়। ফলে তারা দ্রুত নির্জীব হয়ে ঘুমাতে থাকে। তখন শুনেছিলাম, যেসব স্বামী-স্ত্রী চাকরি করেন তাদের সন্তানদের বুয়ারাও বিভিন্ন সময় ভাড়া দিয়ে বাড়তি টাকা আয় করেন। যতদূর মনে পড়ে, ডা. শাহজাদা সেলিমের (এখন পিজিতে কর্মরত)  কমেন্ট নিতে গেলে তিনি বলেছিলেন, এসব শিশু ঘুমের কারনে পানি বা খাবার অন্য খবার খেতে চায় না, খেতে পারেও না।

ফলে কিডনি দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আজকের কাগজে এ প্রতিবেদনটি খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিলো। প্রয়াত বার্তা সম্পাদক আহমদ ফারুক হাসান, এ ধরনের একাধিক প্রতিবেদন আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। সেই থেকে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কারো কোলে তার নিজের সন্তান ঘুমালেও আমার মনে হয়, কোন মায়ের সন্তান ভাড়ায় এনে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ভিক্ষা করছে ওই ভিক্ষুক। এমন একাধিক ঘটনা নিয়ে আমি প্রতিবেদন করেছিলাম তখন। আজকের পত্রিকায় চোখ যেতেই আরেকটি খবরে আমার চোখ আটকে যায়। বাবা সেজে নিউমোনিয়াসহ নানা অসুখে আক্রান্ত মুমূর্ষু এক শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করছিল এক ভিক্ষুক। শিক্ষাভবন সংলগ্ন সড়কে  যানজটে থেমে যাওয়া গাড়ির মানুষের কাছে ছেলেটিকে দেখিয়ে ভিক্ষা করছিলো এক ব্যক্তি, যিনি শিশুটির কথিত বাবা। পত্রিকার শিরোনামে ছিলো, ‘শিশুটির কথিত বাবা মা’। পাশেই হাইকোর্ট মাজার এলাকা। এখানে বিভিন্ন রকমের অপরাধীদের বাস- একথা কারো অজানা নয়।

কাঁধে সন্তান নিয়ে রাজধানীর যানজটে আটকে থাকা গাড়ির যাত্রীদের কাছে অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইছিল লোকটি। বাচ্চাটিকে দেখে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছিল, কিন্তু পুলিশের চোখ বলে কথা। পুলিশের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু চোখে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। আসল বাবা নয়; এক প্রতারক বাচ্চাটিকে নিয়ে নেমেছে ‘ভিক্ষা কারবারে’।  
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর শিক্ষা ভবনসংলগ্ন এলাকায় অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা করার সময়ে দৃশ্যটি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সুলতানা ইশরাত জাহানের চোখে পড়ে। তার সন্দেহ হলে তিনি চ্যালেঞ্জ করে বসেন।  তিনি ওই লোকের নাম জানতে চান। ভিক্ষুক নিজের পরিচয় জহিরুল বললেও বাচ্চার নাম বলতে ইতস্তত করছিলেন। জেরার মুখে বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে জহিরুল। অবশেষে ধরা পড়ে সেই প্রতারক। সঙ্গে শিশুটির কথিত মাকেও আটক করা হয়েছে। জহিরুলকে আটক করার পর জানা যায়, সে শিশুটির কিছুই হয় না।

পরে জহিরুলকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি শিশু ও কথিত মা জোসনাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে যান। সেখানেই শিশুটির চিকিৎসা চলছে এখন। পুলিশের জেরার মুখে জোসনা বলেন, সাত মাস আগে এক নারী তার কাছে শিশুটিকে রেখে পালিয়ে যায়। সেই থেকে শিশুটি তাদের কাছেই আছে। তার নাম রাখা হয়েছে, সানজিদা। পুলিশ কর্মকর্তার চোখে পড়লে যে বিষয়টি তাকে বেশি সন্দেহপ্রবণ করে সেটা হলো কোনো অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে তার বাবা এই প্রখর রোদে আর যাই হোক ভিক্ষা করতে পারে না। যে কারণে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব এতই কমে গেছে যে, আমরা কেউ কোনো বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করি না। যেকোনো ঘটনাকে মেনে নেই । ফলে ক্রমশ অমানবিক হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ-সামাজিকতা। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই সামাজিক আন্দোলন দরকার। নয়তো ১৫ বছর আগে যে বাস্তবতা দেখেছি বা লিখেছি তা আজও সমাজে বিদ্যমান। এই শিশুটিকে পুলিশ অফিসার  উদ্ধার না করলে সে মৃত্যু অবধি ভিক্ষার উপকরণ হতো।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুটির মৃত্যু হলেও সে ভিক্ষা বানিজ্যের হাত থেকে রেহাই পেত না।  তাকে নিয়ে আরেক দফা ভিক্ষা করা হতো।একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তার জন্য তা হয়নি। মেয়েটিও সুস্থ হবে দ্রুতসেটা আমরা আশা করছি। কিন্তু কথার শেষ এখানেই নয়।  হাসপাতালের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পরে শিশুটি কোথায় যাবে, তার গন্তব্য কোথায়? সেটাও যদি পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দেখেন তাহলে শিশুটির হয়তো একটি পথ হবে। নতুবা আবার তাকে এমন কথিত বাপ-মায়ের হাতে পড়ে সমাজের কোন পংকিল আবর্তে হারিয়ে যেতে হবে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারবো না। তবে এই ভিক্ষুক চক্রের বক্তব্য নিয়ে এ ধরনের অপরাধে যাতে কোনো শিশু ব্যবহৃত না হয় সে ব্যবস্থা পুলিশ করতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু করবেন কি?

লেখক :  সাংবাদিক,গবেষক