• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৪, ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

ডেঙ্গু প্রতিরোধ 

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা

দেশে ডেঙ্গু-আতঙ্কে বিপন্ন মানুষের জীবন। প্রতিদিনই আসছে মৃত্যুর সংবাদ। রাজধানীর হাসপাতালগুলোর শয্যা ছাড়াও ফ্লোর, করিডর, এমনকি সিঁড়িতেও অবস্থান নিয়েছে ডেঙ্গু রোগীরা। ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত (শনিবার সকাল) ১৮ জন মারা গেছেন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গু-আতঙ্ক সাধারণ মানুষের মাঝে এতদূর ছড়িয়েছে যে, বর্তমানে সামান্য সর্দি-জ্বর বা মাথাব্যথা হলেই তারা ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে ছুটছেন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজ কবির ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ভর্তির ২২ ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। তার এই ২২ ঘণ্টার চিকিৎসার বিল আসে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৪ টাকা। ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ২২ ঘণ্টায় কীভাবে এত টাকার বিল হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়ারও তাগিদ অনুভব করেনি। বিলের কপিতে দেখা গেছে, একদিনেরও কম সময়ে শুধু ওষুধ বাবদই তার লেগেছে ৩২ হাজার ৩২১ টাকা। এত কম সময়ে এত টাকার ওষুধ ব্যবহারের ব্যাখ্যা সাধারণের বোধগম্য না হলেও একমাত্র চিকিৎসক এবং ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তা দিতে পারবে। পরে অবশ্য ডাকসু নেতাদের হস্তক্ষেপে বিল ছাড়াই হাসপাতাল থেকে ওই শিক্ষার্থীর মরদেহ নিয়ে আসা হয়।

ফিরোজের এ ভৌতিক বিলের খবর মিডিয়ায় চাউর হলে সরকার ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়। সরকার নির্ধারিত ফি কিছু কিছু বড়ো হাসপাতাল না মানলে অভিযান চালিয়ে তাদের মানতে বাধ্য করা হয়। এ দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিজেদের পছন্দমাফিক নিয়মনীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। তা না হলে রোগী যখন বিল পরিশোধ করবে, তখন কেন জানতে পারবে না কোন খাতে কত টাকা ব্যয় ধরা হলো! এ নৈরাজ্যের জন্যই চিকিৎসাব্যবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে আস্থার অভাব।

এ দেশে চিকিৎসার নামে চলছে রমরমা ব্যবসা। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা তথাকথিত হাসপাতাল বা ক্লিনিক শুধু নয়, অভিজাত হাসপাতালগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য কেউ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হলেই তাকে পাঠানো হয় সিজারিয়ানের জন্য। স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের বদলে প্রসূতির জীবন নিয়ে শঙ্কার ভয় ঢুকিয়ে অস্ত্রোপচারের আশ্রয় নেওয়া হয়। এটা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

সেবাপ্রত্যাশীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ফি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনো রোগী তার রোগ নিরাময়ে বা কষ্ট লাঘবের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে প্রথমেই তাকে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ ফি প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষের যে আয় তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ আয়ের পরিমাণ বিবেচনা করলে জনপ্রতি রোগী থেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার বেশি নেয়া ঠিক নয়। চিকিৎসক তো মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নন। অতিরিক্ত আয় যাদের জীবনের লক্ষ্য, তাদের চিকিৎসাসেবা পেশায় আসা উচিত নয়।

শুধু গলাকাটা ফি-ই নয়, রোগীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই চিকিৎসক অনেক টেস্ট করাতে পরামর্শ প্রদান করেন। যদি ১০ প্রকার টেস্ট করানো হয়ে থাকে, তা হলে বেশির ভাগ টেস্টের ফলাফল থাকে নরমাল (স্বাভাবিক)। অর্থাৎ টেস্টে রোগীর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এতে সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, চিকিৎসকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টেস্ট করাতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই স্বভাবতই তাদের প্রশ্ন, কেন তারা রোগীদের অতিরিক্ত টেস্ট করাতে পরামর্শ প্রদান করেন? এক্ষেত্রে জবাব খুবই সোজা, যখন কোনো রোগী চিকিৎসকের পরামর্শপত্র নিয়ে টেস্ট করানোর উদ্দেশে কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপস্থিত হন তখন রোগীর কাছ থেকে টেস্টের ন্যায্য চার্জের দ্বিগুণ-তিনগুণ আদায় করা হয় এবং পরামর্শ প্রদানকারী চিকিৎসকের নাম-ঠিকানা নোট করে রাখা হয়। পরে রোগীর কাছ থেকে আদায়কৃত চার্জের ৪০-৫০ শতাংশ গোপনে চিকিৎসককে দিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকও নির্দ্বিধায় সে অর্থ গ্রহণ করেন! এটা কি রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের প্রতারণা বা দুর্নীতি নয়? 

