• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০১৯, ০৫:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৪, ২০১৯, ০৭:৪৫ পিএম

স্মৃতির পাতায় জাতির জনক ও আজকের বাংলাদেশ

স্মৃতির পাতায় জাতির জনক ও আজকের বাংলাদেশ

পনেরোই আগস্টের কালরাত্রিতে শাহাদতবরণকারী সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতক খুনিচক্র স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতিকে। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সব অর্জনকে। এদিন শুধু জাতির জনককেই হত্যা করা হয়নি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও লক্ষ্যকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নপূরণের নেতৃত্বকে হত্যা করা হয়েছিল।

ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোনো উত্তরাধিকার যেন বেঁচে না থাকে। আর সেজন্যই ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র দশ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশ থাকায় সেদিন ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পান। আজ গর্ব করে বলতে পারি, ষড়যন্ত্রকারী খুনিচক্রের সেই আশা সফল হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে।

বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে আসে। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমন্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’

এর পর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হন। সে সময় বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে তন্মধ্যে অন্যতম ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’। এই ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলাম। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এর পর গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকালে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসঙ্গে চা পান করতেন। এর পর রাত ৮টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসঙ্গে, ফিরতামও একসঙ্গে। গণভবনে যেখানে বঙ্গবন্ধুর অফিস, সেখানে তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করতেন। গণভবনের পাশে এখন যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষের পাশেই আমার দপ্তর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগ্মসচিব জনাব মনোয়ারুল ইসলাম এবং ব্যক্তিগত সচিব জনাব ফরাসউদ্দীন এই দু’জন পিএইচডি করতে বিদেশ যাবেন এ উপলক্ষে কর্মকর্তাদের নৈশভোজ। নৈশভোজ শেষে তাদের বিদায় করে আমি আবার ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সঙ্গে তোর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবি।’ আমার আর প্রিয় নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।

পরদিন ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় এজেন্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্য জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ভোর থেকেই দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হত্যাকান্ডের পর পরই আমাকে প্রথমে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দি করা হয়। ধানমণ্ডির যে বাসায় আমি থাকতাম সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বাসায় কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হয়নি। দুদিন পর ১৭ তারিখ খুনিচক্রের অন্যতম ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল সদস্য আমার বাসভবন তছনছ করে। ঘরের দেয়ালে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো ভেঙে ফেলে। মায়ের সামনেই হাত-চোখ বেঁধে আমায় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনিচক্রের সমর্থনে সম্মতি আদায়ে উপর্যুপরি নির্যাতন চালায়। তখনো জেনারেল শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল ব্রিগেড কমান্ডার। তাদের হস্তক্ষেপে আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

এর পর ২৩ তারিখ ই এ চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমাকে এবং জনাব জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক তার অবৈধ সরকারকে সমর্থন করার জন্য আমাদের দুজনকে প্রস্তাব দেয়। আমরা খুনি মোশতাকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ জিল্লুর রহমান, আমাকে ও আবদুর রাজ্জাককে (শ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক) একইদিনে গ্রেপ্তার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমাদের সঙ্গে আর একজন বন্দি ছিলেন। তিনি ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত জনাব আবিদুর রহমান।

পুলিশ কন্ট্রোল রুমের একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে পাশাপাশি দুটি চৌকির একটিতে ঘুমাতাম আমি ও রাজ্জাক ভাই এবং অপরটিতে জিল্লুর ভাই ও আবিদুর রহমান। একদিন রমজান মাসের তিন তারিখ রোজা রেখে নামাজ পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতের দিকে সেনাবাহিনীর একদল লোক কক্ষে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘হু ইজ তোফায়েল’ ‘হু ইজ তোফায়েল!’ রাজ্জাক ভাই জেগে উঠে আমাকে ডেকে তোলেন। চোখ মেলে দেখি আমার বুকের ওপর স্টেনগান তাক করা। আমি অজু করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হয়। কক্ষের সঙ্গেই সংযুক্ত বাথরুম। অজু করে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আবিদুর রহমানের সামনেই আমার চোখ বেঁধে বারান্দায় নিয়ে হাত বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আমি অনুভব করি আমাকে রেডিও স্টেশনে আনা হয়েছে। এর পর হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায়ই চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে অনেকগুলো প্রশ্ন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু কী করেছেন, তার কোথায় কী আছে এ রকম বহু প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় ভীতি প্রদর্শন করে খুনিরা বলে, ‘ইতোমধ্যে আমার এপিএস শফিকুল আলম মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সে আমার বিরুদ্ধে ৬০ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে।’ আমি নিরুত্তর থাকি। শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু যা ভালো করেছেন আমি তার সঙ্গে ছিলাম, যদি কোনো ভুল করে থাকেন তার সঙ্গেও ছিলাম। এর বেশি কিছুই আমি বলতে পারব না।’ তখন তারা চরম অসন্তুষ্ট হয়ে পুনরায় আমার ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। ভয়াবহ সেই নির্যাতনের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। এর পর অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। সেখানে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদকারীদের মধ্যে খুনি ডালিমের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট চিনতে পেরেছিলাম। আমাকে রুমের মধ্যে একা রেখে তারা মিটিং করছিল আমাকে নিয়ে কী করবে। অজ্ঞাত একজন আমার মাথায় হাত রেখে শুধু বলছিলেন, ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন।’ তার ধারণা হয়েছিল ঘাতকের দল আমাকে মেরে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত ঘাতকরা এসে বলল, ‘আমরা যে প্রশ্নগুলো করেছি তার উত্তর দিতে হবে; উত্তর না দিলে আপনাকে আমরা রাখব না।’ নিরুত্তর থাকায় পুনরায় তারা আমাকে নির্যাতন করতে থাকে এবং একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন ঘাতক দল পুলিশ কন্ট্রোল রুমের যে কক্ষে আমরা অবস্থান করছিলাম সেই কক্ষে রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইয়ের কাছে আমাকে অজ্ঞানাবস্থায় রেখে আসে। জ্ঞান ফিরলে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি। শারীরিক অসহ্য ব্যথা নিয়ে যখন আর্তনাদ করছি তখন জিল্লুর ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমার এ অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তারা দুজনেই সেবা-শুশ্রুষা করেন। এর পর সিটি এসপি সালাম সাহেব ডাক্তার নিয়ে আসেন। এ অবস্থার মধ্যেই রাতে মেজর শাহরিয়ার আমার কাছ থেকে লিখিত বিবৃতি নিতে আসে। তিনি আমাকে বলেন, ‘যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তার লিখিত উত্তর দিতে হবে।’

আমি মেজর শাহরিয়ারকে বললাম, ‘আপনারা আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন দিতে পারেন; আমি কোনো কিছু লিখতেও পারব না, বলতেও পারব না।’ ওরা যখন দেখল আমার কাছ থেকে কোনো বিবৃতি আদায় করা সম্ভবপর নয়; তখন তারা উপায়ান্তর না দেখে চলে যায়। পরদিন অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফাঁসির আসামিকে অন্ধকার নির্জন প্রকোষ্ঠে যেভাবে রাখা হয় ময়মনসিংহ কারাগারে আমাকেও সেভাবে বন্দি করে কনডেম সেলে রাখা হয়। তিন মাস আমি সূর্যের আলো দেখিনি। আমার সঙ্গে তখন কারাগারে বন্দি ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানসহ অনেকে। সে দিনগুলোর কথা যখন স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে তখন চিন্তা করি কী করে সেসব দিন অতিক্রম করেছি। এর পর ২০ মাস ময়মনসিংহ কারাগারে অবস্থানের পর ’৭৭-এর ২৬ এপ্রিল আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

কুষ্টিয়া কারাগারে আটকাবস্থায় ’৭৭-এর ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক সেকশন অফিসার কর্তৃক ব্যাকডেটে স্বাক্ষরিত অর্থাৎ ’৭৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করা আটকাদেশের সত্যায়িত কপি আমার কাছে প্রেরণ করা হয়। আটকাদেশের সত্যায়িত কপি প্রাপ্তির পর আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমার পক্ষের আইনজীবীরা (যারা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে মাত্র ১ টাকা ফি নিয়েছিলেন) সর্বজনাব সিরাজুল হক, এএইচ খোন্দকার, সোহরাব হোসেন, সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত- আদালতে বলেন, ‘তার আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং ১৯৭৫ সালের জরুরি ক্ষমতা আইনের আওতায় তার আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। ফলে ওই আটকাদেশ অবৈধ ও আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত।’

বিচারপতি জনাব কেএম সোবহান এবং বিচারপতি জনাব আবদুল মুমিত চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ’৭৮-এর ৯ জানুয়ারি এক রুল জারি করেন। রুলে বলা হয়, ‘কারাগারে আটক জনাব তোফায়েল আহমেদকে কেন আদালতের সামনে হাজির করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হবে না’ সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও অন্যদের কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে। রাজ্জাক ভাই এবং আমার একসঙ্গে রিট হয়। রাজ্জাক ভাই হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাইনি।

অবশেষে সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে মুক্তি পেলাম ৪ মাস পর অর্থাৎ ’৭৮-এর ১২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাসসহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দি থাকার পর মুক্তি লাভ করি। কুষ্টিয়া কারাগারে যখন বন্দি তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় এবং কারাগারে আটকাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই।

স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে আক্রমণ হয়েছে। সেসব উপেক্ষা করে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে দলকে সংগঠিত করেছি, নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সামরিক শাসনের মধ্যেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছি। ’৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। তখন তো একটা করুণ অবস্থা। দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। অবর্ণনীয় করুণ অবস্থায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমাদের কেটেছে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারিনি। আমি যখন কারাগারে, আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয়নি। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগ্নি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থেকেছেন।

তিনি এক বছর ছিলেন কলাবাগানে। সেই বাসায় কোনো ফ্যান ছিল না। পরে বরিশালের সাবেক এডিসি জনাব এমএ রবের কল্যাণে তার আজিমপুরের বাসার দোতলায় আমার পরিবারের ঠাঁই হয়। কারামুক্ত হয়ে ফিরে সেই বাসায় থেকেছি। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেওয়ার বহু রকম চেষ্টা হয়েছে। কোনো দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেনি। কোনো মামলা দিতে পারেনি। কেরানীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দীন গগনকে দলের সাংগঠনিক কাজ করার জন্য আমি সাধারণ একটা গাড়ি দিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি সেই গাড়ি ফেরত দিয়েছিলেন। অথচ সেই গাড়ির জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আমার এপিএস ছিল শফিকুল ইসলাম মিন্টু। আমি তাকে চাকরি দিয়েছিলাম ’৭৩ সালে। ১৫ আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খুনিচক্রের ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে কতিপয় সেনাসদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় মিন্টুকে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। তার মৃতদেহটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আমার মেজো ভাইকে ’৭৫-এর ৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। আমার বড় ভাই ’৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। এক ছেলে কারাগারে, দুই ছেলে নেই। আমার মায়ের তখন ভয়াবহ করুণ অবস্থা! আমি যে বাড়িতে ছিলাম সেটা পরিত্যক্ত বাড়ি। গভর্নমেন্টের বাড়ি। এই বাড়ি প্রথমে বরাদ্দ দিয়েছিল ‘তোফায়েল আহমেদ, পলিটিক্যাল সেক্রেটারি টু প্রাইম মিনিস্টার’ অর্থাৎ আমার নামে। তখন আমার বয়স বত্রিশ। এই অল্প বয়সে আমি চিন্তা করি আমার নামে বরাদ্দপত্র দেবে কেন? তাহলে তো এটা মনে করার অবকাশ থাকবে যে এটা আমার বাড়ি।

তখন আমার নাম বাদ দিয়ে বরাদ্দপত্র সংশোধন করে ‘অ্যালোটেড টু পলিটিক্যাল সেক্রেটারি টু দি প্রাইম মিনিস্টার’ লেখার নির্দেশ দিই। পরবর্তীকালে এই বাড়ির জন্যই জিয়াউর রহমান আমার নামে এই মর্মে মামলা দিয়েছিল, এই বাড়ি আমি দখল করেছি। যখন আদালত বিশদে কাগজপত্র বিশ্লেষণ করল তখন প্রমাণিত হলো, বাড়িটি ‘পলিটিক্যাল সেক্রেটারি টু দি প্রাইম মিনিস্টার’-এর নামে অ্যালোটেড। ফলে মামলা বাতিল হলো। এভাবে একের পর এক মামলা দিয়ে আমাকে হেনস্তা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি হিসেবে বাড়ি ভাড়া পেতাম।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পাশের বাড়ি এখন যেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের পিতা মালেক সাহেব থাকেন তার বাসায় আমি ভাড়া থাকি। সেই বাড়ির ভাড়া ছিল ছয়শ টাকা। এই বাড়ির মালিক মালেক সাহেবকে আর্মির লোকরা এসে চাপ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে এই স্বীকারোক্তি নিতে যে, ‘আপনি বলেন তোফায়েল আহমেদ জোর করে আপনার বাড়িতে ছিলেন।’ তখন মালেক সাহেব উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তিনি জোর করে থাকেননি। ভাড়া নিয়ে থেকেছেন এবং যেদিন আমি নিজে থাকব বলে বাড়িটি ফেরত চেয়েছি সেদিনই উনি চলে গিয়েছেন।’ সামরিক সরকার এ রকম ক্ষিপ্ত ছিল আমার ওপর।

দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে সব ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ’৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পতাকা তুলে দিয়েছি। তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দলের সংগ্রামী পতাকা গৌরবের সঙ্গে সমুন্নত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর আমরা তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই সর্বস্তরের গণমানুষের সমর্থন পেয়েছি। ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সংবিধান ও সত্যের কাছে আমাদের অঙ্গীকার ও দৃঢ় মনোবল। ’৯৬-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন।

প্রথমেই তিনি সংবিধান থেকে কুখ্যাত ‘ইমডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম করেন। ’৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শুধু ক্ষমাই করেনি, বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছে। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। ২০০১-এ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছে। ২০০৯-এর নির্বাচনে ভ‚মিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ সমাপ্ত করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। খুনিচক্রের যারা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমরা তাদের দেশে এনে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার চেষ্টা করে চলেছি।

আজ ভাবতে কত ভালো লাগে, বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দেশে আজ অনেক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। যার মধ্যে রয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের পায়রা সমুদ্রবন্দর, প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প। পদ্মা সেতু ছাড়াও রয়েছে দেশজুড়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ইত্যাদি। অতীতে ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে মানুষের খাদ্যাভাব ছিল, এখন ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্ত এবং খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। এক সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না বললেই চলে, এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলার। এক্সপোর্ট ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার আজ তা ৩৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা, এখন ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে বলছে ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।’ মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস্ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ‘পরবর্তীকালে যে ১১টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ তার অন্যতম।’ আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান, ‘বাংলাদেশ উদীয়মান দ্রুতগতির অর্থনীতি’ বলে অভিহিত করেছে। ইতোমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। বঙ্গবন্ধুর যেমন দুটি লক্ষ্য ছিল-এক. দেশ স্বাধীন করা এবং দুই. অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা রূপসী বাংলা, আমার বাংলা সোনার বাংলা।’

একইভাবে ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকন্যাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুটি লক্ষ্য স্থির করেছেন এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং দুই. বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তির সেবায় দেশের মানুষ ইতোমধ্যে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। ’৭১-এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর; একই কালপর্বে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর; আর ২০১৪-এর হিসাব মতে বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর, পাকিস্তানের ৬৫ বছর আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। ’৭১-এ ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে বাংলাদেশে ছিল ২২৫ জন; ভারতে ১৬৬ জন। এখন বাংলাদেশে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ জনে, ভারতে তা ৬৫ জন আর পাকিস্তানে ৭২ জন।

আর্থ-সামাজিক সব ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে।’ খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি চমৎকার। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি মডেল।’ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘ বলছে, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।’ বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এই হার অব্যাহত থাকলে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা ২০২১-এর আগেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো। তাই সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই আজ আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা যখন যাই তখন আমাদের যারা একদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।’ বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, আজ তার কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপলাভ করতে চলেছে। আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামে যখন যাই তখন মুগ্ধ হই। কারণ গ্রাম এখন শহরের মতো।

গ্রামে এখন বৈদ্যুতিক আলো। পিচঢালা পথ। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। মানুষের মুখে হাসি। পায়ে জুতা, গায়ে সুন্দর জামা। সুন্দরভাবে বাংলাদেশের মানুষ চলছে। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে দেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ও আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারী অগণতান্ত্রিক শক্তি। কিন্তু আমি দৃঢতার সঙ্গে বলতে পারি, কোনো ষড়যন্ত্রই আজকের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।

বঙ্গবন্ধু তার জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি সব সময় বলতেন, এমনকি দু-দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হৃদয়ের ভালোবাসা অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রেও একটা নীতিমালা আছে। গণতন্ত্রের দিশারি যারা তাদের গণতন্ত্রের নীতিকে মানতে হয়। খালি গণতন্ত্র ভোগ করবেন আর নীতিমালা মানবেন না, ওটা হবে না, হতে পারে না।’ তাই আজকের দিনে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রসর করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি দল-মত নির্বিশেষে আমাদের সবার জন্য অনুসরণীয়। মানুষের জন্য অপার ভালোবাসা আর তাদের কল্যাণে কাজ করাই বঙ্গবন্ধুর মূল ভাবাদর্শ। নিজ চিন্তা ও আদর্শ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।

একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই দরদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসার নিরন্তর প্রতিফলন আমরা দেখি তার কন্যা শেখ হাসিনার নীতি-আদর্শ ও কর্মে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে জনকল্যাণে নিবেদিত থেকে সংবিধান সমুন্নত রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ চেতনা ধারণ করে সমগ্র বিশ্বে পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এ আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য