• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০১৯, ০৫:২৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৫, ২০১৯, ০৫:২৯ পিএম

গণপিটুনিতে হত্যা : মানবতার বিপর্যয়

গণপিটুনিতে হত্যা : মানবতার বিপর্যয়

পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে- এ গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপিটুনিতে হত্যা শুরু হলো। কী নির্মম নৃশংসভাবে একেকটি মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ভিকটিমের কোনো কথা না শুনেই দলবেঁধে অজস্র মানুষের সামনে তাকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। মানুষ এত অসহিষ্ণু,এতো অনুভূতিশূন্য পাথরে পরিণত হলো কিভাবে? আরো অবাক লাগে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে এনড্রয়েড ফোন দিয়ে তা ভিডিও করে, ফেসবুকে ছেড়ে মজা পায়। এ কেমন নারকীয় শান্তি?

কোত্থেকে এর উৎপত্তি? আমাদের দেশটা তো এমন ছিলো না। কারা তাকে এমন সহিংস করে তোলছে? কয়েকদিন আগেও বরগুনা সরকারিকলেজের সামনে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। কিভাবে একটা ছেলেকে পৈশাচিক কায়দায় কুপিয়ে মারা হলো, তার কত ভিডিওফেসবুকে ভাইরাল হলো। আমার মনে হয়, যারা এসব ভিডিও করছে তারা একটু এগিয়ে গেলেও হয়তো এমন ঘটনা ঘটতো না। একই কথা বলতে হয় তাসলিমা বেগম রেনুর কথা। শনিবার সকালে ঢাকার উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মেয়েকে ভর্তির জন্য ওই স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়ে কথাবার্তায় সন্দেহ হলে মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন জড়ো হয়ে নির্মম পিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। কেন তাকে মারা হবে? তার ভিডিও যারা করেছে তারাও কতোটা নির্মম? কিভাবে তারা পারলো এসব? পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে কেন? স্রেফ গুজবের পেছনে ছুটে মানুষ এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে এধরনের গুজব ইতিহাসে নতুন নয়।

প্রাচীন ভারতে তান্ত্রিকরা বহুগুজবের জন্ম দিয়েছেন  আমরা তা শুনেছি। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপাল কুন্ডলা’ উপন্যাসেও আমরা তান্ত্রিকের নরবলির বিষয়টি দেখি। অর্থাৎ এ চিন্তা বেশ আগে থেকেই মাথায় মাথায় ঘুরছে। শুধু তাই নয়; বড় বড় যত দিঘি, যেমন দিনাজপুরের রামসাগর, টাঙ্গাইলের সাগর দিঘি, বন্যা দিঘি- এসব খননের পেছনে একটি লোককথা রয়েছে ‘দীঘি খনন করার পর পানি উঠছিল না। রাজা খুব চিন্তিত। রাতে ঘুমালে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, তার স্ত্রী দিঘিতে আত্মবিসর্জন দিলে পানি উঠবে। একথা তিনি তার স্ত্রীকে
বললে রাজার স্ত্রী আত্মাহুতি দিতে রাজি হন। তিনি এক বিকেলে পাজাল-প্রদীপ সাজিয়ে দিঘির ভেতরে দাঁড়াতেই পানির বন্যা উঠে আসতেথাকে। ওই জলের ঢলে ডুবে যান রানী। এরপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন কাহিনী বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে শোনা যায়।  এসব ঘটনার কোনো প্রমাণ মেলে না। তবে এসবের কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও অযুত মানুষের মুখে মুখে এসব গল্প চলে আসছে বলেতা ঠাঁই পেয়েছে বিশ্বাসের জায়গায়। ফলে দিনের পর দিন, একের পর এক ঘটনা আমাদের বিস্মিত করছে। এটা এ জন্যেই যে, আমরা একটি আধুনিক সভ্য সমাজে বসবাস করে আসছি।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে- এমন একটি গুজবের ফলে সারা দেশে ছেলেধরা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলায় ছেলেধরা সন্দেহে এক সপ্তাহে নারীসহ ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও এর সংখ্যা আরো বেশি হবে। কিন্তু কথা হলো এ ঘটনার শেষ কোথায়? পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরে থেকেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের পোস্ট শেয়ার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত গুজব রটনার অভিযোগে ৬০টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ২৫টি ইউটিউব চ্যানেল ও ১০টি অনলাইন নিউজপোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। কেউ বলছেন, একটি সংঘবদ্ধ মহল গুজব ছড়িয়ে এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনায় নামছে। তবে একথা ঠিক যে গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা, ডাইনি, আখ্যা দিয়ে একের পর এক নারকীয় সব ঘটনা ঘটনা হচ্ছে। 

আমাদের কথা হলো, যেসব পাষণ্ডরা স্রেফ গুজবের ভিত্তিতে বর্বরোচিতভাবে মানুষ হত্যা করছে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।একই সঙ্গে মানুষের দূর হোক অসহিষ্ণুতা । দোষী কাউকে পেলে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে না দিলে এই হিংসার উন্মত্ত আগুনে পুড়ে মরবে কত শত মানুষ তা আমরা কেউ জানি না। নিজের ভাই-বোনের রক্তে হাত রাঙানোর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা কারা? এরা কি গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যায় নেমেছে।যদি তা না হয় তাহলে আমরা কোন সমাজে বাস করছি যেখানে কোন চিন্তা ভাবনা না করে একজন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হচ্ছে। আপনি, আমি মানুষ মানুষ। মানবিকতা আমাদের ভেতরে আছে বলেই এই গণপিটুনিকে আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি একে মানবিক বিপর্যয় ভাবছি । মানুষের ভিতরে মানবতা থাকবেক,মনুষ্যত্ব থাকেবে এটাই স্বাভাবিক। মনুষ্যত্ব বিবর্জিতরা মানুষ নয়, এরা খুনী, এরা বর্বর,আদিম।  এই অপশক্তির  বিরুদ্ধে দাড়ান। মানবতার এই বিপর্যয়  রুখতে  সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন। এর বিকল্প নেই

লেখক : সাংবাদিক