চিকিৎসকদের এ প্রতারণা রোধে সরকারও নীরব। সরকার চিকিৎসকদের পরামর্শ দিলে বা সতর্ক করলে এ অবস্থা হতো না। সরকার কয়েক বছর আগে বিভিন্ন টেস্টের সর্বোচ্চ চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সে হারে পুনর্বিবেচনা করে বর্তমানে প্রচলিত চার্জ অর্ধেক হ্রাস করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেয়া এবং টেস্টের বর্তমান চার্জ অর্ধেক হ্রাস করা এখন সময়ের দাবি। ডেঙ্গু রোধে সরকার যেমন পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তেমনি সমগ্র চিকিৎসাসেবায় সব ধরনের টেস্টের চার্জ নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। নতুবা চিকিৎসার নামে ব্যবসায় জনদুর্ভোগ বাড়বেই। 

আমাদের চিকিৎসার মূল উপকরণ ওষুধ। আমাদের হাসপাতালগুলোতে বেড অনুযায়ী ওষুধ সাপ্লাই থাকে। কিন্তু রোগী থাকে সব সময়ই তার ৫ গুণ। এ বাড়তি রোগীদের ওষুধ দিতে না পারার দায় ডাক্তারদের ঘাড়েই বর্তায়। এর মধ্যে আবার কিছু অসাধু ডাক্তার, নার্স, স্টোরকিপার ওষুধ নিয়ে ব্যবসা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। প্রয়োজনমতো ওষুধের সাপ্লাই, কঠোর নীতিমালা এবং সেটার বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ওষুধের দামের ব্যাপারেও সরকারের কঠোর কোনো নীতিমালা অথবা তার প্রয়োগ নেই। এক এক দোকানি এক এক রকমের দাম রাখে নিজেদের ইচ্ছে ও সুবিধামতো। কিছু কিছু ডাক্তার আবার বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাদের ওষুধই অন্ধের মতো প্রেসক্রাইব করেন- সে ওষুধ ভালো হোক বা খারাপ, রোগীর সামর্থ্যরে মধ্যে থাকুক অথবা না থাকুক। এদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে ওষুধের মূল্য নির্ধারণেও সরকারের নজর দেয়া দরকার।

এ দেশে অভিজাত হাসপাতাল ও গুণী চিকিৎসক থাকার পরও মানুষ লাখো কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ছুটছে। এতে আমাদের স্বাস্থ্য-অর্থনীতির মারাত্মক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ব্যাপক হারে এই বিদেশপ্রবণতা আমাদের রোধ করতেই হবে। সেজন্য চাই আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানো। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, জনসাধারণের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে না।

চিকিৎসক যখন অর্থলোভী হন, তখনই ঘটে যত বিপত্তি। দুর্নাম হয় গোটা চিকিৎসক সমাজের। আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো চিকিৎসক আছেন। তবে কিছু কিছু অর্থলোভীর কারণে গোটা চিকিৎসক সমাজের বদনাম। একই কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ছুটে যান প্রতিবেশী ভারতে। ভারতে যাওয়ার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে- বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ আর রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে অনেকটা সন্তুষ্টি। বিশেষ করে ডায়াগনস্টিক বিষয়ের প্রতি রয়েছে আস্থা। অনেকের অভিমত, চিকিৎসার নামে হয়রানির শিকার হতে হয় না। একটি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো হয় না। চিকিৎসকরা রোগীকে যথেষ্ট সময় দেন। রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে রোগের বিষয়ে খোলামেলা এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলেন। চিকিৎসাসংক্রান্ত খরচও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। এসব কারণে চিকিৎসাব্যবস্থায় বাংলাদেশিদের কাছে ভারতনির্ভরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় যেসব রোগ বাসা বেঁধেছে, তার জন্য ডাক্তাররা এককভাবে যে দায়ী তা নয়। স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দে অপ্রতুলতা, অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও জনবলের ঘাটতি এ সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির বরাদ্দ কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন হলেও, বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ মাত্র। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসার সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র সীমিত, ডাক্তারসহ অন্যান্য লোকবলও সীমিত। ফলে সত্যিকারের সেবাদান আসলেই সম্ভব হচ্ছে না।

এ দেশে অভিজাত হাসপাতাল ও গুণী চিকিৎসক থাকার পরও মানুষ লাখো কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ছুটছে। এতে আমাদের স্বাস্থ্য-অর্থনীতির মারাত্মক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ব্যাপক হারে এই বিদেশপ্রবণতা আমাদের রোধ করতেই হবে। সেজন্য চাই আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানো। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, জনসাধারণের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে না।

তাই চিকিৎসার পণ্যায়ন নয়, একটি মানবিক ও দায়িত্বশীল পরিষেবা হিসেবে বিকশিত হোক আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা। আমাদের ডাক্তাররা হয়ে উঠুক রোগীবান্ধব ও মানবিক চিকিৎসক। এক্ষেত্রে সরকারকেও পালন করতে হবে কার্যকর ভূমিকা। অতএব শুধু ডেঙ্গু প্রতিরোধই নয়, সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থাতেই সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা রইল।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন