• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০১৯, ০৫:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৪, ২০১৯, ০৫:১৬ পিএম

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

প্রথম প্রহরের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ

প্রথম প্রহরের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ

১৫ আগস্ট ১৯৭৫,  বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সবগুলো ফ্যাকাল্টি চত্বর ঘুরবেন এবং শেষে টিএসসি মিলনায়তনে একসভায় উপস্থিত  শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের উদ্দেশে বক্তৃতা করবেন। এই উপলক্ষে গোটা ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছিল সুন্দর করে। মাইক লাগানো হয়েছিল কার্জন হলের শেষ মাথা থেকে শুরু করে সাইন্স অ্যানেক্স ভবন, শহীদ মিনার, এসএম হল, কলাভবন, নীলক্ষেত জুড়ে। 
মাইকে গান, কবিতা, বাদ্যযন্ত্রের সুর বাজতে ছিল, সঙ্গীতের আবহে সৃষ্টি হয়েছিলো এক আনন্দঘন পরিবেশের। শুধু টিএসসি হলের ভেতরের মানুষরাই না, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা যেন শুনতে পারেন হাইকোর্টের মোড় থেকে চানখারপুল, পলাশী ও নীলক্ষেত পর্যন্ত।  রাস্তায় সমবেত লাখো মানুষ, সেজন্য গোটা এলাকায় লাউড স্পিকারের হর্ণ লাগানো হয়েছিল। 
সারারাত জেগে এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কাজ তদারকি ও সারারাত জাগা পাহারা শেষ করে কলা ভবনের সামনের সবুজ চত্বরে আধো-আলো আধো-আঁধারে বসে সকাল ১০টা থেকে শুরু হতে যাওয়া কর্মসূচির প্রস্তুতি কাজের শেষ দফা পর্যালোচনা করছিলাম আমরা কয়েকজন। আমার সাথে ছিল মাহবুব জামান, ইসমত কাদের গামা, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত, রবিউল আলম, কামরুল আহসান খান প্রমুখ। রাত ২টা পর্যন্ত শেখ কামালও আমাদের সাথে ছিল। কাজ অনেকটা কমে আসায় সে তখন আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল ৩২ নম্বরের বাসায় চলে যেতে। কথা দিয়েছিল যে, সকাল ৮টার মধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে আসবে। 

ভোর হয় হয়, এমন সময় দূর থেকে শুনতে পেলাম একাধিকক্রমে অনেকগুলো বিস্ফোরণের শব্দ। সাথে আরো কিছু গোলাগুলির আওয়াজ। সেই আওয়াজ থেমে-থেমে বহুক্ষণ ধরে চলছিল দু’জন কর্মীকে খোঁজ আনতে পাঠালাম। তারা ফেরার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী এসে রেডিও’র ঘোষণার খবর জানালো। আমরা জানলাম, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় চালানো হয়েছে দেশদ্রোহী ঘাতক দলের এক নারকীয় অভিযান, বাস্তবায়ন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার এক সুপরিকল্পিত দেশি-বিদেশি চক্রান্তের নীল নকশা। কার্যকর করা হয়েছে সিআইএ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের অনুচরদের দ্বারা সংগঠিত এক বর্বর হত্যাকাণ্ড ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। 

ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়লেও হতবিহ্বল না হয়ে কী করতে হবে তা কলা ভবনের চত্বরে দাঁড়িয়েই তৎক্ষণাৎ স্থির করে ফেলি। মূল ছাত্রনেতারা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে এবং তারা যেন একটা যোগাযোগের মধ্যে থাকে, তার ব্যবস্থা করে গামা, মাহবুব, অজয়, রবিউলকে নিয়ে হাতিরপুল এলাকায় মফিদুল হকের বাসায় এসে উঠি। সেখানে যাওয়ার পথে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামকে আমাদের সাথে নেয়ার জন্য তার বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে ওঠাই। তাকে নিরাপদ গোপন আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দেই। তিনি অবশ্য আমাদের সাথে আসেননি। 

