• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০১৯, ০৫:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১০, ২০১৯, ০৫:৫০ পিএম

ঈদযাত্রা, শৈশবের গ্রাম ও ঢাকার অন্তঃসারশূন্যতা

ঈদযাত্রা, শৈশবের গ্রাম ও ঢাকার অন্তঃসারশূন্যতা

 ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে শেকড়ের টানে ফিরছে  মানুষ । নিজ গ্রামে গিয়ে স্বজনের সাথে ঈদ করতে সবাই ছুটছে গ্রামে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এ দুই ঈদে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে মানুষ যায় প্রাণের মানুষদের সাথে মিলিত হয়ে উৎসব করতে। কিন্তু প্রতিবারেই ঘরমুখো মানুষের ভিড় যেমন থাকে তেমনি থাকে ভোগান্তি। এ যেন নিয়ম হয়ে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কথার সাথে কাজের কোন মিল নেই। তারা ঈদের আগে বলে ঈদের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীর বাসস্ট্যান্ড ও কাউন্টারগুলোতেও  ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে লোকজন এখন বাস কাউন্টারগুলোর দিকে ছুটছে। ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা পুরোদমে শুরু হওয়ায় সব সড়ক ও মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। 

দুই.
রাজধানীর সায়েদাবাদে শুক্রবারের চিত্র ছিল খুবই অস্বাভাবিক। সকাল থেকেই গরুর ট্রাক আর মানুষের ভিড়ে ঢোকা যাচ্ছিল না সায়েদাবাদে। কি অস্বাভাবি ভিড় আর এলোমেলোভাবে গাড়ির চলাফেরা তাতে যেকোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে যেকোন দুর্ঘটনা। কিন্তু দেখার কেউ নেই। বাস কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখলাম কোন টিকেট নেই । ওসব কাউন্টারের বাস দাঁড়িয়ে উঁচুদরে যাত্রী হাঁকছে। আমি শায়েস্তাগঞ্জের টিকেট চাইলে বলল টিকেট নেই। পরে সিলেটের টিকিট কিনেছিলাম নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি টাকায়। এ অভিযোগ কার কাছে করব, এমন কোন লোক চোখে পড়েনি। এত বড় একটা উৎসবকে ঘিরে কত মানুষ ঢাকা ছাড়ছে আথচ কোও কোন শৃঙ্খলা নেই। কে থাকবেনা? আমাদের সংকট কোখায়? আম ঢাকায় বাস করি এই দুইযুগের বেশী সময়। সব ঈদযাত্রার চরিত্র এক। যাত্রী ভোগান্তি কত চরমে উঠতে পারে তা বলার না। গত বছর ঈদুল ফিতরে আমার এক অফিস সহকারি মেহেন্দীগঞ্জ রওয়ানা হয়েছিলো ঈদের ১ দিন আগে। ঈদের দিন সে লঞ্চ পেয়েছিলো বরিশালের। তারপরদিন বাড়ি পৌঁছেছিলো। এই দুর্ভোগেরকোন ব্যাখ্যা মিলবে?

আমরা যখন গ্রামে ছিলাম আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময়ে অপেক্ষা করতাম কবে ঢাকার লোকজন আসে। সুন্দর পোশাক পরা আমাদের চেয়ে পরিচ্ছন্ন ছেলেমেয়েরা আসত শহর থেকে। আমরা তাদের সাথে মিলেমিশে খেলাধুলা করতাম। আমরা যেকোন বিষয় স্বতঃস্ফূর্ত ছিলাম তারা অতটা ছিল না। ফলে আমাদের ভাবনায় ছেদ ঘটত। আমাদের ধারণা ছিল ঢাকা শহরে যারা থাকে তারা সব জানে, সব পারে। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। তবে আমাদের সমসাময়িক যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত তাদের আমরা অনেক সমীহ করতাম। আমাদের তখন ধারণা ছিল যারা ইংরেজী পড়ে তারা অনেক বেশি শিক্ষিত, অনেক বেশি জান্তা । তারা অন্যদের মতো আমাদের সাথে মিশত না।আমরা যেমন ফুল-গুল্ম, লতাপাতা কাদা জল, বৃষ্টির মধ্যে বেড়ে উঠতাম। বৃষ্টি নামলে বল নিয়ে মাঠে নামতাম। কাদামাখা শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম খারের জলে, ঢাকা থেকে আগত বন্ধুরা এসব দেখে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকত। ওদের বাবা মা-রা ওদের সাবধান করতেন, পানি লাগাবে না জ্বর হবে। খালি পায়ে বের হবে না, পায়ে জীবাণু ঢুকবে। ওদের মা ওদের খাইয়ে দিত দেখে আমরা অবাক হতাম। আমাদের শহুরে বন্ধুরা আমাদের দেখিয়ে বলত, ওরা যে বৃষ্টি ভিজে, খালি পায়ে চলে। ওদের বাবা-মারা বলত- ওরা তো গ্রামের ছেলে । ওরা কি ঢাকায় থাকে? তোমাদের মতো ভালো স্কুলে পড়ে? এত ভাল খাবার খায়? 

মূলত আমরা ছোটলোক এমনভাবেই আমাদের দেখানো হতো। আমরা তখোন বুঝতাম না। ওরা ফুল দেখে বিস্মিত হতো। ফুল দিলে খুব খুশি হতো। যদিও আমরা অবাক হতাম। আমাদের বাড়িতে ফুলের বাগান, পথ চলতে কত বনফুল, কি দারুণ পাখির ডাক। এসবে অবাক হওয়ার কি আছে? ওদের বিস্ময় দেখে আমরা মজা পেতাম। ভালো লাগত। ওরা ঢাকায় থাকে, ওরা আমাদের বন্ধু ভাবতে আমাদের যারপরনাই ভালো লাগত। চলে যাওয়ার আগে ওরা খুব কাঁদত। ওদের বাবা-মায়েরা খুব বোঝাত। ওদের যাওয়ার দিন আমাদের কান্না পেত। তবে একটা বাস্তবতা এখন টের পাই, যা আগে পেতাম না। ঢাকায় ওদের যে জীবন তাকে আমরা বড় ভাবলেও আসলে কিছুই ছিল না। ওরা আমাদের সাথে মিশতে পারত না।আমরা দেখেছি  ভর্তি পরীক্ষায় ওরা আমাদের সাথে টিকত না। আমাদের সেসব বন্ধুরা ভালো কোন জায়গায় টেকেনি।

এখন সেটা বুঝতে পারি। ঢাকা শহরের জীবন তাদের আসলে কিছুই দিতে পারেনি। এ শহর অন্তঃসারশূণ্য। এদের অভিভাবকরা  গ্রাম থেকে এসে  ছেলে- মেয়েকে বাসার আসপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ইলিংশ মিডিয়াম বা বাংলা স্কুলে পড়ায়। অনেক বইয়ের ভিড়ে আর স্কুলের টাস্ক করতে করতে তারা জীবনকে হারিয়ে ফেলে। এটা তাদের শিক্ষরাও বোঝে না,তাদের বাবা-মাতো নাই। তবুও বাবা-মা দুলাইন ইংরেজী শুনে বিগলিত হয়। বন্ধুদের কাছে গল্প করে, ‘আমার মা’তো ইংরেজী জানে না। ‘আমার মেয়েটা আমাকে বলে আব্বু তোমার মা সো মাছ আন স্মার্ট’ এসব বলে তারা গর্ববোধ করে। তারপর যখন ছেলে -মেয়েরা কোন ভালো ইনস্টিটিউটে ঢুকতে পারে না তখন বিপাকে পড়তেই হয়। সেটা অনেক আলোচনার ব্যাপার । তবে ঢাকার শিক্ষা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্তঃসারশূণ্য সেটা সবার জানা। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যালসহ বড় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মফস্বলের কাদামাখা ছেলে- মেয়েরাই বেশী সুযোগ পায়। এ কথাগুলো ভাবতে পুরনো অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে। 
তারপরও ওরা যেত এটাই বড় আনন্দ ছিল। আজকে গ্রামের সে পরিবেশ নেই। তবু গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা এখনো বদলায়নি। এখনও ঢাকার ছেলে -মেয়েরা যায়। গ্রামের রাস্তা এখন পাকা,গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারে। হিজলের বন,বনফুল নদীর স্বরলিপি দেখে বিস্মিত হয়। অনেক কষ্ট করে পথ পাড়ি দেয়। আবার চলে আসে। ওদের আসা-যাওয়ার ভেতরে আমি আমার শৈশবকে খুঁজি। এসব উৎসবে রাজনীতি ঢুকে যাওয়া, পশু জবাইয়ের প্রতিযোগিতা, ফ্রিজের বিক্রি বাড়া , দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ  সব ছাপিয়েআমাদের ঈদের সেই অপেক্ষা ভাবতেই আজও আন্দোলিত হই। আজও শৈশবের সেই দিনগলো চোখের চতুষ্কোণে হানা দেয়।

তিন.

 আমার শৈশবকাল থেকে অপরিবর্তিত থেকেছে ঈদের আগের যাত্রা ভোগান্তি। ভাঙাচোরা সড়ক, দুর্বল রেললাইন- । ঈদের সপ্তাখানেক আগে টাকা খরচ করে ঠিক করার চেষ্টা। বৃষ্টি ধোয়া পিচের মরনফাঁদতু্ল্য সড়কটি আজও আগের মতোই থাকে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ যথাসময়ে ছাড়ে না এখনও। ফলে ঘরে ফেরা মানুষদের দুর্ভোগে পড়তে হয়।ঈদ যাত্রায় ভোগান্তির শেষ নেই। সব অকিল আগের মতোই আছে । এসব ভোগান্তির কারণে আমাদের যেসব বন্ধুরা গ্রামে যেত তারা বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে অসুস্থ হয়ে যেত । ওরা যে কত কষ্ট করে বাড়ি যেত এখন বুঝতে পারি। এবং আরো যে বাস্তবতা বুঝি তা হলো এত বছরে একটা রীতি না বদলানোর মতো দেশে আমরা বাস করি।

ঈদ মৌসুমে নৌপথে আনফিট যান রুটে নামানো, লঞ্চ-স্টিমারে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নৌদুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঠেকানো, সময়সূচি ঠিক রাখা এবং টার্মিনাল ও নৌপথের নিরাপত্তায় বিআইডব্লিউটিএসহ সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন।কারন এ সংকট বহু পুরানো। এতদিন একটি সংকট টিকে থেকে অযুত মানুষের জীবনের ঝুঁকির কারণ হবে এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রতিবার দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বক্তৃতা শুনি। পরে দেখি পরিস্থিতি অবিকল আগের মতোই রয়ে গেছে । শুধু মাননীয় বক্তব্যই সার।  পথের দুর্ভোগ-দুর্ঘটনায় কারো ঈদের আনন্দে যেন বিষাদের কালিমা না পড়ে- এটাই আমাদের চাওয়া। এর জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবহন সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। তবে প্রতিবছর ঘরমুখো মানুষের এ দুর্ভোগ মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।

লেখক: সাংবাদিক