মফিদুলের বাসায় বসেই আমরা ৫/৬ জন এদিক-সেদিক যথাসাধ্য যোগাযোগ করে ছাত্র সংগঠক-কর্মীদের সাথে একটা সংযোগ দাঁড় করিয়ে তাদেরকে নির্দেশের জন্য তৈরি থাকতে বলি। একই সাথে রেডিও’র খবর থেকে পরিস্থিতির গতিধারা অনুসরণ করতে থাকি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথেও সংযোগ স্থাপন করি। কিশোরগঞ্জসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে রেডিও’র খবরের সাথে সাথে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়ে যায়। সেসব প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাহসী নেতা-কর্মীরা। রাজধানীতেও মিছিল করার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হত্যাকারীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাদের অবস্থানকে সুসংহত করতে সক্ষম হয়। দুপুরের আগেই একে একে তিন বাহিনীর প্রধান বক্তৃতা করে খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। মাত্র ৪/৫জন বাদে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সব সদস্যরাও একের পর এক খুনির মোশতাকের সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে থাকেন। মন্ত্রীহিসেবে শপথ না নেয়া সেই ৪/৫ জনের সঙ্গেও তখন  যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

দুপুরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা তেমন আর নেই। আমরা বুঝতে পারি যে, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি এক রক্তক্ষয়ী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সফল করতে পেরেছে এবং সাময়িকভাবে হলেও তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ায় ফলেও তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা প্রায় সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। 

এই অবস্থায় সেদিনই হাতিরপুলের সেই বাসায় বসেই আমরা বুঝতে পারি যে, এই রাজনৈতিক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রতিরোধ সংগ্রামকে কিছুটা দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতিও পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে হবে। আমরা তাই ঠিক করি যে, কিছুটা পরিমাণ প্রস্তুতি নিয়ে, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই আমাদের এই সংগ্রামের সূচনা করতে হবে। আমরা সেদিন সেখানে বসেই ঠিক করি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস যেদিনই এরপর শুরু হবে সেদিনই আমরা ক্যাম্পাসে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করব। সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এই জন্য দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়ে আমরা সন্ধ্যার পর নিজের নিজের নিরাপদ আশ্রয়স্থানে চলে যাই। নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ব্যবস্থাও তার আগে আমরা ঠিক করে নিই। 

কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ গোপন অবস্থানে থেকে আমাদেরকে উৎসাহ ও পরামর্শ দেন। পার্টির প্রায় সব স্তরের নেতাই আত্মগোপনে চলে যান। আমি আধা-আত্মগোপনে থেকে প্রকাশ্য তৎপরতার তদারকি করতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি ছোট লিফলেট ছাপাই। ক্যাম্পাস ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় এবং ঢাকা শহরের প্রধান কয়েকটি অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে অফিস চলাকালে এই লিফলেট আমরা বিতরণ করি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনজুরুল আহসান খানের চামেলীবাগের বাসা থেকে কয়েকটি টিম লিফলেট বিলির এই কাজ চালায়। লিফলেট বিলি করতে গিয়ে খায়রুল, সিদ্দিক, মাহবুব, শাহ জামাল, দানিয়াল, মুন প্রমুখ কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মী এজিবি অফিস চত্বরে হামলার সম্মুখীন হন এবং তাদের মধ্যে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কাজল ব্যানার্জি, শওকত হোসেন প্রমুখ গ্রেফতার হয়ে যান।

এসব কাজের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাড়ায় এবং জেলাগুলোতে আমরা ক্রমেই যোগাযোগ নিবিড় করার ব্যবস্থা নিই। অনেকের কাছেই সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে, কর্মীদের সাহসী ও সংহত রাখার কাজে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠাই। পোস্ট কার্ডে জেলার নেতাদের এভাবে লেখা হতো- ‘তোমরা বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ো না। সংসারকে আবার দাঁড় করাতে হবে। ভাইবোনদের মানুষ করতে হবে। বিপদের মধ্যে মাথা ঠিক রেখে চলবে। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাবে...’ ইত্যাদি ধরনের কথা। সবাই এসব কথার মমার্থ বুঝে নিতে পারত। 

জেলায় জেলায় যোগাযোগ গড়ে তোলার সাথে সাথে ঢাকায় আমরা ক্রমেই গোপন ও আধা গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে থাকি। পুরোনো ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাসা আমরা এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার উপযোগী করে তুলি। এই কাজে কামরুল আহসান খান ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে। ধীরে ধীরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বিস্তৃত হতে থাকে। কাজী আকরাম, আনোয়ারুল হক, ওবায়দুল কাদের, মমতাজ হোসেন প্রমুখ বন্ধুদের যুক্ত করে আমরা আরো বড়ো পদক্ষেপের দিকে অগ্রসর হই। 

আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিনে ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’,- এই ধরনের স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসের কলা ভবনের করিডোরে ‘জঙ্গি ঝটিকা মিছিল’ করি। মাহবুব জামান কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ, এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। আমি এবং ইসমত কাদির গামা ক্যাম্পাসের পাশেই একটা বাসায় বসে এই কর্মসূচির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি এবং কর্মসূচির বাস্তবায়নের কাজ তদারকি করি। এই মিছিলের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কর্মীরা সাহস পায় কিন্তু জাসদপন্থী ছাত্ররা মরিয়া হয়ে ভয়-ভীতি-হুমকি দেয়া শুরু করে। হলে হলে হামলা শুরু হয়। 

‘মুজিবের দালালরা হুঁশিয়ার’ স্লোগান দিয়ে ও আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে তারা ক্যাম্পাসে পাল্টা মিছিল করে। আমরা কয়েকদিন চুপ করে থাকি। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকি। কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে এক সাথে কয়েকটি ক্লাসরুমে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি আহবান জানানোর কর্মসূচি সফল করি। 

অক্টোবরের শুরুতেই আমরা পরিকল্পনা নিই যে, খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ নাগরিকসহ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অভিমুখে মৌন মিছিল করব। এটাই তখন আমাদের একটা প্রধান কাজের বিষয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে নানাভাবে প্রস্তুতি চলতে থাকে। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে দেখা করি এবং এই মৌন মিছিলে শামিল থাকার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। তাঁরা প্রায় সবাই আমাদেরকে উৎসাহিত করেন। এ মৌন মিছিলের তারিখ অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত হয়। পরে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আরো সময়ের কথা ভেবে, তা ৪ নভেম্বর পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ২/৩ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে ৪ নভেম্বর ‘মৌন মিছিল’-এর প্রস্তুতি। 

ইতোমধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা কারারুদ্ধ হন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি চলছিল। একটি অংশ মোশতাকের পক্ষে দলকে টেনে আনতে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট ছিল। কেউ কেউ তাদের সাথে সরাসরি হাত মিলিয়ে বলা শুরু করলো যে, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আমেরিকাকে চটিয়ে, ইসলামপন্থীদের ক্ষেপিয়ে, সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটিয়েছেন।’ 

আরেক অংশ (তারা সংখ্যায় খুব কম নয়) বলা শুরু করলেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিগুলোর কারণেই তাকে জীবন দিতে হলো। এ ধরনের নীতি আসলে তাঁর গ্রহণ করার উচিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভুলের পরিণতিই হলো এই হত্যাকাণ্ড। তাই এখন আওয়ামী লীগের নীতিকে দক্ষিণপন্থী নীতির দিকে ঢেলে সাজাতে হবে।’ তারা ব্যস্ত ছিল এসব নিয়ে। 

আরেকটি অংশ অবশ্য বঙ্গবন্ধুর নীতির দৃঢ় সমর্থক ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই যদিও প্রাথমিক ভয়-ভীতির কারণে শুরু থেকে সাহস করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে আসতে পারেনি, কিন্তু ক্রমেই তারা সক্রিয় হতে শুরু করেন। আনোয়ার চৌধুরী, খন্দকার ইলিয়াস, নুরুল ইসলাম, শামসুদ্দিন মোল্লা, একলাস উদ্দিন, ডা. এসএ মালেক, এসএম ইউসুফ প্রমুখ নেতারা শুরু থেকেই আমাদের এই প্রতিরোধ প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন। তাদের কাছ থেকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা সবসময় পেয়েছি। অবশ্য, সবচেয়ে সংগঠিত ও মূল্যবান সহযোগিতা আমরা লাভ করেছি কমিউনিস্ট পার্টির নিকট থেকে। ন্যাপও আমাদেরকে সাহায্য করেছে।

অক্টোবর মাসে খুনি মোশতাক আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সদস্যদের নিয়ে সভার ব্যবস্থা করেন। সংসদ সদস্যদের সমর্থন আদায় করাই এই সভার উদ্দেশ্য বলে আমরা জানতে পারি। এই অপচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য কিছু করা দরকার বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। খুব দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে কঠোর ও হুমকিমূলক ভাষায় একটি ইশতেহার ছাপিয়ে (সাইক্লোনস্টাইলে) আমরা মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের কাছে সেটি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য সেদিন মোশতাকের এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে খুব দৃঢ় ও সাহসী ভুমিকা পালন করেন। 

যাই হোক, ৪ নভেম্বর মৌন মিছিলের প্রস্তুতি যখন সবদিক থেকে শেষ পর্যায়ে, তখন ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফ-এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। আমাদের কাছে এই ঘটনা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেই যে, এই অবস্থার মধ্যেও আমরা আমাদের মৌন মিছিলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব। ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে কালো পতাকা হাতে দুই লাইনে মৌন মিছিল শুরু হওয়ার আগে আমরা সভাপতিত্বে (আমি তখনও ডাকসুর ভিপি অনুষ্ঠিত এই বিশাল সমাবেশের উদ্দেশে আমি বক্তৃতা করি। তারপরে শুরু হয় মৌন মিছিল। 

নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির কাছে আসতেই পুলিশ আমাদের পথ আটকায় এবং বেশ কিছুক্ষণ পুলিশের সাথে আমার তুমুল তর্কবিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে। ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাসায় মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় স্থানে স্থানে সেনাবাহিনীকে পজিশন নেয়া অবস্থায় আমরা দেখতে পাই। নীরব মিছিল নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির বন্ধ গেটে এসে গেটের সামনে মিছিলের অগ্রভাগ পৌঁছার পর, সকলের পক্ষ থেকে আমি প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। ক্রমান্বয়ে মিছিলের সমবেত অন্যরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন অজ্ঞাত মওলানা সাহেব মোনাজাত করেন। সকলে দু’হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হন। 

আবেগ-আপ্লুত এই অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে দেই। মৌন মিছিল তখন সরব হয়ে ওঠে। ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে সরব মিছিলসহ আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। 

সকাল থেকেই গুজব শুনছিলাম যে, জেলখানায় নাকি কিছু একটা ঘটেছে। সরজমিনে খবর নেয়ার জন্য ক্যাম্পাসে থাকাকালেই কয়েকজন কর্মীকে জেল গেটে পাঠিয়েছিলাম। মৌন মিছিলে থাকা অবস্থাতেই তারা এসে জেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, সম্পর্কে আমাদেরকে নিশ্চিত করেন। সাথে সাথে বিকেলে শহীদ মিনারে সমস্ত কর্মীকে সমবেত হওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা দিই। ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের অধিবেশনে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করে জেল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মসূচির প্রস্তুতি শুরু করে দিই। মাহবুব জামান, ইসমত কাদের গামা প্রমুখকে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশনে যেতে বলি। তারা সিনেট অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণের দাবি জানায়। শোক প্রস্তাব গ্রহণের পর, আমাদের দাবি অনুযায়ী সিনেট সভা মুলতবী হয়ে যায়। 

বিকেলে শহীদ মিনারে নির্ধারিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশ থেকে জেল হত্যার প্রতিবাদে পরদিন সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করি। মাইকসহ কর্মীরা হরতালের প্রচারে নেমে পড়ে। ঘাতক চক্রের সৃষ্ট বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যেও ৫ নভেম্বর ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। দেয়ালের চত্তুরের পাশে যেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হক প্রমুখের কবর রয়েছে- সেখানে জেলখানায় নিহত শহীদ ৪ নেতাকে দাফন করার লক্ষ্য নিয়ে সেখানে ৪টি কবর খুঁড়ে রাখার ব্যবস্থা করি। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে ৪ নেতার লাশ হস্তান্তর করতে দেয়নি। আমরা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করি। হাজার হাজার মানুষ সেই জানাজায় শরিক হয়। মানুষ সাহসী হয়ে উঠতে শুরু করে। বাতাস আবার ঘুরতে শুরু করে। 

ঘাতকদলের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে থাকে কিন্তু সেই পথে ঘটনা আর বেশিদূর আগানোর সুযোগ দেয়া হয়নি। এসব ঘটনা ঘটার ৪৮ ঘণ্টার মাথায় ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে আসে আরেক নতুন মাত্রিকতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার পথে উপস্থিত হয় প্রতিবন্ধক এক নতুন পরিস্থিতি। 

সামরিক শাসনের দীর্ঘকালীন সেই নতুন পটভূমিতে সংগ্রামে এগিয়ে নেয়ার জন্য গ্রহণ করতে হয় নতুন পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। কিন্তু সেটি ভিন্ন আরেকটি বড়ো কাহিনী।  সেটা আরেক দিন বলা যাবে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি